গাজীপুরে দেড় কেজি হেরোইনসহ গ্রেপ্তার ২

আগের সংবাদ

রাজধানীজুড়ে মশার রাজত্ব

পরের সংবাদ

এমন মৃত্যু মানা যায় না

প্রকাশিত: মার্চ ১৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

হ্যাঁ আমি আপনার কথাই বলছি প্রিয় শিল্পী। আপনার সিদ্ধান্তটি কারো কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু কারণ তো কিছু ছিলই! কেউ কেউ বলছে অভিমান, কেউ বলছেন মনের অসুখ। মনের অসুখ হয়। এবং আজকাল খুবই বেশি হয়! ঘরে ঘরে এ অসুখে ভুগছে মানুষ। কিন্তু আমরা কে কার পরিচর্যা করছি? আমরা না হয় সাধারণ মানুষ, কিন্তু আপনি তো সাধারণ ছিলেন না! আপনি দেশের সম্পদ ছিলেন। জাতির অহংকার। সুতরাং আপনার সিদ্ধান্তে আমরা থমকে গেছি। কখনো মনে হচ্ছে, এ দায় বা কলঙ্ক গোটা জাতির। কখনো মনে হচ্ছে স্যালুট আপনাকে। কারণ আপনি শহীদ পরিবারের সন্তান জানতাম, কিন্তু গত ১২ মার্চ রাতে আপনার আত্মহননের কারণ খুঁজতে গিয়ে কিছু সাক্ষাৎকারে আপনি যা বলেছেন, তা ভয়াবহ! সাংঘাতিক ভয়াবহ! হ্যাঁ ১৯৭১-এর কালরাত ২৫ মার্চে বহু খ্যাতিমান শিল্পী, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, সাংবাদিকদের পাকবাহিনী নির্বিচারে হত্যা করেছিল, কিন্তু আপনার অর্থাৎ সাদি মহম্মদের পরিবারে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর হত্যার কাহিনি আমার জানা হয়নি। প্রিয় শিল্পী সাদি মহম্মদের আত্মহননে শোকে মুহ্যমান আমার সারা রাত কেটেছে তার দেয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকার শুনে। সেখানেই শুনলাম, মা মোটামুটি সেলাই ফোঁড়াই করতেন। আর সাদি মহম্মদ আঁকাতে ভালোবাসতেন। পরিবারের সেজো ছেলে তিনি। তো সেই সময় বাংলাদেশের পতাকা, সবুজের বুকে লাল সূর্যের মাঝে সোনালি মানচিত্রের ছবি এঁকে মাকে দিয়েছিলেন সেলাই করে দিতে। এবং বাংলাদেশের সেই পতাকা ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ তাদের বাড়ির ছাদে উড়ানো হয়েছিল। আর সেটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের জীবনে। কারণ আশপাশের প্রায় সবাই ছিল বিহারি। এবং এলাকায় তাদের বাড়িটিই ছিল একমাত্র চারতলা বাড়ি। পতাকা ওড়ানোর দৃশ্য বিহারদের মাধ্যমে জানাজানি হলে পাকিস্তানি সেনাদের হেলিকপ্টার কয়েক দফা তাদের বাড়িটি রেকি করে যায়। ওদিকে বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামাল ছিলেন তার বড় ভাইয়ের বন্ধু। শেখ কামাল প্রায়ই এসে রাতে থাকতেন সাদি মহম্মদের বাড়িতে। ছোটখাটো মিটিং, আলোচনা হতো তাদের বাড়িতে। আবার অনেক সময় শেখ কামাল রাগ করে বাসায় কাউকে কিছু না বলেই চলে আসতেন। বেগম মুজিব টেলিফোন করে শেখ কামালের খোঁজ নিতেন, পাঠিয়ে দিতে বলতেন। কিন্তু তখনো দেশবাসী জানত না ২৫ মার্চে কী ঘটাতে যাচ্ছে পাকবাহিনী। ২৩ মার্চ তাদের বাড়ির ছাদে পতাকা উড়ানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাড়ির সামনের মসজিদ থেকে বাবা সলিম উল্লাহ জুমার নামাজ থেকে কেবল যখন ঘরে ফিরেছেন, তখন মসজিদে জড়ো হওয়া অবাঙালিরা গুজব ছড়িয়ে দেয়, সলিম উল্লাহর বাড়ি থেকে মসজিদের দিকে গুলি ছোড়া হয়েছে। হতবিহ্বল নিরীহ মুসল্লি সলিম উল্লাহ জুমার নামাজে গিয়েই বুঝেছিলেন, খুব খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। নামাজ না পড়েই বাবা বাসায় চলে এসেছিলেন সেদিন। এরপর বিকালে বিষয়টি নিয়ে মীমাংসায় বসতে চাইলে অনেকে উপস্থিত হলেও অবাঙালিরা অর্থাৎ বিহারিরা কেউ উপস্থিত হয়নি। ফলে রাত ৮টার সময় যে যার মতো ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলে কিছুক্ষণ পরে ককটেল ছোড়া হয় সাদি মহম্মদের বাড়িতে। এবং নিচতলায় আগুনও দেয়া হয়। রাত পর্যন্ত চলে এই তাণ্ডব। একপর্যায়ে চারতলা থেকে সবাই দোতলা পর্যন্ত এসে সন্তানদের নিয়ে দোতলা থেকে পাশের বাড়ির ছাদে লাফিয়ে পড়েছিলেন বাবা সলিম উল্লাহ। তখন তার মায়ের দুই পায়েরই হাড় ভেঙে যায়। কিন্তু সেদিকে খেয়াল দেয়া হয়নি। দিগি¦দিক শূন্য তখন সবাই। আশপাশের বিহারিরা মাথায় পট্টি বেঁধে দা, ছোরা, বল্লম নিয়ে হত্যার উল্লাসে তখন মত্ত। যে বাসার বাথরুমে বাবা সলিম উল্লাহ এবং সাদি মহম্মদ আশ্রয় নিয়ে ছিলেন, সেখানেই চোখের সামনে গরদের পাঞ্জাবি এবং চুড়িদার পাজামা পরা হাতে ছোরা নিয়ে উপস্থিত হয় এক পাকিস্তানি সেনা। এবং বাবাকে পেছন থেকে ফুসফুস বরাবর ছুড়ি মারা হয়েছিল। ছুড়িটি এত গভীরে গিয়েছিল যে, সেই ঘাতকও তা টেনে বের করতে পারছিল না। সাদি মহম্মদের সঙ্গে সেই ঘাতকের চোখাচোখি হয়, বাবার গরম রক্তে তখন তিনি ভেসে যাচ্ছিলেন। প্রচুর রক্তক্ষরণ হলেও ছুরির আঘাতের পর অনেকটা সময় বেঁচে ছিলেন সলিম উল্লাহ। সেই বাবাকে তিনি হাসপাতাল পর্যন্ত নিতে পারেননি। দূর থেকে দেখেছিলেন, বিহারিরা তার বাবাকে মারতে দলবেঁধে ছুটে আসছে। আহত অবস্থায় বাবা তাকে বলেছিলেন, ‘আমি হয়তো বাঁচব না। তোমরা বাঁচ’। বলে ধাক্কা দিয়ে কিশোর সাদিকে পালাতে বলেছিলেন। আহত বাবাকে রেখে তিনি সেদিন পালিয়ে ছিলেন। এরপর কী হয়েছিল তিনি আর দেখেননি। শহীদ হন সলিম উল্লাহ। নিজের জীবন বাঁচাতে তখন ছুটেছেন সাদি মহম্মদ! ছুটতে ছুটতেই চোখের সামনে দেখেছেন কাকার বুক থেকে যমজ দুই বোনকে ছিনিয়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে বল্লম মেরে হত্যা করা হলো কাকাকে। কিছুদূর যাওয়ার পর চোখে পড়েছিল, বাসার সামনের ঈদগার মাঠে তার সামনেই জবাই করা হচ্ছে খালাতো ভাইকে। সেই ভাইকে মারার আগে গলায় দড়ি দিয়ে টেনে-হেঁচড়ে ঘুরানো হয়েছে পুরো পাড়া। সবই নিজ চোখে দেখেছেন সেদিনের কিশোর সাদি। তিনি আশ্রয়ের জন্য, বাঁচার জন্য ছুটেছেন ঘোরের মধ্যে। এবং বেঁচেও গেছেন। কিন্তু গøানির ভার তার দিনকে দিন আকাশ সমান হয়ে উঠছিল। কী হতো বাবার সঙ্গে সেদিন মরে গেলে? কেন স্বার্থপরের মতো বাবাকে ফেলে একা বাঁচার জন্য ছুটেছিলাম? এই সাক্ষাৎকারগুলো ইউটিউবে পেয়েছি। তার নিজের মুখে বলা। ’৭১-এর সেই ভয়াল স্মৃতি যে তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। ভাঙা মচকানো পা নিয়েই তার মা মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ছুটে বেড়িয়েছেন বাঁচার আশায়। এই বাংলাদেশ তার বাবা-কাকার রক্তের দানে পাওয়া। তার মায়ের জীবনযুদ্ধের ওপর গড়ে ওঠা বাংলাদেশ। স্বাধীন দেশে ফিরে ১০ সন্তানের বিশাল এক সংসার নিয়ে সেই মায়ের চলেছে আরেক লড়াই। যা পাশে থেকে দেখেছেন সাদি মহম্মদ। মায়ের লড়াই দেখে হয়তো তিনি বেঁচে থাকার সাহস পেয়েছেন। জীবন যুদ্ধে এত সাহসের সঙ্গে লড়াই করতে করতে তিনি দুই বছর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পর সিদ্ধান্ত নেন সংগীতের জগতে নিজেকে সঁপে দেয়ার। মা ছিলেন তার আত্মার অংশ। তিনি মা বেঁচে থাকতে আত্মহত্যা করলে মাকে আরো কষ্ট দেয়া হতো ভেবেই হয়তো একা পুড়ে গেছেন ভেতরে ভেতরে। এবং সেই শহীদজায়া মা কিংবা পরিবারকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যথাযথ মর্যাদা এনে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন সাদি। এটা লোভ নয়, হয়তো আত্ম গøানি। কারণ তিনি ছিলেন কাদামাটির মতো। বিনয়ী, নম্র, সুশীল, নিরেট ভদ্রলোক। তেল মারা, পদলেহন করে মাথানত করতে শেখেননি বীর মুক্তিযোদ্ধার পুত্র। আদায় করে নিতে চাননি তাদের প্রাপ্য মূল্য এবং মর্যাদা। তাই মাকে তিনি দিতে পারেননি স্বাধীনতার প্রকৃত মিষ্টি স্বাদ। আত্মতৃপ্তি। নিজেও পাননি রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মান, সম্মাননা বা মর্যাদা। ফলে ৯৬ বছর বয়সে মা যখন মারা গেলেন (মাত্র কয়েক মাস আগে), তখন হয়তো তিনিও জীবনের ওপর থেকে সাহস হারিয়ে ফেলেছিলেন। তীব্র হতাশায় ভুগেছেন। অবশেষে রোজা রেখে ইফতার করার পরে প্রিয় তানপুরায় বেদনার ভার প্রকাশ করা শেষ হলে, নিজেই আদায় করে নিয়েছেন মৃত্যুকে।
কিন্তু এই হৃদয়বিদারক ঘটনা বাংলাদেশের একজন মেধাবী খ্যাতিমান শিল্পীর জীবন কাহিনি ছিল, এটা আমরা কে কয়জন জানতাম? যারা জানতেন তারা কেন তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেননি? শিল্পী সাদি মহম্মদ কোটি প্রাণে জাগরূক। অনেকেই বলবেন এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু একজন সাংস্কৃতিক মনা মানুষ কীভাবে বছরের পর বছর যোগ্যদের অবহেলা এবং অযোগ্যদের মূল্যায়ন মেনে নিয়ে মাথা উঁচু করে থাকতে পারেন? কেন পরিচর্যা হয়নি তাদের কোমল মনের। বের করে আনা হয়নি ট্রমা বা আত্মগøানি থেকে! হয়তো এজন্যই তিনি নিজেকে সেসব গøানি থেকে স্বাধীন করলেন। বেছে নিলেন সেই মার্চ মাস মাসকেই। এই সলিম উল্লাহ রোড, তাজমহল রোড যে তার জীবনের কী ভয়ংকর অধ্যায়! তা কি কখনো তিনি ভুলে থাকতে পেরেছিলেন? না, তিনি সেই পুরনো বাড়িটাতেই বলা যায় সহমরণে গেলেন। যদিও আত্মহত্যাকে আমি কখনো সমর্থন করি না। কখনো নয়! কিন্তু আপনাকে, আপনার পরিবারের যথাযোগ্য মর্যাদা পরিমাপ করার যোগ্যতা আসলে এই রাজাকারের দেশে নেই বলেই আপনাদের জীবনের গল্প শোনার পর আমার বারবার মনে হয়েছে, জাতি হিসেবে আমরা কতটা ছোট! কতটা নিচ! কতটা অপমানিত বোধ করছেন আপনি ভেতরে ভেতরে! আপনার পরিবারকে আজ যদি এই রাষ্ট্র কোনো মরণোত্তর পদক, দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননাও দেয়া হয়, তবে তা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করা উচিত। আজ এবং আজ থেকেই বন্ধ করা হোক ‘মরণোত্তর পদক’ প্রথা! এইটা আমার দাবি।
শত শত শিল্পমনা মানুষের দাবি। একটা মানুষের জীবদ্দশায় কর্মময় দশ, বিশ, পঁচিশ, ত্রিশ অথবা পঞ্চাশ বছর পার করেও যখন রাষ্ট্র বা সমাজের পক্ষ থেকে গুণীর কদর করার সময় হয় না, সম্মানিত করার সময় হয় না, খোঁজখবর নেয়ার সময় যখন হয় না তখন মৃত্যুর পর মরণোত্তর পদক দিয়ে মৃত মানুষ কি ডুগডুগি বাজাবেন? নিজেকে কতটা পুড়িয়ে এ সমাজে একজন সৎ শিল্পী, গুণীজন হয়ে উঠেন তা অনেক সময় পরিবারের কাছের লোকরাও জানতে পারে না। কথাগুলো সাদি মহম্মদের পরিবারের জন্য প্রযোজ্য না হলেও শত শত শিল্পীর জীবন শুরু হয় উপেক্ষা দিয়ে। আমি স্যালুট জানিয়েছি মনে মনে যে, আপনার পরিবার আপনার মরদেহকে শহীদ মিনারে নিতে দেননি জানার পরে। নাড়িয়ে দিয়ে গেলেন আমাদের মতো অসহায় কিছু লিখিয়েকে। এতসব ক্ষোভ প্রকাশের সাহস দিয়ে গেলেন। এ আপনি আরো একটি স্বাধীনতার একক যুদ্ধে জয়ী হওয়া দেখিয়ে গেলেন… হৃদয় ভাঙা যন্ত্রণায় স্যালুট জানাই আপনাকে। অমূল্য সম্পদ হারানোর বেদনা নিয়ে স্যালুট জানাই প্রিয় শিল্পী আপনাকে। আপনি ভীষণ নীরবে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন, একটি মৃত্যুও কতটা শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু সত্যি বলতে, আমরা আপনার এবং আপনাদের ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নই।
চির শান্তিতে থাকুন প্রিয় গুণীজন। বিনম্র শ্রদ্ধা আপনার বাবা-মা এবং আপনার প্রতি। আপনার পরিবারের প্রতি।

চন্দ্রশিলা ছন্দা : কলাম লেখক ও কবি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়