সাংবাদিকদের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে : তথ্য প্রতিমন্ত্রী

আগের সংবাদ

অর্থপাচার বাড়ছে যে কারণে

পরের সংবাদ

রাজধানীজুড়ে মশার রাজত্ব

প্রকাশিত: মার্চ ২০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রুমানা জামান : মৌসুমের শুরুতেই নগরজুড়ে দাপট বেড়েছে কিউলেক্স মশার। রাজধানীর দুই সিটিতেই বেড়েছে মশার উৎপাত। বিশেষ করে জলাধার কেন্দ্রিক এলাকাগুলো পুরোটা যেন মশারই রাজত্ব। দিনের বেলা ঘরে থাকতেও লাগে মশারি। সন্ধ্যা নামলেই শুরু হয় আক্রমণ। তখন কিউলেক্সের বিরুদ্ধে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে নেমে পড়তে হয় যুদ্ধে। মশা নিধনে অভিযোগ আছে নগর কর্তৃপক্ষের অবহেলার। কেবল দায়সারা ওষুধ ছিঁটায় দুই সিটি। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, কেবল এডিসের সময় নয়; বছরজুড়েই নিতে হবে ব্যবস্থা। সেক্ষেত্রে গড়ে তুলতে হবে সমন্বিত উদ্যোগ। আর সেখানেই নিজেদের অসহায় মানছেন সিটি করপোরেশন কর্তারা।
সরজমিন রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় দেখা যায়, কল্যাণপুর খাল ধরে একটি খুপরি ঘরে চলছে রাতের রান্না। মধ্য বয়সি নারী নুরুন্নাহার বেগম মাটির চুলায় রান্না করছেন। তবে রান্নার হাঁড়ি থেকে বেশি মনোযোগ অন্য কিছুতে। ভোঁ ভোঁ শব্দ তুলে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা ঘিরে ধরেছে তাকে; দুই হাতে মশা না মেরে গামছা ঘুরিয়ে মশা তাড়াতে ব্যস্ত নুরুন্নাহার। নুরুন্নাহার বেগম আক্ষেপ করেন- ‘গত ১ মাস ধইরা মশার জ¦ালায় জীবনডা শ্যাষ! দিনেও ঘরে মশারি টানাইয়া রাখি। আমার ঘুপচি ঘরে মশারিতেও কাম হয় না। কয়ডা মশা মারুম; একটা মারলে দশটা আইসা জড়াইয়া ধরে। কয়েল কেনার এত টেকা পামু কই কন’। নুরুন্নাহার বেগমের ঘুপচি ঘর থেকে শুরু করে মস্ত অট্টালিকা; সন্ধ্যা নামলেই পুরো এলাকা যেন ঘিরে ফেলে কিউলেক্স। স্থির হয়ে বসে থাকার উপায় নেই। নিস্তার নেই কয়েল-মশারিতেও।
চলতি মাসে মশার অত্যাচার মাত্রা ছাড়াবে- আগেই এমন আভাষ দিয়েছিলেন বিষেশজ্ঞরা। ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে উদ্বেগজনকহারে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব বাড়ছে। এর মধ্যে এক ফাঁদে যত মশা ধরা পড়ছে তার ৯৯ শতাংশ কিউলেক্স মশা। বাকি এক শতাংশ এডিস, এনোফিলিস, আর্মিজেরিস, ম্যানসোনিয়া। গত চার মাসে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব বেড়েছে। জানুয়ারিতে প্রতিদিন গড়ে তিনশর বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মশা ফাঁদে ধরা পড়ছে; যা গত অক্টোবর ও নভেম্বরে ছিল দুইশর কম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি মশার ঘনত্ব পাওয়া গেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উত্তরা, দক্ষিণখান ও মিরপুর এলাকায়। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে পুরো মার্চসহ এপ্রিলজুড়ে মশার অত্যাচার বেড়ে চরমে পৌঁছাবে।
মশা নিধনে স্থানীয় সরকারের অধীনে একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম তৈরির তাগিদ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে তাপমাত্রা বাড়লে মশা জন্মানোর হারও বাড়বে। কারণ এটি হচ্ছে মশা জন্মানোর জন্য উপযুক্ত সময়। ফলে মশা পূর্ণাঙ্গ মশায় রূপান্তরিত হবে। তাই অতি জরুরি ভিত্তিতে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে মশা জন্মানোর স্থানে লার্ভিসাইড ছিটানো না হলে মার্চের শেষ নাগাদ ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। কীটতত্ত্ববিদের ভাষ্য- এডিস আর কিউলেক্সের দমন এক না হলেও ফেব্রুয়ারি মার্চে কিউলেক্স নিধনে বিশেষ অভিযান শুরু করলে তা ডেঙ্গু মোকাবিলায় সহায়ক হয়।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা আগেই বলেছিলেম; এপ্রিলে মশার ঘনত্ব আরো বাড়তে পারে। কারণ তাপমাত্রা বাড়লে মশা জন্মানোর হারও বাড়বে। তিনি বলেন, অনেক

দিন ধরে বৃষ্টিপাত না থাকায় মশা জন্মানোর স্থানগুলো যেমন- ড্রেন, ডোবা, নর্দমা-নালায় পানির অর্গানিক ম্যাটারিয়াল বেড়ে যায়। এই অর্গানিক ম্যাটারিয়ালগুলো কিউলেক্স মশার লার্ভার খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এতে বংশ বিস্তার বেড়ে যায়। তাই অতি জরুরি ভিত্তিতে ক্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে মশা জন্মানোর স্থানগুলো যেমন- নর্দমা, ডোবা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সেখানে লার্ভা মারার জন্য কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। তা না হলে মার্চ মাসে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে মশার উৎপাত।
মশক নিধন কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, কিউলেক্স মশার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে কাজ চলছে। এখানে কারো বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। যদিও মশক কর্মীদের অবহেলার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে উত্তরের নগর পিতা বলেন, অভিযান কিন্তু চলছে। সকালে চলছে, বিকালেও চলছে। কিন্তু যে যে সংস্থা আছে, তারা যদি এগিয়ে আসে তাহলে আমরা কন্ট্রোলে রাখতে পারব। এটা আমরা করতে পারছি না।
খরচ বাড়লেও মশা কমে না : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় মশা মারার জন্য ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা, পরে সেটা বেড়ে ৫৮ কোটিতে দাঁড়ায়। চলতি অর্থবছরে ডিএনসিসিতে মশা মারতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮৪ কোটি টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে মশক নিধনের খরচ অনেক বাড়লেও এ কাজে সফলতা দেখাতে পারেনি ডিএনসিসি। একই অবস্থা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনেও। সেখানে প্রায় ৫০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। নগরবাসীর অভিযোগ, এর কারণ সিটি করপোরেশনের গাফিলতি, কার্যকরী ওষুধ ব্যবহার না করা, ঠিকমতো ওষুধ না ছিটানো ও মশার প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করে ধ্বংস করতে না পারা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) ১০টি অঞ্চল রয়েছে। এসব অঞ্চলে ৭৫টি ওয়ার্ড রয়েছে। মশানিধনে ১ হাজার ৫০ জনবল কাজ করছে। মশানিধনে প্রায় ৫০ কোটি টাকা খরচ হয়। কিন্তু মশার আক্রমণ থেকে রেহাই নেই। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো ফজলে শামসুল কবির বলেন, এখন কিউলেক্স মশা বেশি হয়ে থাকে। মশার বিস্তার কমাতে আমাদের মশানিধনকর্মীরা কাজ করছে। ৭৫ ওয়ার্ডের প্রতিটিতে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত লার্ভিসাইডিং ও দুপুর আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত অ্যাডালটিসাইডিং ওষুধ ছিটানো হয়। মশার বংশ বিস্তার কমাতে খাল, ডোবা, নালা, ড্রেন পরিষ্কার করা হচ্ছে। আমাদের কাজের কারণে এ বছর মশা অনেক কম। তিনি বলেন, সামনে ডেঙ্গুর মৌসুম। আমরা সতর্ক আছি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনও (ডিএনসিসি) ১০টি অঞ্চলে বিভক্ত। এসব অঞ্চলে মোট ৫৪টি ওয়ার্ড রয়েছে। ডিএনসিসিতে মশানিধনে গত অর্থবছরে ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮৪ কোটি টাকা। ডিএনসিসি জানায়, স¤প্রতি উত্তর সিটিতে কিউলেক্স মশার মোট ৯২৫টি হটস্পট শনাক্ত করা হয়েছে। ১০টি অঞ্চলে মশা নির্মূলে নিয়মিত কর্মীর সংখ্যা ৫৫০। পাশাপাশি আরো কিছু অনিয়মিত কর্মীসহ সর্বমোট মশককর্মী হিসেবে কাজ করছেন প্রায় এক হাজার কর্মী।
মশা নিধনের প্রস্তুতির বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, আগামী মাসে (এপ্রিলে) কিউলেক্স মশার প্রাদুর্ভাব বাড়তে পারে। তাই কর্মপরিকল্পনা-২০২৪ প্রণয়ন করেছি এবং বিশেষ কিছু কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। কার্যকারী ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে। এছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য বিশেষ অভিযান, খাল উদ্ধার, আবর্জনাভর্তি শত শত বিঘা জলাশয়ের কচুরিপানা গত জানুয়ারি মাসে পরিষ্কার করা হয়েছে। তিনি বলেন, মশা নিধনে ‘হাজিরা অ্যাপস’ নামে একটি অ্যাপস তৈরি করা হয়েছে। ড্রোন ব্যবহার করেও মশার হটস্পট নির্ধারণ ও অ্যাপসভিত্তিক হটস্পট রিপোর্টিংয়ে ব্যবস্থা করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যের প্রি-ইনস্পেকশন রিপোর্ট আসে মৌসুম শেষে : কীটতত্ত্ববিদদের ওপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্ভরতা অনেক। মশা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইনস্পেকশন করে ডিসেম্বরে; আর রিপোর্ট দেয় জুলাই-আগস্টে। ফলে মশা নিধন কার্যক্রম শুরু করতে দেরি হয়ে যায় সিটি কপোরেশনের। এতোদিনে মশা বংশ বৃদ্ধি করে বিস্তর ছড়িয়ে পড়ে। এ বিষয়ে ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসের বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নগরীর বিভিন্ন এলাকায় প্রি-ইনস্পেকশন করে থাকে। তারা ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে ইনস্পেকশন করে তার রিপোর্ট সিটি করপোরেশন পাঠায় জুলাই-আগস্টে। ফলে অভিযান দেরিতে শুরু হয়। ইতোমধ্যে মশা বংশবিস্তার করে ফেলে। রিপোর্ট যথাসময়ে পেলে দ্রুত অভিযান চালিয়ে মশার আবাসস্থল ধ্বংস করা যায়।
সিটি কপোরেশনে কীটতত্ত্ববিদ সংকট : মশা নিধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কীটতত্ত্ববিদরা। শহরের কোথায় মশার প্রজননস্থল তৈরি হয়েছে এবং সেখানে মশা নিধনে কী কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার, তা নিয়মিত ইনস্পেকশন করে প্রতিবেদন দেন করপোরেশনের কীটতত্ত্ববিদরা। তার ওপর ভিত্তি করেই করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এরকম কেউই নেই। আর উত্তর সিটিতে আছেন মোটে একজন। মশা নিয়ন্ত্রণে মশার প্রজাতি নির্ণয়, স্থানভিত্তিক মশার ঘনত্ব, অধিক মশা উৎপাদনের কারণ এবং মশক নিধনকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ১০ জন কীটতত্ত্ববিদের জন্য আবেদন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। সেখান থেকে ৫ জনকে দেয়া হয় ডিএনসিসিতে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাঁচ কীটতত্ত্ববিদের মধ্যে তিন জন ডিএনসিসিতে যুক্ত হলেও এখনো দুইজন কাজে যুক্ত হননি। এই দুইজনের একজন ডিএনসিসিতে না আসার জন্য মামলা করেছেন বলেও জানায় ডিএনসিসির একটি সূত্র। আর যুক্ত হওয়া তিন জনের একজন মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করলেও বাকি দুই জন কোনো কাজে নেই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়