রাজধানীতে ছুরিকাঘাতে যুবক খুন

আগের সংবাদ

ঝুঁকির মধ্যেই অনিয়ম বহাল

পরের সংবাদ

জিআই টাঙ্গাইলের শাড়ি চমচম

প্রকাশিত: মার্চ ১৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অরাজনৈতিক মনে হলেও এমন অনেক বিষয় আছে, যা রাজনৈতিক ও সামাজিক বলে আমরা মনে করি। যেমন কবিতার বিষয়ে অনেকেই মনে করেন এই শিল্পটির মৌলিকত্ব রাজনৈতিক নয়, তা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। কিন্তু কবিতা যে কোনো সময়ই তা রাজনৈতিক ও সামাজিক মানুষের ভাবনাচিন্তা ও আকাক্সক্ষাকেই ধারণ করে এবং তাকে নানা প্রতীক, চিত্রকল্প ও অ্যালিগরির মাধ্যমে নির্মাণ করে। সেই সঙ্গে তার ভাষিক সাম্য ও সাজুয্য ওই অঞ্চলের মানুষের ব্যবহারিক ও সাংস্কৃতিক প্যাটার্নের অন্তরে প্রোথিত থাকে। এসব বিষয়কে আমরা ভৌগোলিক চিহ্নের (জিওগ্রাফিক্যাল আইডেনটিফিকেশন) অন্তর্গত বলে চিত্রিত ও চিহ্নিত করতে পারি। যেমন বাংলাদেশের কবিতার কাব্যভাষা আর পশ্চিমবঙ্গের কবিতার ভাষা ও তার সাংস্কৃতিক চেহারার মধ্যে পার্থক্য আছে। পশ্চিম বাংলার প্রকৃতি ও প্রতিবেশের সঙ্গে আমাদের প্রকৃতির মিল ও অমিল দুটোই আছে। সেই সঙ্গে আছে ভাষিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য। শব্দের উচ্চারণগত পার্থক্য দেখলেই তা অনুমান ও অনুধাবণ করা যায়।

দুই.
আজকাল খুব আলোচনা চলছে ভৌগোলিক চিহ্ন বা নিদর্শন (জিওগ্রাফিক্যাল আইডেনটিফিকেশন) (জিআই) নিয়ে তুমুল আলোচনা। এর সূচনা হয়েছিল ঢাকার জামদানি শাড়ি আর টাঙ্গাইলে তাঁতের শাড়ির জিআই নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার সেখানকার তাঁতের সুতি শাড়িকে টাঙ্গাইলের শাড়ি হিসেবে জিআই করার উদ্যোগ নেয়। সেটা হয়েছে টাঙ্গাইল থেকে দেশভাগের সময় কিছু তাঁতি চলে যায় পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, নিজেদের কারিগরি বিদ্যায় পারদর্শী শাড়ি উৎপাদন করতে থাকেন। পাকিস্তানি আমলেও কিছু তাঁতি মাইগ্রেট করে চলে যায়। বাংলাদেশ আমলেও কিছু তাঁতি চলে যায়। এভাবে একটি বড় তাঁতিপল্লী গড়ে উঠেছে সেখানে। তাদের উৎপাদিত শাড়ি তাদের স্মৃতির শহরের নাম টাঙ্গাইলের নামে চালু করে। মূলত টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই সৃষ্টি হয় সেখান থেকেই। টাঙ্গাইল শাড়ি যখন দেশের সীমানা পেরিয়ে ভিন্ন দেশের একটি এলাকায় তার সুনামকে পুঁজি করে বড় হয়ে ওঠে তখন এটাই প্রমাণিত হয়, টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প তার বিশিষ্টতার প্রাধান্য বিস্তার করতে পেরেছে। ঢাকার মিরপুরে গড়ে উঠেছে একটি শাড়িপল্লী, যারা বিয়ের জন্য নানারকম বেনারসি উৎপাদন করে। এখন ওই শাড়ির জিআই কি বেনারসি হিসেবে দিতে পারব? নামকরণের বিষয়টি এলাকার প্রাধান্য আছে। জিওগ্রাফিক্যালি বেনারস ভারতের একটি প্রসিদ্ধ এলাকা। বিশিষ্ট মাড়ি উৎপাদনের জন্য তারা বিখ্যাত। আমরা প্রায় পত্রিকার বিজ্ঞাপনে কলকাতার নামিদামি কাগজের শিরে টাঙ্গাইলের শাড়ির রমরমা প্রদর্শনী দেখেছি। তারা সেই বাজারকে লক্ষ্য রেখেই তাদের জিআই করতে চেয়েছে টাঙ্গাইল শাড়িকে। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য এটাই, পশ্চিমবঙ্গে নেই কোনো টাঙ্গাইল নামের জেলা শহর ও সন্নিহিত বিশাল তাঁতপল্লী। যখন ভারতীয় শিল্প মন্ত্রণালয় জিআই হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজেদের বলে চিহ্নিত করতে যায়, তখনই আমরা জানতে পারি বিষয়টি।
সেই থেকেই টনক নড়ে আমাদের। অবহেলা ও অবজ্ঞার মধ্যেই আমাদের বসবাস। সেখানেই লুকিয়ে আছে এমন অনেক সম্পদ, যা আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। আমরা সেগুলোর কোনো মূল্য দিই না। মূল্যায়ন করি না। কারণ আমরা আত্মমগ্ন জাতিসত্তা। এই আত্মমগ্নতার ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এমন অনেক সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ব্যবহারিক সম্পদ হারিয়ে যাবে। জিআই সেসব সম্পদকে রক্ষার একটি অনন্য পদক্ষেপ বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলা যখন মহকুমা ছিল, তারও সুদূর অতীত থেকেই এখানকার শাড়ির কারিগরি ও শাড়ি তৈরির সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। কুটির শিল্প হিসেবে এই শাড়িশিল্প গড়ে ওঠে। এই তাঁতিদের শাড়ির পাড়ের কারুকাজ, নকশা বিভিন্ন কাউন্টের চিকন সুতা, পাকা রং, নকশার ভেতরের টেকচার ও বুননের সৌকর্যের রূপময়তা এ দেশের নারীদের মন কেড়ে নেয়। অতিগরিব ছাড়া সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রধান আকর্ষণ টাঙ্গাইলের শাড়ি। আপনারা কি ভাবতে পারেন ১৯৬৮/৬৯/৭০ সালে টাঙ্গাইলের একটি সাধারণ শাড়ি আমি কিনেছি ১ টাকায়। আর মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে আমার মায়ের জন্য ১০ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম অপূর্ব একটি শাড়ি, যা আজো আমার চোখের তারায় জ্বল জ্বল করছে। শাড়ির সুতা, রং, নকশা ও বুননের বৈচিত্র্য টাঙ্গাইল শাড়িকে অনন্য করেছে।
সাধারণত পণ্যের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির বৈশিষ্ট্যই তাকে অনন্য করেছে। সেই সঙ্গে এখানকার তাঁতিদের প্রজ্ঞাময় চেতনার রূপটিও আমরা দেখতে পেয়েছি, তাদের সুদক্ষ কারুময়তায়। টাঙ্গাইলের শাড়ির বৈশিষ্ট্যের জন্যই এই জেলার পরিচয় গড়ে উঠেছে- ‘টমটম চমচম গজারির বন/টাঙ্গাইল শাড়ি তার গরবের ধন’ অথবা নদী চর খাল বিল গজারির বন/ টাঙ্গাইল শাড়ি তার গরবের ধন’। খুবই প্রচলিত এই দুটি কবিতার অংশ। প্রথমটি লিখেছেন আ ফ ম খলিলুর রহমান আর দ্বিতীয়টির রচয়িতা কবি আবদুর লতিফ। তথ্য দিয়েছেন কবি মাহমুদ কামাল। আমি এ দুটি পঙ্ক্তির কবিতা জানতাম, কিন্তু জানতাম না কারা এর রচয়িতা।
এই ধন যে আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ, তা কেবল ভৌগোলিক দাবিই নয়, আমাদের শেকড়ের অংশ হিসেবেই তা আমাদের বলে চিহ্নিত হবে এবং ইতোমধ্যেই হয়েছে।

তিন.
এখন আরো কিছু ঐতিহ্যের স্মারক চিহ্ন নিয়ে কথা বলা যাক। একটি পণ্য যখন জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত হয়, তখন এর গুণগত মান ও অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সংরক্ষণ দরকার। সে জন্য প্রয়োজন পণ্যের গায়ে হলমার্ক জুড়ে দেয়া। এটা জেলা প্রশাসন ছাড়া কেউ করতে পারে না। দেখা গেছে, এ পর্যন্ত জিআই পণ্যের মর্যাদা পাওয়া প্রায় সব পণ্যের ক্ষেত্রেই সমস্যা কমবেশি একই।
গত বছরের শেষ দিকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচম। এ নিয়ে তখন জেলার শুধু ব্যবসায়ী মহল নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও উচ্ছ¡াস দেখা গেছে। তবে জিআই করার পর চমচম নিয়ে আর কিছুই এগোয়নি বলে জানান টাঙ্গাইলের হোটেল রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি স্বপন ঘোষ। তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের চমচমের মান রক্ষিত হচ্ছে কিনা, তা দেখা দরকার।
জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর বগুড়া জেলা শহরের ব্যবসায়ীরা কিছুটা সুবিধা পেলেও ‘দইয়ের রাজধানী’ বলে খ্যাত শেরপুর উপজেলার ব্যবসায়ীরা কিন্তু এ থেকে তেমন কোনো লাভ দেখছেন না। শেরপুরের বৈকালী দই মিষ্টি ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী পার্থ সাহা বলেন, ‘জিআই হওয়ার পর যেটা হয়েছে, আমাদের পণ্যের ওপর আরো ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু এর বাণিজ্যিক প্রসারে এখনো কোনো উদ্যোগ দেখছি না।’
বগুড়ার দই জিআই পণ্য হয়েছে গত বছরের ২৫ জুন। কিন্তু এখনো এর সনদ জেলা প্রশাসনের কাছে পৌঁছায়নি বলে জানান জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সনদ না পাওয়ার কারণে আমরা এ পণ্য নিয়ে পরিকল্পিত কাজগুলো করতে পারছি না।’ আর টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম জানান, শুধু চমচম নয়, টাঙ্গাইলের শাড়ি, আনারস ও কাঁসার প্রদর্শনী ও বিক্রির জন্য একটি স্থান নির্ধারণের পরিকল্পনা করছেন তাঁরা। (প্র.আ.১৪ মার্চ,২৪)
জিআই নিয়ে যতই উচ্ছ¡াস করি না কেন, আমাদের প্রশাসন একটি স্থবির প্রশাসন হিসেবেই বসে আছে। তারা রাজনৈতিক সরকারের তল্পিবাহক হিসেবে যতটা তৎপর ও গতিশীল, ঠিক ততটাই দেশের প্রধান মান ও মর্যাদার বিষয়ে খুবই নেতিবাচক দৃষ্টভঙ্গি ধারণ করেন বলে মনে হয়। তারা এ নিয়ে কোনো চিন্তা বা অগ্রগামী পরিকল্পনা করেছেন, এমন প্রমাণ নেই। তবে প্রমাণ আছে তারা কীভাবে ক্ষমতা নিয়ে বসে আছে। ২০২৩ সালের ২৫ জুন বগুড়ার দইয়ের জিআই নিবন্ধন হলেও আজো পর্যন্ত তার সনদ যায়নি সে জেলার জেলাপ্রশাসকের দপ্তরে। এই নিবন্ধন ও সনদ দেয়ার মালিক শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। এই অধিদপ্তর আজো ২৩টি পণ্যের জিআই সনদ দিতে পারেনি। ফলে জিআই পরবর্তী কাজগুলো করতে পারছে না জেলা প্রশাসন। তাহলে কীভাবে আমরা আমাদের জিআই পণ্যের প্রসার ঘটাব। কীভাবে জানাব এই পণ্যে ব্যবহৃত উপকরণ, উপাদানের নাম ও পরিমাণ? আন্তর্জাতিক বাজারে ওই পণ্য রপ্তানির যেমন সুযোগ আছে, তেমনি তার ভেল্যু যে বেড়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হলমার্ক ছাড়া তো আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য বিক্রি করা যাবে না।
আকবরিয়া হোটেল কর্তৃপক্ষ ১ হাজার ৬০০ প্যাকেট বগুড়ার দই সরবরাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্ডার পেয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বগুড়া শহরের এই প্রতিষ্ঠান এখন দই সরবরাহের অর্ডার পাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া ক্রয়াদেশ তার একটি। আকবরিয়ার স্বত্বাধিকারী মো. হাসান আলী আলাল গত বৃহস্পতিবার বলছিলেন, ‘বগুড়ার দই ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর দেশের বাইরে থেকে অর্ডার পাওয়া বেড়েছে। কিন্তু বেশ কিছু সমস্যার কারণে আমরা সরবরাহ করতে পারছি না।’
হাসান আলী আলালের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রচলিত যে পদ্ধতিতে এখন দই তৈরি ও সংরক্ষণ করা হয়, তার মেয়াদ বেশি নয়। যদি দইকে রপ্তানি পণ্য হিসেবে আরো জনপ্রিয় করতে হয়, তাহলে নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। এতে সহযোগিতা লাগবে সরকারের।
হাসান আলী যে সহযোগিতার কথা বলেছেন, তার ভাষ্য মতো সরকারের হলেও, আসলে ডিপিডিটি সহযোগিতাই তাদের প্রয়োজন। ডিপিডিটির কর্মকর্তারা আসলে বুঝতেই পারছেন না যে দইয়ের হলমার্ক কোথায় বসাবেন। কিংবা বিএসটিআই যে ছাড়পত্র দেয়, দইয়ের গায়ে তাদের সিল বসাবেন নাকি প্যাকেটে বসাবেন সেই চিন্তায় আছেন। হাসান আলী আলাল বলেছেন প্রচলিত দইয়ের কনটেইনার, যা প্রচলিত, সেভাবে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো যাবে না। এই ধরনের পণ্যের জন্য বিশেষ প্যাকেট করতে হবে বলে আমার ধারণা। আইসক্রিমের জন্য যে রকম খাদ্য উপযোগী কনটেইনার ও কাগুজে প্যাক চালু আছে, সেই রকম প্যাক বগুড়ার দইয়ের জন্য প্রয়োজন।
এসব কারণেই জিআই সনদ জরুরি। হাতে সনদ থাকলে বাকি কাজটি জেলা প্রশাসন করতে পারে।

ড. মাহবুব হাসান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়