রেজিস্ট্রার পদ থেকে স্বেচ্ছা অব্যাহতি ওহিদুজ্জামানের : নতুন দায়িত্বে ড. আইনুল ইসলাম

আগের সংবাদ

এক্সিমে একীভূত হচ্ছে পদ্মা

পরের সংবাদ

জাতিসত্তা বিকাশে একুশের আবেদন সমুন্নত রাখতে হবে

প্রকাশিত: মার্চ ১৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাঙালির জাতিসত্তার ভিত্তি সুদৃঢ় করতে অমর একুশের গুরুত্ব অপরিসীম। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত অমর একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনে এমন এক আবেগের স্থান দখল করে নিয়েছে, যা কেবল একটি মাস বা দিন নয়; একটি চেতনা-প্রেরণা। একুশ বাঙালিকে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে যুগ-যুগান্তরে। সালাম, বরকত, রফিক, শফিউরের তাজা রক্তে সৃষ্ট বায়ান্নর বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণই পরবর্তীতে পৌঁছে দিয়েছে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে। মূলত একুশে বোপিত ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
একুশ কীভাবে বাঙালি জাতিসত্তার প্রেরণায় অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছে, বর্তমান ও অনাগত প্রজন্মের সেই সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। মাতৃভাষা জাতিসত্তা বিকাশে কীভাবে মূল ভূমিকা পালন করে, সে সম্পর্কে সম্মুখ ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- (১) একই ভাষাভাষী মানুষ সম্প্রদায়কে সহজে বুঝতে পারে এবং সংহতির অনুভূতি জাগিয়ে তোলে, যা একটি জাতীয় পরিচয় গঠনে অবদান রাখে। (২) ভাষা স্বগোত্রীয় নাগরিকদের মাঝে কার্যকর যোগাযোগে সক্ষম বিধায় একটি জাতির মধ্যে সামাজিক সংহতি ও ঐক্য গঠন সহজতর করে। যা সম্মিলিত মূল্যবোধ, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। (৩) ভাষা সাংস্কৃতিক সূ²তা, অভিব্যক্তি-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে সাহায্য করে, যা নাগরিকদের স্বত্বাধিকারকে শক্তিশালী করে। (৪) ভাষা রাজনৈতিক ও সামাজিক একীকরণের হাতিয়ার হিসেবে জাতির মধ্যে বিভিন্ন জাতিগত, ধর্মীয় ও আঞ্চলিক গোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্ভুক্তি এবং বোঝাপড়ার সহযোগিতা করতে পারে। (৫) শিক্ষা, প্রশাসন ও শাসনের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে ভাষা নাগরিক সম্পৃক্ততা উৎসাহিত করে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলোতে অংশগ্রহণের সুবিধা দেয়। (৬) ভাষা সাহিত্য, কবিতা, সংগীত ও থিয়েটারসহ শৈল্পিক প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে সাংস্কৃতিক পরিচয় ও শৈল্পিক উৎপাদনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। (৭) ভাষার দক্ষতা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈশ্বিক বাজারে অংশগ্রহণ সক্ষমতা বাড়ায় এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে ব্যবসা বাণিজ্যকে সহজতর করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারে। (৮) একই ভাষা ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের বৃহত্তর ভাষাগত সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংযুক্ত করে সাংস্কৃতিক বিনিময় স্থানান্তর করে ও ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। (৯) অভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে একক জাতিসত্তার অসাম্প্রদায়িক ঐক্য চেতনায় শক্তিশালী সমৃদ্ধ জাতি গঠনে সহায়ক হতে পারে।
অসংখ্য আন্দোলন সংগ্রামের পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ঘটনাপ্রবাহ থেকে এ কথা বলা যায়- রক্ত দিয়ে যে অমর একুশের সৃষ্টি, তা মূলত স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। স্বাধীন বাঙালি জাতিকে এগিয়ে যেতে হলে অমর একুশের মর্মবাণী ও আবেদনের পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া ব্যতিত কোনো বিকল্প নেই। একুশের আবেগ, আবেদন, মাথানত না করার আদর্শিক চেতনা থেকে বিচ্যুত হলে পথ হারাবে বাংলা ও বাঙালি জাতি।
পরাধীন পাকিস্তান আমলেও শাসক সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে গভীর মমত্ববোধ ও হৃদয়ের আবেগ দিয়ে অমর একুশে পালন করা হতো, সাধারণের সরব অন্তর্ভুক্তি ও প্রাণের উচ্ছ¡াস ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নির্মম ও কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ডের পর সেই ভাবাবেগ প্রত্যাশিত মাত্রায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি প্রভাতফেরির মর্মবাণী ও আবেদন থেকে জাতিকে দূরে সরানোর অকৌশলই মূলত সর্বজনীন একুশের আবেদন হোঁচট খেয়েছে। অমর একুশের প্রথম প্রহরের নতুন উপাখ্যান রাত ১২টা ১ মিনিটে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর রীতি সাধারণকে সর্বজনীন প্রভাতফেরির শ্রদ্ধা নিবেদন থেকে নিরুৎসাহিত করার অপকৌশল কিনা? বিষয়টি ভাবার সময় এসেছে।
কেননা অমর একুশ বাংলা ও বাঙালি জাতিকে ঘুটঘুটে আঁধারের পথনির্দেশ করেনি বরং অন্ধকার থেকে আলোর পথের পথনির্দেশনা প্রদান করেছে। এই মহাবিশ্বের একটি গ্রহ তথা এই পৃথিবীতে সূর্যের শক্তি ও আলোর বিচ্ছরণ না থাকলে প্রাণের সৃষ্টি বা অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। এই পৃথিবীতে সূর্যের শক্তি জৈবযোগসহ পানি মিথস্ক্রিয়ায় প্রাণের সৃষ্টি, জাগরণ, উচ্ছ¡াস, বিচরণ কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি। আলোক রশ্মির অনুপস্থিতি নিশ্চুপ নীরব হয়ে যায় পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে। সুতরাং সূর্যের শক্তিই আলোর পথ নির্দেশ, আলোর পথেই মুক্তি, আলোর পথে নিত্যনতুন পথের সন্ধান।
স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ২১ ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ মানুষ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তি ও রাজনৈতিক দলের জাতীয় নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও সারিবদ্ধভাবে প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণ করেছে। ক্ষমতার প্রভাব না দেখিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একই লাইনে থেকে শহীদবেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। যার মধ্য দিয়ে জনগণ ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। জনগণ রাজনীতিবিদদের প্রতি অধিকতর শ্রদ্ধাশীল হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে প্রতিক্রিয়াশীল কাণ্ডজ্ঞানহীন কিছু মানুষ একুশের আবেদনকে নষ্ট করার অসৎ উদ্দেশ্যে নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন সময়ে কতিপয় রাজনৈতিক মাথা মোটা ব্যক্তিরা ক্ষমতার দাপটে নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে, হাজার হাজার ছাত্র, শিক্ষক, জনতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পুলিশের নির্দেশ অমান্য করে জোরপূর্বক শহীদবেদিতে প্রবেশ করে এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। যা শুধু অনাকাক্সিক্ষত নয় বরং মহান একুশের আবেদন বিনষ্ট করার অপপ্রয়াস। মনে রাখা বাঞ্ছনীয়, বাঙালি জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার ভিত্তি নষ্ট হলে জাতির পিতার বহু কাক্সিক্ষত শোষণ-বঞ্চনামুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ার অঙ্গীকারে এগিয়ে চলাও বিভ্রান্তির পথে ধাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
অপ্রিয় হলেও সত্য, সময়ের পরিক্রমায় বাঙালি জাতিসত্তার গৌরবময় জাতীয় দিবসগুলো অনেক ক্ষেত্রে শুধু আনুষ্ঠানিকতা ও মিডিয়া কভারেজে মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলীয় উন্মাদনা ও ফটোসেশনের তাড়না এবং আত্মপ্রচারের প্রয়াস থেকেই বেড়েছে শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধ কেন্দ্রিক ব্যানারের ছড়াছড়ি। দেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চা বাধাগ্রস্ত হয়ে বিত্ত আহরণের আদর্শিক দ্ব›দ্বও এখানে ব্যাপক প্রভাব রাখছে। গণমুখী রাজনীতি ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোতে ত্যাগী নেতাকর্মীর ক্রমাবনতি, সংগঠনের বিভিন্ন কর্মে শৃঙ্খলার ঘাটতি জনজীবনে অনেক ক্ষেত্রেই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। শ্রদ্ধা নিবেদন কর্মসূচিতে কতিপয় দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে শৃঙ্খলার ঘাটতি নানান ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনার সূত্রপাত ঘটাচ্ছে। তৃণমূল থেকে জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বে ত্যাগ ও দেশপ্রেমমূলক সংস্কৃতির অপ্রতুলতার কারণে রাজনীতিতে ত্যাগের মানসিকতা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব সমাজরাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবক্ষয়ে পরিলক্ষিত হচ্ছে। মানবকল্যাণের রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শ চর্চার অনুপস্থিতি জাতিসত্তা বিকশিত করার ক্ষেত্রে অশনি সংকেত।
১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২; ভাষা আন্দোলনের পরিক্রমায় জনজীবনে সর্বক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একক জাতিসত্তার অসাম্প্রদায়িক ঐক্য চেতনা সৃষ্টি হয়েছিল। যা বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা অর্জনে মূল ভূমিকা রেখেছে। তবে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সেই ঐক্য বিভিন্ন অজুহাতে বাংলা ভাষা উন্নয়নে ব্যবহারিত হয়নি। ফলে সমাজ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রক ও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যোগাযোগে বাংলা ভাষা ব্যবহার করলেও ঐক্যবোধ সৃষ্টি হয়নি। ভাষা পণ্ডিতদের মতে এই অনৈক্য থেকে মুক্তি পেতে হলে বাংলাকে একটি আনুষ্ঠানিক জনভাষা রূপ দেয়া জরুরি।
বায়ান্নর চেতনা সমুন্নত রাখা ব্যতীত রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণ-বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে পারবে না। কেননা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেনিয়াচক্রের কারসাজিতেই বায়ান্নতে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্য চেতনাকে দুর্বল করার নানামুখী অপৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৯০ ভাগ নির্বাচিত সদস্য ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী। সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের কেউই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার সংবলিত পোস্টার লিফলেট বিতরণ করেছেন- এমনটা শোনা বা জানা যায়নি। স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়- একুশের আবেদন সমুন্নত না থাকায়, জাতীয় জনজীবনের চলমান প্রক্রিয়ায় মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও বহুলাংশে মøান হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে- মাতৃভাষা রক্ষায় ও মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনে যে জাতি অব্যাহতভাবে দুই দশক সীমাহীন ত্যাগ ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণকে পথ দেখাল, সেই গৌরবান্বিত বাঙালি জাতি কীভাবে দিকভ্রান্ত বা পথ হারাল?
মাতৃভাষার জন্য বাঙালির ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হলেও সময়ের পরিক্রমায় বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার উদাসীনতা মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় গভীরতা পায়নি। রয়েছে আকাশ সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব। গুণগত শিক্ষার অভাবে দেশে ধনীদের মাঝে ইংরেজি মাধ্যম প্রীতি বেড়েছে। উচ্চবিত্তের সন্তানরা এখন আর বাংলা ভাষায় নিজেদের আভিজাত্য খুঁজে পাচ্ছে না। তারা ছুটে বেড়াচ্ছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দিকে। বিষয়টি সরকারপ্রধানেরও নজর এড়ায়নি। গত ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশের গ্রন্থমেলা উদ্বোধনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশে করণীয় প্রসঙ্গে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। বাংলা ভাষার সাহিত্য ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্ব অঙ্গনে ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় বই ডিজিটাইলাইজড করার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রতিটি বইয়ের অডিও ভার্সন করার জন্য প্রকাশকদের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নত দিকগুলো বিদেশি ভাষা থেকে মাতৃভাষায় অনুবাদ করে বাংলা ভাষা স্থান করে দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য বিদেশি ভাষাগুলো অনুবাদের মাধ্যমে স্থান করে দিতে হবে। নিজ মাতৃভাষা ভালোভাবে বলতে পারার মধ্যে স্মার্ট দিক দর্শন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিজ মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে অন্যভাষা বলার মাঝে স্মার্ট মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ পায় না।
টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে অর্থনীতির পাশাপাশি শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি অগ্রগমনেও মনোযোগ বাড়াতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ না করা গেলে সমাজরাষ্ট্রের উন্নয়ন স্থায়িত্ব হবে না। সাহিত্য সংস্কৃতি মানুষের মাঝে সৌন্দর্যবোধের পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধ জাগরণ ঘটায়। নানান কারণে সেই জ্ঞানভিত্তিক সমাজরাষ্ট্র গড়ে তোলা যায়নি। সে কারণে সৃষ্ট ভোগভিত্তিক সমাজরাষ্ট্র জাতীয় ক্ষেত্রে অনাচার সৃষ্টি করছে। যার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় অমর একুশের শ্রদ্ধা নিবেদনের আনুষ্ঠানিকতায়। আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থান্বেষী নিষ্ঠুর সংস্কৃতি দেশের সর্বক্ষেত্রে বিস্তৃত হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য মানবিক মূল্যবোধের পাশাপাশি একুশের বাঙালি জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করার প্রচেষ্টা নিতে হবে।
বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচিতে জনসাধারণের অংশগ্রহণ ছিল অপরিহার্য। আর অসারধারণরা অর্থাৎ উচ্চ শ্রেণিভুক্ত বর্ণবাদীরা অধিকাংশই কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে সম্পৃক্ত ছিল না, ছিল বরাবরে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ভাষা সংগ্রামে যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই ছিল সাধারণ পরিবারের সদস্য। অথচ কৃতিত্বের পুরোটা নিচ্ছেন সেই অসাধারণরা। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়তে গিয়ে ত্যাগী সাধারণকে সর্বদা দূরে রাখা হচ্ছে। তৎপ্রেক্ষিতেই ত্যাগহীন অসাধারণদের মানসিক প্রভাব রাষ্ট্রকে মূলত অমর একুশ ও জন্মদর্শন থেকে বিচ্যুতি করছে। রাষ্ট্রীয় কৃষ্টিকালচারের বহিরাবরণে চাকচিক্য লক্ষ্য করা গেলেও জাতীয় দায়বোধের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। মাতৃভাষার মর্যাদা বজায় রেখে এগিয়ে যেতে হলে রাষ্ট্রকে সাধারণের অনুভূতি, আবেগ, উচ্ছ¡াসকে ধারণ করতে হবে।
বায়ান্ন ও একাত্তরে আমরা যতটা বাঙালি ছিলাম, আজ তার কতটা চেতনা দর্শনে রয়েছে, তা প্রশ্নবোধক। যে মূল্যবোধ বায়ান্ন-একাত্তরে জাতিকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করেছিল, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির জন্য দুঃসাহসী করেছিল, আজ সে বোধের প্রকট অভাব। যে জাতি তার গৌরব চেনে না, সেই জাতিরাষ্ট্রের মানুষ নিজেদের মর্যাদাও উপলব্ধি করতে পারে না। এই উপলব্ধির ঘাটতিই জাতীয় জীবনের সব জঞ্জাল সৃষ্টি করছে। জাতিসত্তা বিকাশকে এগিয়ে নিতে জনগণের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নীতিগুলোকে সমুন্নত রাখা প্রয়োজন। সহনশীলতা, গ্রহণযোগ্যতা ও সমান সুযোগের পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে অমর একুশের চেতনা আরো জোরদার করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সম্প্রীতিপূর্ণ সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় জীবনে একুশের সুদূরপ্রসারি প্রভাব রয়েছে, এর বহুমাত্রিকতা জাতির বিকাশে অনিবার্য উপকরণ ও প্রাণশক্তিও বটে। বাহান্নর বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনার জাগরণ পৌঁছে দিতে পেরেছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। একুশের চেতনা শুধু তথাকথিত এলিট শ্রেণির মাঝে জাগ্রত করার চেষ্টা যথার্থ নয় বরং সার্বিক জাতীয় জাগরণের জন্য তা সাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। যতদিন এটি করা যাবে না, ততদিন জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি নড়বড়ে বা আনুষ্ঠানিকতায় ঘুরপাক খাবে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে বাংলাকে বিশ্বদরবারে নিয়ে গেছেন। তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রচেষ্টায় অমর একুশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্বের প্রতিটি দেশে পালিত হচ্ছে। বিষয়টি বাঙালির জন্য গর্বের-অহংকারের। তাই দিবসের সামগ্রিক তাৎপর্য ও ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখার স্বার্থে বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতার গণ্ডি পেরিয়ে হৃদয়ের গহিন থেকে মহান একুশ পালন করতে হবে। মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে। অন্যথায় বাঙালির জাতিসত্তা বিকশিত ও সমৃদ্ধ হবে না।

এ কে এম এ হামিদ : উন্নয়ন গবেষক ও সভাপতি, আইডিইবি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়