রেজিস্ট্রার পদ থেকে স্বেচ্ছা অব্যাহতি ওহিদুজ্জামানের : নতুন দায়িত্বে ড. আইনুল ইসলাম

আগের সংবাদ

এক্সিমে একীভূত হচ্ছে পদ্মা

পরের সংবাদ

আমার দেখা বইমেলা

প্রকাশিত: মার্চ ১৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বইমেলা শেষ হলো অতিস¤প্রতি। এবারের মেলায় আমার কয়েকটি বই প্রদর্শিত হয়েছে। দেখতে গেয়েছিলাম কেমন চলছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সুপ্রশস্ত ময়দানে বাংলা একাডেমি ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কেমনভাবে সাজিয়েছে বইমেলা। বইমেলা প্রতি বছর খুবই উৎসাহ-উদ্দীপনায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রদর্শিত হতো। গত কয়েক বছর একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে বইমেলা বের করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রশস্ত প্রাঙ্গণে আয়োজন হচ্ছে। বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থানান্তরিত করায় এই মেলার ভাবমূর্তি কি ক্ষুণ্ন হয়েছে? বেশ কয়েকজন গুণী-প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিক, জ্ঞানী, গুণীজন, বিশেষ করে মেলায় উপস্থিত বেশ কয়েকজন ক্রেতা এবং বইমেলায় স্থাপিত বিভিন্ন পুস্তক প্রকাশক স্টল মালিকের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা এক বাক্যে এই প্রশস্ত উদ্যানে এই বইমেলার প্রদর্শনীর প্রশংসা করলেন। তারা আমাকে জানান বাংলা একাডেমি সত্যিই প্রশংসাযোগ্য কাজ করেছে। দিন দিন লেখকের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমন বাড়ছে প্রকাশকের সংখ্যা, বই পড়ায় আগ্রহী ছেলেমেয়ের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া ফেব্রুয়ারির বইমেলাকে ঘিরে নানা প্রকার উৎসাহ, উদ্দীপনা আনন্দঘন পরিবেশে বই ক্রেতাদের পাশাপাশি সব বয়সি লোকের বিনোদনের ক্ষেত্র হিসেবেও সুপ্রশস্ত বইমেলা একটি মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। গুণীজনরা আমার সঙ্গে কথোপকথনে প্রশস্ত প্রাঙ্গণে বইমেলার ভূয়সী প্রশংসাও করলেন। তাদের অভিমত, বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে যে বইমেলা হতো, সেখানে বইপ্রিয় লোকসমাবেশকে ধারণ করার মতো প্রশস্ততা ছিল না। প্রকাশকরা তাদের স্টলগুলোকে ছোট আকারে করতে বাধ্য হতেন। অনেক প্রকাশক স্টল স্থাপন করার জায়গা পেতেন না। প্রায়ই এই বইমেলাকে ঘিরে নানা প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটত। এসব বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি সমন্বয়ে টিএসসির বিপরীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলা স্থানান্তরিত করায় সব মহলের সুবিধা হয়েছে। ক্রেতা সাধারণ সুপরিবেশে ঘুরে-ফিরে, দেখে-শুনে তাদের বই নির্বাচন করতে পারছেন, সঙ্গে সঙ্গে আনন্দঘন পরিবেশে পরিবার নিয়ে তাদের পছন্দের বই কিনেছেন। সব দিক দিয়ে একুশের বইমেলা বাংলা একাডেমি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থানান্তরিত করায় গুণীজন, কবি, সাহিত্যিক বইপ্রেমী ক্রেতারা সবার জন্য সুখকর হয়েছে বলে সবাই অভিমত প্রকাশ করেছেন।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপিত মেলা স্থাপনের চিন্তা, চেতনা, উদ্দেশ্য বিবেচনায় বাংলা একাডেমির ভাবমূর্তি কি ক্ষুণ্ন হয়েছে? যে উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলা একাডেমিতে একুশের বইমেলা শুরু হয়েছিল- সে উদ্দেশ্য থাকলে কি কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে বা বিঘœ হয়েছে? হয়নি! বরং সে উদ্দেশ্য এবং কর্মসূচি নতুন প্রজন্মের মধ্যে উৎসাহ, উদ্দীপনা, বই কেনা বা পড়ার আগ্রহ দেশপ্রেমের প্রেরণার উৎস হিসেবে সব মহলের কাছে সমাদৃত হচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে এই বইমেলা সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। ১৯৮৯ সালে এই বইমেলা বাংলা একাডেমি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিস্তৃত করার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন তদানীন্তন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, সচিব এবং কর্মকর্তারা। বাংলা একাডেমির ডিজি, পরিচালকবৃন্দ এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে মন্ত্রণালয় এই বইমেলা স্থানান্তরিত করার বিষয় নিয়ে একটি মিটিংও করেছিলেন এবং রাষ্ট্রপতির অনুমতির জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন।
এ প্রস্তাবের কথা প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু কবি, সাহিত্যিক, লেখক এবং রাজনীতিবিদ এই প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাদের বিবৃতিতে উল্লেখ করেছিলেন- স্বৈরাচার সরকার, ভাষা আন্দোলনের চিন্তা-চেতনা ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য ঐতিহ্যবাহী বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের বইমেলাকে ধ্বংস করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রাঙ্গণে স্থানান্তরিত করার উদ্যেগ নিয়েছে। একুশের চিন্তা-চেতনাকে নস্যাৎ করার জন্য এবং বাংলা একাডেমির ভাবমূর্তিকে নষ্ট করার অপচেষ্টায় স্বৈরাচার সরকার এহেন প্রস্তাব নিয়েছে। আমি সেসব নন্দিত, প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিকদের নাম উল্লেখ করতে চাই না। ইতোমধ্যে তাদের অনেকেই আর নেই। যারা বর্তমানে এখনো জীবিত আছেন তাদের অনেকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তাদের অভিমতও আমি নিয়েছি। বলতে দ্বিধা নেই তাদের প্রায় সবাই এখন বর্তমান বইমেলার প্রাঙ্গণকে সমর্থন করেছেন এবং বলছেন ১৯৮৯ সালে তদানীন্তন সরকার যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল, তা সঠিক ছিল। বর্তমান বইমেলার প্রশস্ত প্রাঙ্গণ এবং কোনো প্রকার ঠেলাঠেলি না থাকায় সুস্থিরভাবে আনন্দঘন পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৬২ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানি শাসক আইয়ুববিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থ্যান, ১৯৭০-এর নির্বাচন। ১৯৭১ সালের মার্শাল ল অধিপতি ইয়াহিয়া খানের পিশাচীয় গণহত্যা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র যুদ্ধ ৩০ লাখ শহীদের এক নদী রক্তের বিনিময়ে এবং ২ লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম গৌরবোজ্জ্বল ‘বাংলাদেশ’ অর্জন সঙ্গে সঙ্গে যে ভাষার জন্য এত বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সেই ‘বাংলা ভাষাকে’ পৃথিবীর মানচিত্রে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা- এসব অর্জন কোনোটাই স্বাভাবিকভাবে আসেনি।
বর্ষপরিক্রমায় ফেব্রুয়ারি মাস আসবেই। এই মাসটি বাংলাদেশের জনগণ এবং বহির্বিশ্বে বসবাসকারী বাঙালিদের জন্য একটি বিশেষ মাত্রা নিয়ে আসে। একটি অদ্ভুত উপলব্ধি এবং অনুভূতি সমগ্র জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেয় দুঃসহ এবং বিভীষিকাময় ১৯৫২ সালের সেই দিনগুলোর কথা, ব্রিটিশ দুঃশাসনের হাত থেকে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান দুটি পৃথক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলো। পাকিস্তান হলো দুভাগে বিভক্ত। পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান। দুটি ভাগের দূরত্ব প্রায় ২৫০০ কিলোমিটার। ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষি, ধর্মীয় অনুভূতি, আচার-আচরণ, পরিবেশ, পরিস্থিতি ভৌগোলিক অবস্থান, সামাজিক রীতিনীতি সবই পৃথক হওয়া সত্ত্বেও দুদেশের সমন্বয়ে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি করা হলো। এই পৃথক অবস্থানের ওপরে সব থেকে বড় পার্থক্য দেয়া গেল- পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং অর্থনৈতিক প্রাধান্যতা। সব রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হতো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। পাকিস্তানের রাজধানী করাচি হওয়াতে তাদের প্রাধান্য প্রতিপত্তির মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেল। পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য ছাড়িয়ে গেল। পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য পূর্ব পাকিস্তানের ওপর অতিরিক্ত মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করার কারণে দুটি পৃথক প্রদেশের মধ্যে বৈষম্য দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানতম সম্পদগুলো, বিশেষ করে পাট সম্পদের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের সমৃদ্ধি এবং উন্নয়নের জন্য ব্যবহারিত হতে থাকল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি হতে থাকল। পূর্ব পাকিস্তান দিন দিন অধিকার বঞ্চিত হতে থাকল। এই সফল বৈষম্যের ওপর খাঁড়ার ঘা পড়ল যখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা দিলেন উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাগ্রত ছাত্র সমাজ এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা বিশেষ করে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, সর্বোপরি ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান জিন্নাহ সাহেবের এই ঘোষণাতে তীব্র ভাষায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতারা যখন পাকিস্তান অধিপতিদের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন এবং প্রকাশ্যে প্রতিবাদের ঝড় তুললেন সমগ্র দেশবাসী তাদের এই ন্যায্য আন্দোলনে সাড়া দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার আন্দোলন গড়ে তুলল। ছাত্র মিছিলে পাকিস্তানি শাসক চক্র নির্দ্বিধায় গুলিবর্ষণ করল। ছাত্ররা প্রাণ দিল। আন্দোলনের নতুন মাত্রা যোগ হলো। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল ছাত্র-জনতার আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ভাষাশহীদের স্মরণে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এই আন্দোলন অজপাড়াগাঁ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। আমি তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়তাম। তালা হাই স্কুলের ছাত্র। ছাত্রদের মিছিলে আমি অগ্রণী ভূমিকা রাখার জন্য গ্রেপ্তার হই। দেশের ওই অনুন্নত জনপদেও আন্দোলনের তীব্রতা ছড়িয়ে পড়েছিল। এই ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতেই বইমেলার অভূতপূর্ব প্রসার ঘটেছে বলেই বাংলা একাডেমির এই স্বল্প পরিসরে প্রকাশক, লেখক, ক্রেতা সাধারণ বিশেষ করে ছাত্র সমাজের মধ্যে বইমেলার প্রাঙ্গণ বিস্তৃতির চাহিদা দেখা দেয়। তারই কারণে ১৯৮৯ সালে এই মেলাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এই উদ্যোগকে বিকৃতভাবে কতিপয় কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ জনসমক্ষে উপস্থাপন করেছিলেন। পরিশেষে আমি শুধু বলতে চাই, আমাদের বুদ্ধিজীবী মহল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এই বিজ্ঞজন সমৃদ্ধ বুদ্ধিজীবী মহল দেশ ও জাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথ প্রদর্শকের ভূমিকা রাখবেন- এই বিশ্বাস আমার, আমাদের সবার, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে বিস্তৃত হোক- এই শুভ কামনা রইল। বইমেলা যুগ যুগ জিও।

সৈয়দ দীদার বখত : কলাম লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়