মির্জা আব্বাস : আন্দোলন চলবে সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত

আগের সংবাদ

রমজানে ভোগাবে তিন সমস্যা

পরের সংবাদ

জগন্নাথের ঘাটে ঘাটে হরিলুট

প্রকাশিত: মার্চ ১১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য ও রকি আহমেদ : প্রতিষ্ঠার এখনো ২০ বছর পার হয়নি। এরই মধ্যে ঘাটে ঘাটে টাকা মারার ধান্দা পোক্ত হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক তদন্ত রিপোর্টে রাজধানী ঢাকার বুকে প্রতিষ্ঠিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস এবং ২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেট পর্যালোচনায় এমন লুটপাটের চিত্র বেরিয়ে এসেছে।
তদন্ত রিপোর্ট ঘেঁটে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের গ্রেড কেলেঙ্কারি, অতিরিক্ত হারে দায়িত্বভাতা নেয়া, একই প্রশিক্ষণে একই ব্যক্তির দুই বার সম্মানি নেয়া, বেশি টাকা দিয়ে বই কেনা, অনুমোদন ছাড়া ১৩টি গাড়ি কেনা, গণহারে টাকার বিনিময়ে চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ উল্লেখযোগ্য। এগুলো ছাড়াও ইউজিসি জগন্নাথ বিশবিদ্যালয়ে মোট ২৫টি খাতে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. হাসিনা খান ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা এ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করেছি। আমাদের পর্যায় থেকে যা করা দরকার তাই করব। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম ভোরের কাগজকে বলেন, আমি মাত্র যোগ দিয়েছি। তবু ইউজিসির কোনো বিষয়ে আপত্তি থাকলে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব। নিয়মের বাইরে আমার প্রশাসনে কিছু হবে না- এটা বলতে পারি।
রেজিস্ট্রারের গ্রেড কেলেঙ্কারি : ২০০৯ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার নিয়োগ পান প্রকৌশলী মো. ওহিদুজ্জামান। যোগদান করে ওই বছরেই সিলেকশন গ্রেড হিসেবে জাতীয় বেতন স্কেলের ২য় গ্রেড বাগিয়ে নেন। ইউজিসি বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে ২য় গ্রেডে বেতন দেয়ায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। জাতীয় বেতনস্কেল অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসিত কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মচারি সর্বোচ্চ ৩য় গ্রেডে বেতন পাওয়ার কথা। জাতীয় বেতনস্কেল অনুযায়ী বেতন পুনঃনির্ধারণ করে যে পরিমাণ বেশি টাকা নেয়া হয়েছে তা ফেরত দিতে বলা হয়েছে রেজিস্ট্রারকে।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রারসহ তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম করে চাকরি পান মো. ওহিদুজ্জামান। সরকারি বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম ৪ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকার কথা থাকলেও কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই ১৯৯৪ সালের ২৮ জুলাই বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক পদে সরাসরি ৭ম গ্রেডে নিয়োগ পান ওহিদুজ্জামান। পরবর্তী সময় ২০০৫ সালের ৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ১০ বছর ৬ মাসের চাকরির অভিজ্ঞতায় রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পান। জাতীয় বেতনস্কেল অনুযায়ী রেজিস্ট্রার হতে গেলে সর্বনি¤œ ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা থাকার নিয়ম রয়েছে। এরপর অতি কম সময়ে ২০০৯ সালের ১৫ অক্টোবর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ পান মো. ওহিদুজ্জামান। এছাড়া তার বিরুদ্ধে একই অর্থবছরে একাধিক সম্মানি নেয়া, বাছাইবোর্ডে না থেকেও টাকা নেয়া, নিয়ম না মেনে ঋণ নেয়া এবং বদলি-পদোন্নতিতে ঘুষ নেয়াসহ নানা অভিযোগ উঠে এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. ওহিদুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, আমি জোর করে ২য় গ্রেড নিইনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাকে দিয়েছে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও একজন কর্মকর্তার নেয়ার নজির আছে। ইউজিসির আপত্তির বিষয়ে আমি জবাব দেব।
ঘাটে ঘাটে অনিয়ম করে সম্মানি ভাতা : ইউজিসি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বড় আর্থিক অনিয়মের চিত্র পেয়েছে সম্মানির ক্ষেত্রে। তারা তিনটি অভিযোগ করেছে। এর মধ্যে অতিরিক্ত হারে দায়িত্ব ভাতা নেয়ায় সরকারি বিধি লঙ্ঘন ও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউজিসি বলছে, সরকারি বিধি অনুযায়ী অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ১টি দায়িত্বের জন্য বেসিক এর ১০ শতাংশহারে সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা হারে ভাতা নিতে পারেন। কিন্তু এখানে

ইচ্ছেমতো সম্মানিভাতা নেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত নেয়া টাকা দায়ি ব্যক্তিদের কাছ থেকে আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে জমা করে কমিশনকে জানাতে বলা হয়েছে। এছাড়া উপাচার্য দপ্তর ও রেজিস্ট্রার দপ্তরের একাডেমিক কাউন্সিল ও ব্যক্তিগত শাখার কর্মকর্তাদের নিয়ম বহির্ভূতভাবে সম্মানি দেয়ায় অন্তত চারটি ভাউচার নম্বর তুলে ধরে অনিয়ম হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে একই প্রশিক্ষণে একই ব্যক্তিকে অতিথি ও অংশগ্রহণকারী হিসেবে দেখিয়েও উভয় ক্ষেত্রে সম্মানি মেরে দেয়া হয়েছে। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এভাবে লাখ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।
বই কিনতে শিক্ষকদের বেশি টাকা দেয়া : বই ভাতা বাবদ প্রত্যেক শিক্ষককে প্রতি বছর বারোশ টাকা দেয়া সরকারি নিয়ম। কিন্তু এক্ষেত্রে কোথাও ৩ হাজার, আবার কোথাও বেশি দিয়ে বই কেনা হয়েছে। এমন পদ্ধতিতে বই কিনতেই বেশি খরচ হয়েছে ৯ লাখ টাকার বেশি। এসব টাকা দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে ফিরিয়ে দিতে বলা হয়েছে। তবে শিক্ষক নেতারা বলছেন বই কেনার জন্য এ টাকা পর্যাপ্ত নয়।
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন বলেন, বই কেনার জন্য যখন ১২শ টাকা চালু হয়েছিল; তখন একজন প্রভাষক সেই পরিমাণ বেতন পেতেন। বছর বছর এই ধারাই চলে আসছে। বর্তমান সময়ের জন্য এটি খুবই অপ্রতুল। ইউজিসিসহ সরকারের উচিত শিক্ষকদের বই কেনা বাবদ টাকা বাড়িয়ে দেয়া।
তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব শিক্ষক অবসরে গেছেন তাদের পেনশনের সময় বই কেনার এ অতিরিক্ত টাকা অডিট আপত্তিসহ কেটে নেয়া হয়। অতিরিক্ত টাকা নিয়ে অবসরের সময় উল্টো বিপদে পড়েন শিক্ষকরা।
অনুমোদন ছাড়াই ১৩টি গাড়ি কেনা : ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের ইউজিসি এর প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়াই ২টি মাইক্রোবাস ও ১১টি বাস কিনতে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি। এতে ৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া গাড়ি তদারকির জন্য ড্রাইভার ও হেল্পারদের ভাতা দানেও ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। শুধু গাড়ি তদারকির নামে এক অর্থবছরে প্রায় ৮ লাখ টাকার অনিয়ম হয়েছে।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অবৈধ : ড্রাইভার, বাস হেল্পারের মতো কর্মীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রেও দেদারছে টাকা নেয়া হয়েছে। লঙ্ঘন করা হয়েছে নিয়ম। ইউজিসি বলেছে, সরকারি ও কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সুযোগ নেই। বাজেট বরাদ্দ অব্যাহত রাখতে চাইলে এমন নিয়োগ বাদ দিতে হবে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবীর চৌধুরী বলেন, আগে কি হয়েছে এগুলোর কথা বলতে চাই না। তবে আমি ও আমাদের ভিসি মহোদয় বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব নেয়ার পর কোনো সম্মানি নিইনি। নিয়মনীতির মধ্যেই সব কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। ইউজিসির যে আপত্তি আছে সে বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নেব।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়