বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জাবি উপাচার্যের শোক প্রকাশ

আগের সংবাদ

অগ্নিকাণ্ডের দায় সাত সংস্থার : দায়ী কর্মকর্তা ও ভবন মালিককে আসামি করতে হবে, টাস্কফোর্সে বিশেষজ্ঞদের রাখার সুপারিশ

পরের সংবাদ

অনুমোদনহীন রেস্তোরাঁই বেশি : ঢাকায় রেস্টুরেন্ট ২৫ হাজারের বেশি, ট্রেড লাইসেন্স মাত্র ২৮শর

প্রকাশিত: মার্চ ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মুহাম্মদ রুহুল আমিন : ছোট-বড় মিলে ঢাকায় এখন রেস্তোরাঁর সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি। দুই সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছে এরকম রেস্তোরা রয়েছে ২ হাজার ৮শর বেশি। রুফটপে রেস্তোরাঁ আছে ৮০ থেকে ১০০টির মতো; যেগুলো অত্যন্ত সুসজ্জিত ও ব্যয়রহুল। সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব রাজউকের নকশা দেখে রেস্তোরাঁর লাইসেন্স দেয়া। অনেক ক্ষেত্রেই সেটা করা হয় না। রুফটপে যেসব রেস্তোরাঁ আছে সেগুলোর কোনো অনুমোদনই নেই। রাজউকের নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের লাইসেন্স নিয়ে করা রেস্তোরাঁগুলোরও অধিকাংশ অনুমোদিত ও ঝুঁকিপূূর্ণ। রাজউকের অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়েই করা হয়েছে এসব রেস্তোরাঁ। রাজধানীর বেইলি রোডের একটি ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের প্রাণহানির পর নড়েচড়ে বসেছে রাজউক। টনক নড়েছে পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় চলছে অভিযানও। রাজউকও ধানমন্ডির কয়েকটি রেস্তোরাঁ সিলগালা করেছে। এই অভিযান চলমান থাকবে। নগরবিদরা বলছেন, রুফটপে যেসব রেস্তোরাঁ করা হয়েছে, সেগুলো সব অবৈধ। দ্রুত খালি করা উচিত। কারণ ছাদে কোনো রেস্তোরাঁ থাকতে পারে না। অন্যদিকে রাজউক বলছে, নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে যেসব রেস্তোরাঁ করা হয়েছে , সেগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় মোবাইল কোর্ট চালানো হবে। রেস্তোরাঁর সামনে ঝুঁকিপূর্ণ লেখা সাইনবোর্ড লাগানো হবে। গুগল ম্যাপেও তা সংযুক্ত করা হবে। যাতে মানুষ সচেতন হয়। অননুমোদিত রেস্তোরাঁ চিহ্নিত করতে নীতিমালা করে একটি তৃতীয় পক্ষকে দায়িত্ব দেয়া হবে।
জানা গেছে, রাজধানীর সাত মসজিদ রোড, গুলশান অ্যাভিনিউ, বেইলি রোড, খিলগাঁও, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকার প্রধান সড়কগুলোতে আবাসিক কাম বাণিজ্যিক এবং বাণিজ্যিক ভবনে ব্যাঙের ছাতার মতো রেস্তোরাঁ ব্যবসা গড়ে উঠেছে। এসব রেস্তেরাঁ শুরুর আগে ভবন ব্যবহারের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অকুপেন্সি বা ব্যবহার উপযোগী সনদ নেয়নি ভবন মালিকরা। অধিকাংশ ভবনেই অকুপেন্সি সনদ নেই। অথচ হোটেল ও রেস্তোরাঁ বিধিমালা ২০১৬ অনুযায়ী হোটেল ও রেস্তোরাঁ নিবন্ধনের শর্তেই বলা আছে, নিবন্ধন পেতে হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ভবন নির্মাণের অনুমোদন ও শর্ত পূরণ করতে হবে। শুধু তাই নয়; ভবনের পূর্ণাঙ্গ কাঠামোগত প্ল্যান জমা দিয়ে নিবন্ধন নিতে হয় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে। এছাড়া সিটি করপোরেশনকে ব্যবসায়িক সনদ বা ট্রেড লাইসেন্স পেতে হলেও ভবন ব্যবহার অকুপেন্সি ও ভবন সরবরাহকৃত সব সেবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন দরকার হয়। কিন্তু রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে ইচ্ছামতো রেস্তোরাঁ ব্যবসা চলছে। ট্রেড লাইসেন্স, ফায়ার সেফটি সনদ, জেলা প্রশাসকের অনুমোদন, বিস্ফোরক দপ্তরের অনুমোদন, তিতাস গ্যাস ও বিদ্যুতের অনুমোদন থাকলেও নেই রাজউকের অকুপেন্সি সনদ। যে সনদ দিয়ে ভবনের ব্যবহার সম্পর্কে জানা যাবে সেটিই অনুপস্থিত।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান ভোরের কাগজকে বলেন, যেসব রেস্তোরাঁর বৈধতা আছে, সেগুলো

বৈধ থাকবে। আর যেসব রেস্তোরাঁর কোনো অনুমোদন নেই; সেগুলোর বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতিতে থাকতে হবে। কারণ কোনো অবৈধ জিনিসের বৈধতা থাকতে পারে না। কিন্তু মূল সংকটটা হলো ঢাকায় অবৈধ রেস্তোরাঁর সংখ্যাটা অনেক বেশি, এটা বড় শঙ্কার জায়গা। তিনি বলেন, অধিকাংশ ভবনে বাণিজ্যিক নাম দিয়ে এসব রেস্তোরাঁ করে ফেলছে। এক্ষেত্রে একটা ক্যাটাগরি করা উচিত। যেগুলো অতি ঝুঁকিপূর্ণ, সেগুলোকে অবশ্যই অপসারণ করতে হবে। রুফটপে যেগুলো আছে সেগুলোও অপসারণ করা উচিত। যেসব রেস্তোরাঁ ন্যূনতম নিয়ম মেনে হয়েছে, সেগুলোকে একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া উচিত- এই সময়ের মধ্যে তাদের বিধিমালা মেনে শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু যেসব রেস্তোরার অনুমোদন নেই, নকশার ব্যত্যয় আছে, সেখানে চোখবুজে থাকার কোনো সুযোগ নেই। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী সেটার উচ্ছেদ করতে হবে। সবচেয়ে বেশি জরুরি- অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে গতকাল ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের গাউসিয়া টুইন পিক ভবনে অভিযান চালিয়েছে রাজউক। ওই ভবনের রুফটপে করা রেস্তোরাঁটি ভেঙে ফেলে সংস্থাটি। সেই সঙ্গে ওই ভবনের সব রেস্তোরাঁ সিলগালা করা হয়েছে। রাজউকসহ বিভিন্ন সংস্থার অভিযানের ফলে ওই এলাকার সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ রেখেছে মালিকপক্ষ। এর আগের দিন রবিবার সন্ধ্যা থেকেই রাজধানীর উত্তরা এলাকার রেস্টুরেন্টগুলোতে অভিযান চালায় পুলিশ। শনিবার ঢাকা মহানগর পুলিশ রাজধানীর অননুমোদিত রেস্টুরেন্ট ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পাশাপাশি আইনি ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়। গতকাল সোমবারও বিভিন্ন এলাকায় এ অভিযান চলে। এরপর দুইদিনের বেশকয়েকটি রেস্তোরাঁ মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তারও হয়েছে বেশ কয়েকজন।
রাজউকের মুখপাত্র ও প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, ঢাকায় প্রায় ৭৭ ভাগ ভবনে নকশার সঠিক ব্যবহার না করে বিভিন্ন ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান বা দোকান, রেস্তোরাঁ করা হয়েছে। এখন সব ভবন যদি অবৈধ করা হয়, তাহলে ঢাকার অর্থনৈতিক চাকা অচল হয়ে পড়বে। বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। এসব মানুষের কথাও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। সেজন্য আমরা বলেছি, যেসব নকশার ব্যত্যয় হয়েছে, তাদেরকে নকশা সংশোধনের সুযোগ দেয়া হবে। তিনি বলেন, বিশ্বের বহু দেশে ১শ তলা ভবনেও রেস্তোরাঁ আছে। সেখানে কিচেন সেভাবেই ডিজাইন করা থাকে। অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা থাকে। আমাদের দেশেও সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ফায়ার এলার্ম থাকতে হবে। যেন অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফায়ার এলার্ম বেজে উঠবে। মানুষ দ্রুত নিরাপদে বের হতে পারবে। সুনির্দিষ্ট ফায়ার এক্সিট থাকতে হবে। যার মাধ্যমে মানুষ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হবে না, সহজে আগুনে পুড়ে যাবে না। ফায়ার এক্সিটের মাধ্যমে যেন মানুষ তার নিরাপদ জায়গায় যেতে পারে। ফায়ার সেফটির এসব প্রোটোকল বাধ্যতামূলক করা উচিত।
রাজউকসূত্রে জানা যায়, যেসব রেস্তোরা অতি ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রায় রয়েছে, সেগুলোর ট্রেড লাইসেন্স বা অন্যান্য সেবা সংযোগ বাতিলের চিঠি দেবে রাজউক। যেন তাদের লিগ্যাল কোনো বিষয় থাকে না। এরপরও যদি তারা ব্যবসার ধরন পরিবর্তন না করে- রাজউক সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালাবে। তবে বর্তমানে অভিযান চালিয়ে অতি ঝুঁকিপূর্ণলোকে আর্থিক জরিমানাসহ সিলগালা করা হচ্ছে।
যেসব রেস্তোরাঁ নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেবেন- জবাবে রাজউকের মূখপাত্র বলেন, আমরা একটা এক্সিসটিং ইনভেস্টরি তৈরি করছি। রেস্তোরাঁ পরিচালনা করতে হলে সেখানে কি কি ঘাটতি আছে। কী ধরনের ফায়ার সেফটি প্রটোকল মানতে হবে। সেজন্য এক থেকে দেড় মাসের একটা সময় নির্ধারণ করে দেয়া হবে। এর মধ্যে যদি এটা নিশ্চিত করতে না পারে, সেখানে অবশ্যই উচ্ছেদ পরিচালনা করা হবে। তবে সবক্ষেত্রেই নকশা সংশোধনের সুযোগ থাকবে না। বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে সংশোধনের সুযোগ দেয়া হবে। আবাসিক এলাকায় সেই সুযোগটা দেয়া হবে না।
এদিকে ঢাকায় ভবন নির্মাণের তদারকিতে থার্ড পার্টি নিয়োগ দেবে রাজউক। এ বিষয়ে একটি নীতিমালা চূড়ান্ত মতামত নেবে সংস্থাটি। এজন্য গাইডলাইন তৈরি করতে সময় দেয়া হয়েছে আগামী ১০ কার্যদিবস। এই থার্ড পার্টি ভবনের ফিটনেস যাছাই করে প্রতিবেদন দেবে। এছাড়া ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সামনে বড় করে ব্যানারে নোটিস দেয়া হবে। এমনকি গুগল ম্যাপেও তা ট্যাগ করে দেয়া হবে। নতুন ভবনগুলোতে রাজউকের অকুপেন্সি সনদ না থাকলে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ এবং ট্রেড লাইনেন্স না দেয়ার জন্য চিঠি দেয়া হবে।
এ বিষয়ে রাজউকের চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, অকুপেন্সি সনদ ছাড়া কোনো ভবন ব্যবহার করতে পারবে না। আমরা সেবা সংস্থাগুলোকে চিঠি দেব গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার আগে এবং ট্রেড লাইসেন্স দেয়ার আগে অবশ্যই অকুপেন্সি সনদ যাচাই করে দিতে হবে। আমরা কোনো ছাড় দিচ্ছি না। বেইলি রোডের ঘটনার পর আরো তৎপরতা চালানো হচ্ছে। আমাদের টিম ভিজিট করবে- যেখানে যেখানে মনে হবে ব্যত্যয় ঘটেছে; সেখানে সব যাচাই বাছাই করে সেবা সংস্থাগুলোকে বলব তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়