ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের শেকড় অনেক গভীরে : কলকাতায় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী

আগের সংবাদ

সমন্বয় নেই ভবন তদারকিতে : আইনের ফাঁক গলে হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন > রাজউকের নকশা মেনেই সেবা সংযোগ দেয়ার পরামর্শ

পরের সংবাদ

বেঙ্গলিজমের লাল উৎস, লীগের আত্মসমর্পণ

প্রকাশিত: মার্চ ২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রাগিব আহসানের উদ্ভট বেঙ্গলিজম তত্ত্ব পাকিস্তানি শাসক ও তাদের পূর্বাঞ্চলীয় তাবেদারদের কাছে বেশ গ্রহণীয় ছিল। এই শিরোনামের লীগ মানে মুসলিম লীগ। এই দল তার ভাষায় বেঙ্গলিজমের সামনে হাঁটু গেড়ে আত্মসমর্পণ করেছে। তার রচনার ঈষৎ সংক্ষিপ্ত অনুসৃতি উপস্থাপিত হলো; অবশ্য পরবর্তীকালে মুসলিম লীগ সম্পর্কে তার মূল্যায়ন অনেকটাই যথার্থ প্রমাণিত হয়েছে।
মুসলিম লীগ সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। কোথাও মুসলিম লীগের কোনো নিশানা নেই (স্মরণীয় এই রচনাটি ১৯৫৪-এর নির্বাচনের বেশ আগেকার, ৮ মার্চ ১৯৫২ প্রকাশিত- অন্তত মুসলিম লীগের পরিণতির স্পষ্ট ইঙ্গিত এতে রয়েছে)। জনসমক্ষে বেরোবার কোনো সাহস লীগ নেতাদের কারোই নেই। পূর্ব বাংলা লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সভায় ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ মুসলিম লীগ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীন নিজেই প্রস্তাব করেন এবং সে প্রস্তাব পাস হয় যে বাংলা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার একটি। বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জন্য সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের কাছে লীগ সরকারের নির্লজ্জ আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটেছে। আর আত্মসমর্পণের ঘটনাটি ঘটেছে সন্ত্রাসী আন্দোলন ও অরাজকতা সৃষ্টির ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই; ১৯৪৮-এর মার্চে ‘কায়েদে আজম’ এক রাষ্ট্র এক ভাষার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তা খণ্ডন করা হলো। ২৮ জানুয়ারি ১৯৫২ প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন ঢাকায় যে রাজনৈতিক প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন সেখান থেকে পুরো উল্টোপথে ঘুরে একটি অ্যান্টি ক্লাইমেক্স সৃষ্টি করলেন। এর মানে মুসলিম লীগের নৈতিক মৃত্যু ছাড়া আর কিছু নয়। পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ তার অস্তিত্বের নৈতিক, যৌক্তিক ও রাজনৈতিক ভিত্তিকে এভাবেই ধ্বংস করে দিল।

সরকারের আত্মসমর্পণ বিক্ষোভকারীদের শক্তি জোগাবে
সরকারের এই আত্মসমর্পণ বিক্ষোভকারীদের সাহসী করে তুলবে কারণ তারা সহজে এবং প্রত্যাশার অনেক আগেই বিজয় লাভ করেছে। তারা এখন ধরে নিয়েছে প্রথম রাউন্ডে ভাষাযুদ্ধে জয়লাভ করেছে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাউন্ডে রাজনৈতিক যুদ্ধে অবশ্যই জিতে গিয়ে সন্ত্রাস, জনসহিংসতা, হরতাল ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারকে উৎখাত করবে। আর সেই লক্ষ্যে এখন সৌভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করে ‘বাঙালি হিন্দু বাঙালি মুসলমান ভাই ভাই’ জিকির তুলে একটি বাঙালি জাতি সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে। আর এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তারা মোহাজিরদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে শুরু করেছে। পানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সরবরাহ বন্ধ করে দিচ্ছে, তাদের দোকান ও বাড়িতে আক্রমণ চালাচ্ছে, তাদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। এ ধরনের বহু ঘটনা ঘটে চলেছে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ-জাতির পিতার ছবিতে আগুন দিয়েছে, তাতে থুতু নিক্ষেপ করেছে আর ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে এ ছবি পায়ে মাড়িয়েছে। হিন্দু ও মুসলমান বাঙালিরা সেøাগান তুলেছে ‘পাকিস্তান ধ্বংস হোক’। কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রকাশ্য দাবি জানাচ্ছে। ‘জয় হিন্দ’ ধ্বনিও শোনা গেছে। রেল, সড়ক ও যোগাযোগব্যবস্থায় নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড সৃষ্টির আয়োজন করা হয়েছে; এসব আন্দোলনে হিন্দুরাই নেতৃত্ব দিচ্ছে। তারা লাখ লাখ টাকা চাঁদা তুলে আন্দোলনের ব্যয় নির্বাহ করছে। অস্ত্র ও বোমা তৈরি করা হচ্ছে এবং তা বিক্ষোভকারীদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে।
২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ হিন্দুরা যখন নারায়ণগঞ্জে দাঙ্গা সৃষ্টি করল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কে ফতুল্লা থেকে চাষাঢ়া পর্যন্ত চারটি ভিন্ন স্থানে সম্পূর্ণভাবে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হলো। মিছিলের সবাই ছিল হিন্দু, তারা পূর্ত বিভাগের গাছ রাস্তায় ফেলে জয় হিন্দ সেøাগান দিতে থাকে। লাখ লাখ জ¦ালাময়ী মন্তব্যের লিফলেট মুদ্রণ করা হয়। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে সংগঠকদের নিজেদের বাস-ট্রাক রাস্তায় নামে। ভারত থেকে হাজার হাজার লাল (কমিউনিস্ট) এবং আরএসএস এজেন্ট পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করে। কলকাতার পত্রপত্রিকা ও হিন্দু দলগুলো এখানকার আন্দোলনকারীদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করে, এখানকার সিদ্ধান্তের প্রতিও তারা একমত পোষণ করে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বন্দর এবং কলকাতায় সেøাগান উঠে ‘দুই বাংলা এক হোক’। দেয়ালে ও রাস্তায় বাংলায় লেখা হয় দুই বাংলা অবশ্যই এক হতে হবে।
এই ভয়ংকর বিভ্রান্তিমূলক আন্দোলনকে অস্বীকার করা বা প্রলেপন লাগিয়ে প্রকাশ করা একটি ভয়ংকর কাজ হবে। বিভ্রান্ত তরুণদের বুঝতে হবে তারা কেবল রাজনৈতিক পরিকল্পনাকারীদের হাতিয়ার। তাদের ভয়ংকর ও বিস্ফোরক রাজনৈতিক খেলায় কাঁচামাল মাত্র- তাদের খেলার উদ্দেশ্য ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা বলে পাকিস্তানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি ও বিস্ফোরণ ঘটানো। রাজনীতিবিদরা তাদের মনে আবেগ ও আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চলেছে বলে বাংলা ভাষা বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছে এবং অজানা উর্দু এসে বাংলাকে বহিষ্কার করতে যাচ্ছে।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রæদের ভিত্তিহীন মিথ্যে ও সহিংস প্রচারণা তাদের অন্তরে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী বাধা সৃষ্টিকারী ও রাষ্ট্রবিরোধীদের সমর্থন দেয়ার মতো আত্মঘাতী কাজ করছে আওয়ামী লীগ। এই দল যদি বাস্তবিক অর্থে মুসলমান গণতান্ত্রিক দল গঠন করে সুস্থ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ইসলামিক নীতিমালার ওপর কাজ করে যেত তাহলে তাদের পক্ষে গণসমর্থন আসত এবং তারা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য দেশপ্রেমিক সাংবিধানিক বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারত। কিন্তু উদ্ভূত সংকট থেকে প্রমাণিত হয়েছে মুসলিম লীগ ও আওয়ামী লীগ উভয়ই সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

লাভ-লোকসানের ব্যালেন্সশিট
জনগণের রায় হচ্ছে সংকটের জন্য প্রধানত মুসলিম লীগই দায়ী। ২৮ জানুয়ারি ১৯৫২ সালে খাজা শাহাবুদ্দিন সবার আগে বিতর্কটি সৃষ্টি করেন। যখন এর বিরুদ্ধে চিৎকার উঠল, মাত্র ৫ দিনের মাথায় ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ঘোষিত প্রস্তাবনা থেকে দ্রুত সরে গেলেন। প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকার অকারণে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করল, বাঙালি ছাত্রদের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করল। আর ২১ ফেব্রুয়ারি গুলি করল, ছাত্র হত্যা করল এবং বিদ্রোহ সৃষ্টি করার মতো বিস্ফোরণ¥ুখ পর্যায়ে তাদের ঠেলে দিল। তারা বিদ্রোহী হয়ে প্রদেশের কেন্দ্রকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও অচল শহরে পরিণত করল। হাজার হাজার মানুষ ভাষা বিতর্ক নিয়ে যাদের কোনো কথাই নেই তারা দুঃখ পেল, স্বাভাবিক সহানুভূতির কারণে ছাত্রদের দিকে ভিড়ল। মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মুসলিম লীগ সম্পূর্ণ ডিগবাজি দিল। যাদের তারা সংহতি বিনষ্টকারী বলেছে তাদের সেøাগানটিকে নিজেদের করে নিল। মুসলিম লীগ আর মুসলিম লীগ থাকল না। মুসলিম লীগ আর আওয়ামী লীগ বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় নামল।
সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো প্রকৃত মুসলমান নিজেদের মধ্যে গণযুদ্ধ সমর্থন করতে পারে না। শত্রæর এজেন্ট ও কমিউনিস্টরা সরকারি কর্মচারী, পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনীকে সন্ত্রাস, সহিংসতা, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও নৈরাজ্যের মুখোমুখি করে সম্প্রদায়গত বিরোধ ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, গণউন্মত্ততা বিদ্রোহ ও বিপ্লবের উসকানি দিতে থাকল। সব মুসলমানের উচিত তাদের এই কর্মকাণ্ডকে ইসলাম ও রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে নিন্দা জানানো। তবে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে মুসলিম লীগ সরকারই পূর্ব পাকিস্তানে বিস্ফোরক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এবং ডিগবাজি খেয়ে নিজেরাই বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হয়ে উঠেছে। মুসলিম লীগ চেয়েছিল আওয়ামী লীগের বেঙ্গলিজমের পালে ফুৎকার দিয়ে এই দলকে ক্ষমতার লড়াই থেকে অপসারণ করবে- কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে তারা এখানকার সৎ মানুষদের আস্থা হারিয়েছে এবং নৈতিকভাবে আত্মহত্যা করেছে। তারা স্বাধীনতা পরবর্তীকালের ‘মিল্লাত-ই-ইসলামিয়া’র অখণ্ডতা রক্ষা করা এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংহতি এবং ইসলামিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা করা এবং ইসলামি জীবন ধারার বিকাশ লাভকে হেয় প্রতিপন্ন করেছে।
মুসলিম লীগের লাভ-ক্ষতির খতিয়ান
১. মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলার সবচেয়ে ঘৃণিত ও পরিত্যক্ত রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। জনপ্রিয় সংগঠন হিসেবে এই পার্টির অস্তিত্ব ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। যে মুহূর্তে মুসলিম লীগ ক্ষমতাচ্যুত হবে দলটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
২. মুসলিম লীগের সংসদীয় দল এবং মুসলিম লীগ মন্ত্রণালয় লীগ, আদর্শহীন, বিশ্বাসহীন সুবিধাবাদী ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত, তারা কায়েদ-ই-আজমের প্রতি কেবলমাত্র আনুগত্যের লিপ সার্ভিস প্রদান করে এসেছে। নিজেদের স্বার্থরক্ষা করার জন্য ব্যক্তিগত জীবনে এবং জনজীবনে পাকিস্তান ও ইসলামের আদর্শ প্রত্যাখ্যান করেছে।
৩. সরকারি কর্মচারীদের ওপর মুসলিম লীগের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই; সচিবালয় স্টাফ এবং বাঙালি পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অরাজকতা সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারকে অক্ষম করে তোলা সম্ভব হয়েছে। তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অসাধারণ দক্ষতা এবং পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের পাঞ্জাবি কর্মকর্তাদের কর্তব্যনিষ্ঠার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রস্থল ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ সম্পূর্ণ নৈরাজ্যে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে- সরকারের কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পূর্ণ ব্যর্থতার কারণে তাদের অবদান সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাঙালি পুলিশ প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেছে এবং বাংলা ভাষার পক্ষের বিদ্রোহীদের সমর্থন জানিয়েছে। তখন চরম বল প্রয়োগই ছিল নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায়।
৪. বাজেট ও ফিন্যান্স বিল পাস না করেই পূর্ব বাংলার লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি অধিবেশন স্থগিত করেছে, মন্ত্রণালয়ের নিয়তি এখন দড়ির ওপর ঝুলছে।
৫. শাসক ও শাসিতের মধ্যে পূর্ব বাংলায় বিস্তর ব্যবধান লক্ষ করা গেছে এবং যতই দিন যাচ্ছে তা ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে।
৬. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং হোস্টেলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে; দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বারোটা বাজতে চলেছে।
৭. এবার এটা প্রকাশিত হয়ে পড়েছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই হচ্ছে কমিউনিজমের উৎসভূমি এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের কেন্দ্র। এখানে হিন্দু, ভারতীয় ও রুশ প্রভাব কাজ করে বৈরী পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাবধারা, আদর্শ ও লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিশ্ববিদ্যালয় লালন করে যাচ্ছে। হিন্দুত্ববাদ ও সাম্যবাদের প্রভাব বলয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে।
৮. অত্যন্ত বিষাক্ত মাত্রার বর্ণ ও ভাষা বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়েছে। উর্দুভাষী মানুষ ও মোহাজিররা কোনো কোনো স্থানে অবজ্ঞা, অপমান ও অনাচারের শিকার হয়েছে।
৯. এখানকার মন্ত্রণালয় ও নেতৃত্বের দুর্বলতা দোদুল্যমানতা ও আত্মসমর্পণ থেকে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে জনগণের অনুভূতি তীব্র হয়ে উঠছে আর লীগ মন্ত্রীরা নিজেরাই বিক্ষোভকারীদের সমর্থন জানাচ্ছে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের
খাতায় যোগ হয়েছে :
১. ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়াতে চরমপন্থা অবলম্বন করে নিজেদের সচেতন জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে, যা তাদের জন্য রাজনৈতিক হারাকিরি-তুল্য। এই দল যে জনসমর্থন লাভ করতে যাচ্ছিল তা আবার মিলিয়ে গেছে- তাদের সব কর্মী হয় গ্রেপ্তার হয়েছে অথবা পুলিশের ধাওয়া খেয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে।
২. আওয়ামী লীগ বিশেষ করে দলের সেক্রেটারি জেনারেল শামসুল হক ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ব বাংলার সার্বভৌমত্বের দাবি প্রচার করে যাচ্ছেন। তিনি ভুলে গেছেন যে লাহোর প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়নি। পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে মিল্লাত-ই-ইসলামিয়া- একক রাষ্ট্র দর্শনের ওপর; বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ ভাষার ভিত্তিতে হয়নি, হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। পশ্চিম পাকিস্তানের জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পূর্ব বাংলার আওয়ামী মুসলিম লীগের লক্ষ্য মনে হচ্ছে একই- পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করা। সে কারণে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় সত্যিকারের মুসলমান ও সত্যিকারের পাকিস্তানিদের সমর্থন হারিয়েছে।
৩. স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে পূর্ব বাংলা আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণভাবে নেতৃত্বহীন একটি দল এবং তা সুবিধাবাদী সেকুলারিস্টদের দ্বারা তাদেরই হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। বিভ্রান্ত তরুণরা ভোটার ধরার সেøাগান হিসেবে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে বেছে নিয়েছে। তারা অবাঙালি মুসলমান ব্যবসায়ীদের প্রত্যাখ্যান করছে, তাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। তারা ইস্পাহানি ও আদমজির প্রতি কঠোর ভাষা ব্যবহার করছে, যদিও তারা জানে যে এসব কোম্পানি ভারত থেকে কোটি কোটি টাকার তহবিল এখানে নিয়ে এসেছে; কিন্তু যেসব মারওয়ারি, পশ্চিমবঙ্গীয় ব্যবসায়ী এবং ব্রিটিশ শোষণকারী পাকিস্তান থেকে তহবিল ভারত ও ব্রিটেনে পাচার করছে তাদের ব্যাপারে তারা নিশ্চুপ।
৪. তাদের নেতাদের কেউ কেউ ভারতের হিন্দু বাঙালির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাঙালি জাতির একতার নসিহত চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ও ইসলামের শত্রæদের সঙ্গে দহরম-মহরম অব্যাহত রাখার অভিযোগ রয়েছে।
৫. শ্রমিকদের মধ্যে যারা নাশকতামূলক কাজ ও সহিংসতার সঙ্গে জড়িত, যারা যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংস করতে তৎপর তাদের সঙ্গে নেতাদের যোগসাজশ রয়েছে।
একই সঙ্গে মুসলিম লীগ ও আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় তাদের অবয়ব প্রকাশ করে ফেলেছে। একদল ক্ষমতায় রয়েছে। অন্যদল তাদের সরিয়ে ক্ষমতায় আসতে চাইছে- ক্ষমতাকেন্দ্রিক এই মিল ছাড়া উভয় দলই পাকিস্তান ও ইসলামের শত্রæ হিসেবে জনগণের কাছে বিবেচিত হচ্ছে। তারা কেউই কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক রাষ্ট্র ও জীবন ব্যবস্থার সঙ্গে নেই। পাকিস্তানে এখন চলছে একতা ইমান শৃঙ্খলাবর্জিত মানুষের রাজত্ব, জিন্নাহর আদর্শ বাস্তবায়নের নেতৃত্বের দেখা মিলছে না।
স্মরণ রাখতে হবে এই বিবরণী একজন অবাঙালি উচ্চাকাক্সক্ষী রাজনৈতিক নেতার, যিনি নেতা হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি। পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্টের বীজ গোড়াতেই জিন্নার হাতে রোপিত হয়েছে।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে,
নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়