ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের শেকড় অনেক গভীরে : কলকাতায় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী

আগের সংবাদ

সমন্বয় নেই ভবন তদারকিতে : আইনের ফাঁক গলে হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন > রাজউকের নকশা মেনেই সেবা সংযোগ দেয়ার পরামর্শ

পরের সংবাদ

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পথনকশা ও পিএমআইর সূচনা

প্রকাশিত: মার্চ ২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে জনমনে ব্যাপক উৎকণ্ঠার ভেতর বাংলাদেশ ব্যাংক পথনকশা ঘোষণা করল। পথনকশায় মোট ১৭টি বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো খেলাপি ঋণ কমানো, বেনামি ঋণ ও জালিয়াতি বন্ধ করা, যোগ্য পরিচালক নিয়োগের ব্যবস্থা, উপযুক্ত স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ এবং দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা। ২০২৬ সালের জুন মাসের ভেতর কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে চায়, যা এখন ১০ শতাংশের কিছুটা কম। অবলোপন করা ঋণের অঙ্ক বাদ দিয়ে খেলাপি ঋণের এই হিসাব দেখানো হয়েছে। এ সময়ের ভেতর ঋণ নিয়ে জালিয়াতি বন্ধ করে ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে পথনকশায়।
ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বর্তমানে ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর বাইরে আছে বিপুল পরিমাণ অবলোপন করা ঋণ। অবলোপন করা ঋণও প্রকৃত অর্থে খেলাপি ঋণ, খেলাপি হওয়ার পর ‘মন্দ ও ক্ষতি’ মানে শ্রেণিবিন্যাসিত ও মামলাধীন থাকলে ঋণ অবলোপন করা হয়ে থাকে। আবার বেনামি, অপ্রতুল ও ত্রæটিপূর্ণ সহায়ক জামানত, ঋণের অর্থ অপব্যবহার ইত্যাদি কারণে নিয়মিত হিসেবে প্রদর্শিত ঋণের একটা অংশকে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা যায়। বারবার পুনঃতফসিল করে কোনো ঋণকে নিয়মিত দেখানোও কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়। এ রকম খেলাপি, অবলোপন ও ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের কারণেই কোনো কোনো ব্যাংক বর্তমানে তারল্য সংকটে ভুগছে। মালিকপক্ষ ও প্রভাবশালী মহল নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে বেসরকারি কোনো কোনো ব্যাংককে এমনই সমস্যায় ফেলেছে যে তাদের দৈনন্দিন কার্যনির্বাহের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। উদ্ভূত সমস্যার জন্য ব্যাংকাররাও কম দায়ী নন। তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি। বশীভূত হয়ে পেশাদারিত্ব বিসর্জন দিয়েছেন।
খেলাপি ঋণের ভার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক পথনকশায় অবলোপনের ওপর জোর দিয়েছে। পূর্বে ৩ বছর ‘মন্দ ও ক্ষতি’ মানে শ্রেণিবিন্যাসিত থাকলে অবলোপন করা যেত, এখন সময়সীমা কমিয়ে করা হয়েছে ২ বছর। তবে তার আগে পূর্বের মতোই সহায়ক জামানত বিক্রি করে ঋণ আদায়ের প্রচেষ্টা গ্রহণ এবং অপারগ হলে অর্থঋণ আদালতে মামলা করার বিধান বলবত আছে। অবলোপনের সময় কমিয়ে ২ বছর করায় বাংলাদেশ ব্যাংক ধারণা করছে তাতে ৪৩ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি ঋণ আদায় হবে, এর ফলে সার্বিক খেলাপি ঋণ ২০২৬ সনের কথিত সময়ের ভেতর ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। উল্লেখ্য, অবলোপনের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়, যা বিয়োজিত হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে। অবলোপন করা ঋণ আদায় হলে আদায়কৃত অর্থ পুনরায় মুনাফা হিসেবে দেখানো যায়। সে জন্য অবলোপিত ঋণ আদায়ের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। লক্ষ্য অর্জনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা হলো ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রতি ব্যাংকে অবলোপন করা ঋণ আদায়ের জন্য আলাদা ইউনিট করার। নিয়োগ-পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের এক্ষেত্রের পারদর্শিতা মূল্যায়িত হবে। আদায়ের জন্য ইনসেনটিভের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে এর অপব্যবহার রোধে সতর্ক থাকা উচিত। ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা উচ্চ বেতন-ভাতায় নিযুক্ত, তাদের হিস্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। এ ধরনের ঋণ কেনার জন্য অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠার আইন প্রণয়নের কথাও বলা হয়েছে। বাস্তবতা হলো, সঠিকভাবে মঞ্জুরি দেয়া না হলে প্রদত্ত ঋণ আদায় দুরূহ হবে এবং তা কিনে নেয়ার মতো কোম্পানি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কোনো ঋণসীমা মেয়াদোত্তীর্ণের পর যত দ্রুত সম্ভব তার দায়-দেনা আদায়ের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। যত বিলম্ব হবে ততই দায়-দেনা বাড়বে, কঠিন হবে আদায় প্রক্রিয়া। পুনঃতফসিলের যে রেওয়াজ তৈরি হয়েছে দেশে, তা মোটেও ভালো নয়। এতে ঋণের বোঝা বেড়ে দেখতে দেখতে অসহনীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়, সহায়ক জামানতের মূল্যকে ছাড়িয়ে যেতেও সময় লাগে না। সহায়ক জামানত যদি দুর্বল হয় তো দেনা অপরিশোধিতই থেকে যায়। এমন পরিস্থিতি সুদ-মওকুফ সুবিধার প্রেক্ষাপট তৈরি করে। সুদ-মওকুফের দৃষ্টান্ত ভালো ঋণগ্রহীতারও মানসিকতা বদলে দেয়, তারাও সুবিধা খোঁজেন। পরিণতিতে তারল্য সংকটের উদ্ভব হয় ব্যাংকে। পুনঃতফসিলের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় অনেক সময় ব্যাংকের অদূরদর্শিতার কারণেও। শিল্প ঋণের ক্ষেত্রে এমনটি বেশি ঘটে। শিল্প স্থাপনের পর সময়মতো ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল না দিলে কিস্তি আটকে যায়। খেলাপি থেকে রেহাই পেতে ঋণগ্রহীতার পুনঃতফসিলের উদ্যোগ নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কৃষিঋণ নিয়ে ঘটছে আবার ভিন্ন ধরনের ঘটনা। বর্ধিত পরিমাণে নতুন ঋণ মঞ্জুর করে তা থেকে পুরাতন ঋণের দায়-দেনা সমন্বয়ের রেওয়াজ তৈরি হয়েছে। এতে দায়-দেনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে একসময় তা গলার ফাঁস হচ্ছে কৃষকের। এ ধরনের রেওয়াজ কৃষকের স্বার্থেই বন্ধ হওয়া উচিত।
বর্তমানকে সামাল দিয়ে ভবিষ্যৎকে নিষ্কণ্টক করা এখন সময়ের দাবি। পথনকশায় এমন ইঙ্গিতই আছে। ইতোমধ্যে খেলাপি হয়ে পড়া বিপুল অংকের ঋণ আদায়ের জোরালো প্রচেষ্টার পাশাপাশি বেনামি ঋণ ও ঋণ নিয়ে জালিয়াতি বন্ধের কথা বলা হয়েছে। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যদি ঋণ বিতরণ করা যায় তো সে ঋণ সহজে খেলাপি হবে না। তার জন্য প্রয়োজন প্রভাবমুক্ত নির্মোহ পরিবেশ এবং ব্যাংকারের দক্ষতা ও পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গি। পথনকশা জারি শুধু নয়, ইপ্সিত সেই পরিবেশ সৃষ্টিই হবে আসল চ্যালেঞ্জ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদিচ্ছা আর সরকারের সদিচ্ছা একাকার না হলে পরিস্থিতির উন্নতির আশা দুরাশা। বিদেশে অর্থ পাচার এক বহুল আলোচিত বিষয়। বৈদেশিক বাণিজ্য পাচারের অন্যতম প্রধান পন্থা। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে এদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া। এ কাজে সহযোগী হিসেবে পেতে হবে কাস্টমসসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে। সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া অর্থ পাচার রোধ করা কঠিন। ঋণের জামানত হিসেবে বন্ধক নেয়া সম্পত্তির মূল্যায়ন নিয়েও পথনকশায় বিশেষ নির্দেশ আছে। ব্যাংকের নিজস্ব মূল্যায়নের পাশাপাশি তালিকাভুক্ত বাইরের প্রতিষ্ঠান দিয়েও মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। ব্যবস্থাটি পূর্বে কোনো কোনো ব্যাংকে ছিল, তবে টেকসই হয়নি। সময়ক্ষেপণ রোধ করে মূল্যায়ন খরচ সাশ্রয়ী করতে না পারলে গ্রাহক আগ্রহী হবেন না। মূল্যায়ন নিয়ে কোনোরকম কারসাজি হলে দায় প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানকেও নিতে হবে।

পিএমআই কী ও কেন?
দেশের বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি প্রধান সমস্যা হলো কোন খাতে তারা বিনিয়োগ করবেন এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসা। ব্যাংকের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা বিদ্যমান। বিনিয়োগ লাভজনক খাতে না হলে বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পাওয়া কঠিন, সেই বিবেচনায় ব্যাংককেও ঋণ দেয়ার জন্য লাভজনক খাত বেছে নিতে হয়। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের যে-রিপোর্ট দেখে ব্যাংক বড় অঙ্কের ঋণ দেয়, তাকে কাগুজে রিপোর্ট বললে অত্যুক্তি হবে না। বাস্তবতার সঙ্গে এর মিল থাকে সামান্যই। সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংবলিত গবেষণা ছাড়াই এসব রিপোর্ট তৈরি করা হয়, যার দরুন বিনিয়োগকারী ও ব্যাংক উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমস্যার সুরাহার জন্য এ পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না, এখন এর সূচনা ঘটতে যাচ্ছে। চালু হচ্ছে অর্থনীতির গতিশীলতা নির্ণয়ের নতুন সূচক পিএমআই বা পারচেজিং ম্যানেজার্স ইনডেক্স (তথ্য : প্রথম আলো, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)। ব্যবসায়ী সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ যৌথভাবে এ সূচক প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। সহায়তা করছে যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কার্যালয় (এফসিডিও)।
পিএমআইর উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন কৃষি, নির্মাণ, উৎপাদন ও পরিষেবা- এই চার খাতের ৫০০টির বেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের মতামতের ভিত্তিতে এই সূচক প্রকাশ করা হবে। শুরুতে প্রান্তিক হলেও পরে মাসভিত্তিতে এটি প্রকাশিত হবে। সূচক তৈরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্যের ক্রয়াদেশ, মজুত, উৎপাদন, সরবরাহ পরিস্থিতি ও কর্মসংস্থানের বিষয়ে তথ্য নেয়া হবে। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের পূর্বে ব্যবসা-বাণিজ্যের হালনাগাদ তথ্য জেনে পদক্ষেপ নিতে পারবেন। এতে উপকৃত হবে ব্যাংকও। ঋণ প্রস্তাব যাচাই-বাছাইয়ে সূচক সহায়ক হবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, সূচক তৈরির এই প্রক্রিয়া সফল হলে দেশ নানাভাবে উপকৃত হতে পারবে।

মজিবর রহমান : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়