সব মামলায় জামিন : জহির উদ্দিন স্বপনের মুক্তিতে বাধা নেই

আগের সংবাদ

বিভীষিকাময় এই মৃত্যুর দায় কার : ভবন ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে মালিককে তিনবার নোটিস দেয় ফায়ার সার্ভিস, রেস্টুরেন্ট কিংবা দোকানের অনুমোদন ছিল না

পরের সংবাদ

অনলাইন হার্ম : কনটেন্ট উৎপাত

প্রকাশিত: মার্চ ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কত আশীর্বাদই না অভিশাপ হয়ে যাচ্ছে। যার পুরোটাই অপব্যবহারের কুফলে। সুযোগের অসদ্ব্যবহারে। আবার সমস্যাটা এখন আর স্থানিক নয়, একেবারে বৈশ্বিক। দেশে দেশে হার্মফুল হয়ে উঠছে অনলাইন মিডিয়া। কানাডার মতো উন্নত বিশ্বেও। নেহায়েত বাধ্য না হলে অনলাইনে ‘ক্ষতিকর’ কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে দেশটির হাউস অব কমন্সে ‘অন লাইন হার্ম বিল’ নামে নতুন বিল ওঠে না।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বাক-স্বাধীনতা বলে ডাকা হয়। বাক-স্বাধীনতার প্রশ্নটা তখনই ওঠে যখন কেউ কাউকে এমন বাক্য ছোড়ে শালীনতার সব দেয়াল ভেঙে দেয়। এরই নাম কি বাক-স্বাধীনতা? যা ইচ্ছা বলা, লেখা বা দেখানোর নাম বাক-স্বাধীনতা? না, মোটেই না। দুনিয়ার কোনো স্বাধীনতাই অ্যাবসলিউট নয়। অবশ্যই এতে অধীনতা থাকে। লিমিট বা সীমানা থাকে। মাত্রার বিষয় রয়েছে। স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছে তা-ই করা নয়, স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে অন্যের অধিকার বা স্বাধীনতার লঙ্ঘনও নয়। মনে যা আসে তাই প্রকাশ করার নাম মুক্তমনা নয়। একজনের স্বাধীনতার জন্য আরেকজনের স্বাধীনতা নষ্ট করা বর্বরতা-অসভ্যতা।
একসময় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মাধ্যম বলতে ছিল ‘সংবাদপত্র’। তারপর রেডিও। সময়ের ব্যবধানে এরপর যুক্ত হলো টেলিভিশন। এখন প্রাত্যহিক ব্যবহৃত হাতের মোবাইল ফোনটিও গণযোগাযোগের উৎকৃষ্ট মাধ্যম। ইন্টারনেটের বদৌলতে কোটি কোটি মানুষের অংশগ্রহণে সোশ্যাল মিডিয়া নবজাগরণ। বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের ধারা-ধারণা প্রতিনিয়ত বদলের পথের পথিক বাংলদেশও। এর পেছনের অন্যতম কারণ ডিজিটালাইজেশন। আর ডিজিটালের হালনাগাদ প্রতিশব্দ স্মার্ট। বাঁকবদলের এ পথে গণমাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যম অনেকটা একাকার। প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক-ব্রডকাস্ট-ভিজুয়াল শব্দগুলোও আপেক্ষিক হতে বসেছে। গণমাধ্যমের এ শাখাগুলো রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান থেকে শুরু করে একজন সাধারণ মানুষ পর্যন্ত মতবিনিময়ের একটি অসাধারণ সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। মানুষ নিজের মতামত জানাতে পারছে। বিপরীতে গোলমালও কম ডাকছে না। গণমাধ্যম এখন শুধু ঘটনা-দুর্ঘটনা বা তেজারতি কাজে সীমিত নয়। মেধা বিকাশের সিঁড়ি, বিনোদনের হাতিয়ার এবং অধিকার আদায়ের মুখপত্রও। রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য-তথ্য জানানোর মধ্যেও রকমফের এসেছে। তা প্রযুক্তির বদৌলতে। গেøাবাল ভিলেজ বা বিশ্বগ্রামের সুবাদে। তার ওপর গণমাধ্যমকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদি। ছোট্ট একটি সেলফোন হয়ে উঠেছে অনেক কিছুর চালিকাশক্তি। আটলান্টিকের ওপারে প্রথম বেতার সংকেত পাঠান এবং পাল্টা সংকেত গ্রহণ করেন মার্কনি নামের প্রযুক্তি ব্যবসায়ী ১৯০১ সালে। এটাকে প্রথম বেতার বার্তা হিসেবে মনে করা হয়। তারও আগে ১৮৯৯ সালে বাংলার জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে মার্কনির যোগাযোগ স্থাপনের একটি তথ্য সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
টেলিভিশন খুব বেশিদিন আগের নয়। গ্রিক শব্দ টেলি অর্থ দূরত্ব। আর লাতিন শব্দ ভিশন। এই দুই ভাষার শব্দ দুটি মিলে টেলিভিশন। বাংলায় দূরদর্শন যন্ত্র। ১৮৬২ সালে তারের মাধ্যমে প্রথম স্থির ছবি পাঠানো সম্ভব হয়। এরপর ১৮৭৩ সালে বিজ্ঞানী মে ও স্মিথ ইলেকট্রনিক সিগন্যালের মাধ্যমে ছবি পাঠানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন লোগি বেয়ার্ড ১৯২৬ সালে প্রথম টেলিভিশন আবিষ্কার করেন। এরপর রুশ বংশোদ্ভূত প্রকৌশলী আইজাক শোয়েনবারগের কৃতিত্বে ১৯৩৬ সালে প্রথম টিভি সম্প্রচার শুরু। বিশ্বে প্রথম বাণিজ্যিক টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু করে বিবিসি। বাংলাদেশে টেলিভিশনের যাত্রা শুরু ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর। ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে চালু হয় ফেসবুক ইনক। শুরুতে এর ব্যবহারকারীরা বন্ধু সংযোজন, বার্তা প্রেরণ এবং তাদের ব্যক্তিগত তথ্যাবলি আদান-প্রদান করতেন। মার্ক জাকারবার্গ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তার রুমমেট ও কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র এডুয়ার্ডো স্যাভেরিন, ডাস্টিন মস্কোভিৎস এবং ক্রিস হিউজেসের যৌথ প্রচেষ্টায় ফেসবুক নির্মাণ করেন। এরপর ২০০৫ সালে চালু হয় ইউটিউব চ্যানেল। দ্রুত সাড়া জাগায় এবং টেলিভিশনের সঙ্গে পাল্লা দিতে থাকে। নিত্যনতুন ভিডিও দেখে অল্প দিনে ইউটিউব চলে আসে দর্শকদের পছন্দের তালিকায়। ফেসবুকও চালু করে ভিডিও আপলোডসহ লাইভ টিভি প্রোগ্রাম সুবিধা।
জীবন, বিজ্ঞান ও তথ্যের এ ছুটে চলায় গণমাধ্যমের এখন দুরন্ত গতি। এ গতির সুযোগ নিচ্ছেন রাজনীতিক-ব্যবসায়ীসহ সব মহলই। এখানে কেউ এক বা একা নন। অনন্যও নন। যুক্তরাষ্ট্র উইকিলিকসকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। অনলাইন-অফলাইন বিরোধও আর থাকছে না। অডিও বার্তার সঙ্গে ভিডিও বার্তা এখন এক লাগসই কৌশল। গণমাধ্যমের এই অসীম ব্যাপকতা, বিশালতায় শরিক রাজনৈতিক দলগুলো। সরকারের দিক থেকে আরো বেশি। কূটনৈতিক বা আন্তর্জাতিক মহলকেও এক করে ফেলা হচ্ছে ভিডিও বার্তায়। তা সবার কাছেই সমাদৃত, বৈধও। বাংলাদেশে এর সূচনার একটা বিশেষ পর্যায়ের সূচনা করে বিরোধী দল। বিশেষ করে ২০১৪-১৫ সালের ভিন্নমাত্রার আন্দোলনের সময় বিএনপির কয়েক নেতা লুকোচুরিতে অজ্ঞাত জায়গা থেকে ভিডিও বার্তা পাঠাতেন। দলটির দেশান্তরী নেতা লন্ডন থেকেও মাঝে মধ্যে গণমাধ্যমের ওপর ভর করতেন ভিডিও বার্তা দিয়ে। বিপরীত শক্তি থেকে একে তেরাবোরা পাহাড়ের বাণী বলে ব্যঙ্গ করা হতো। এই ব্যঙ্গ-মস্করার মধ্যেই ২০২১ সালে এসে করোনা মহামারির মধ্যে আরেক দৃশ্যপট। ভিডিও বার্তা তখন অনেকটা মামুলি হয়ে যায়। সরকার ও সরকারি দলের যাবতীয় বার্তা এবং তথ্য ভিডিওতে দেয়া শুরু হয়।
বাস্তবতা, সম্ভাবনা ও বহুমাত্রিকতার কারণে বিশ্বের সর্বত্র এখন ভিডিও বার্তার প্রচলন। সনাতনী মহলের কাছেও এটির বেশ গ্রহণযোগ্যতা। আর গণমাধ্যমে সংবাদের চিরাচরিত প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এটি নান্দনিকতার বিষয়। তা মূলধারার গণমাধ্যম আর সোশ্যাল মিডিয়ার পুরো ক্যানভাসটাকে পাল্টে দিয়েছে। রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, খেলোয়াড় প্রকাশ্যে সরব না হয়ে নিরিবিলি জায়গায় বসে তার বার্তা দিয়ে দিচ্ছেন ভিডিওতে। গণমাধ্যম তা অগ্রাহ্য করছে না। বরং লুফে নিচ্ছে। নৈতিকতার প্রশ্নে এখন এর সীমানা টানার প্রশ্ন এসেছে। কারণ তথ্যের সত্যতা এবং ক্রস চেকের প্রশ্নে এটি কেবল অপর্যাপ্তই নয়, একতরফা-একপেশেও। যাচ্ছেতাইভাবে এই সুযোগটা নিচ্ছেন অনেকে। মন যা চায়, মুখ দিয়ে যা আসে তারা বলে দিচ্ছেন। এটি মোটেই কাম্য নয়। ১৯৬৪ সালে কানাডীয় সমাজ বিশেষজ্ঞ মার্শাল ম্যাকলুহান যে ‘গেøাবাল ভিলেজ বা বিশ্বগ্রাম’ ধারণার কথা বলেছিলেন, এটি মোটেই তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বরং অপব্যবহার।
অনলাইন আর অফলাইন সব মাধ্যমেরই এখন অসীম ব্যাপকতা। প্রচারের ক্ষেত্রে বিশাল শক্তি। এই শক্তির অপব্যবহার আজ কারও কারও জন্য সুযোগ ও সম্ভাবনার। ঠিক বিপরীতে অন্যের জন্য সর্বনাশের। ভিডিও বা অডিও কোনো বার্তাকেই আনকাট চালানো বা চলতে দেয়া অপ্রত্যাশিত। তাই এই ভাষা-মাত্রা নির্ধারণ জরুরি। মনে রাখতে হবে এটি প্রেস রিলিজের আপডেট। সব প্রেস রিলিজ কি পুরোটা বা আনকাট ছাড়া হয়? অথবা আদৌ ছাড়া হয়।
এ ছাড়া প্রেস রিলিজের রচনা এবং কাঠামোর বিষয় আছে। একতরফা বার্তায় বক্তার দেয়া বিভ্রান্তি, মিথ্যা বা গুজব তাৎক্ষণিক বোঝা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই সুযোগ বুঝে এখন চলছে কনটেন্ট তৈরির ধুম। এতে তথ্যের চরম এক নাশকতা-নারকীয়তা। যে যা পারছে তৈরি করছে। বাজারে ছাড়ছে অনলাইনে। সেখানে বাস্তবে অনলাইন-অফলাইন থাকছে না। টার্গেট করা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সর্বনাশ করে দেয়া হচ্ছে নিমিষে। এ নিষ্ঠুরতার জেরে বিশ্বসভ্যতার গণতান্ত্রিক সৌন্দর্যের দেশ কানাডায় অনলাইনে ‘ক্ষতিকর’ কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে ‘অনলাইন হার্ম বিল’ নামে নতুন বিলের অবতারণা। এর আগে অনলাইন স্ট্রমিং অ্যাক্ট নামে দেশটিতে নতুন একটি আইন হয়েছে। এ আইন দিয়েও অনলাইন বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না কানাডা সরকার। অন্যান্য দেশে তো নস্যি।
জাতিসংঘের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে প্রত্যেকের চিন্তা, বিবেক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারের কথা। সাংবাদিকদের দায়িত্ব-কর্তব্য-যোগ্যতার কথাও এখানে প্রাসঙ্গিক। কারণ সাংবাদিকসহ সবার বাকস্বাধীনতারই সীমানা আছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে ইংরেজি ভার্সনে বলা হয়েছে ‘প্রেস ফ্রিডম’। বাংলা ভার্সনে তা ‘সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা’। ৩৯ অনুচ্ছেদের ২ ধারায় এ স্বাধীনতার সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের দায়দায়িত্ব তথা সীমানা উল্লেখ আছে। গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ইত্যাদি প্রশ্নে উদার ঐতিহ্য ও সভ্যতার আইডল ব্রিটেনেও সাংবাদিকদের জন্য কঠোর আচরণবিধি রয়েছে। বিশ্বের আরেক সভ্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পাশাপাশি জুড়ে দেয়া হয়েছে নিয়ন্ত্রণের বেশকিছু ধারা-উপধারা। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে তাদের সংবিধানের ১৯ (ক) অনুচ্ছেদের বিপরীতে ১৯ (২) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ আছে ‘পরিপূরক দায়দায়িত্ব ছাড়া সংবাদপত্রসমূহ একতরফা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না’। সাম্প্রতিক সব ঘটনা-দুর্ঘটনা নিয়েই গণমাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যমের এক অসুস্থ লড়াই। যার যার ইচ্ছামতো তথ্য ছড়ানো-রটানোর প্রতিযোগিতা। কেবল দলীয়-সামাজিক-ব্যক্তিগত নয়, রাষ্ট্রীয় বিষয়ও বাদ যাচ্ছে না। দেশে দেশে এখন এর লাগাম টানার কসরত চলছে। এছাড়া উপায়ও নেই।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়