ওয়ারীতে আগুন : ৯৯৯-এ কল পেয়ে উদ্ধার ৮০ জন

আগের সংবাদ

নির্বাচন পরবর্তী বোঝাপড়া

পরের সংবাদ

লেখক পাঠক প্রকাশক ও প্রচারমাধ্যম

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বইমেলায় নবীন ও প্রবীণ লেখকের বই যেমন আসে, তেমনই আসে অ-লেখকের বই। লিখতে পারেন না, কখনো লেখার চেষ্টাও করেননি, কিন্তু হঠাৎ তার ইচ্ছা হলো বই বের করার। প্রকাশকের সঙ্গে কথা বললেন, যেভাবেই হোক তার ইচ্ছাটা পূরণ করা হোক। প্রকাশক দেখলেন, অর্থনৈতিক মন্দা বা সংকটের বাজারে লোকটার প্রচুর টাকা আছে। অঢেল ধনসম্পদের মালিকও বটে। সামাজিক বাজারে তার মন্দ ও নেতিবাচক আচরণের জন্য পরিচিতিও কমবেশি আছে। তার ওপর লোকটা ইউটিউবের একজন ভাইরাল ব্যক্তি। কৌতূহলবশত অনেক দর্শকই তাকে ফলো করে। সুতরাং টাকা কামাই ও প্রকাশনার প্রচার বা ব্র্যান্ডিং কম হবে না, বরং হিসাব বলে লাভটা বেশি। এমন প্রকাশক আছেন, যারা বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ করেন না এমন প্রস্তাবে। হয়তো বলে বসেন, খুব সম্ভব। কীসের ওপর বই বের করা হবে তা জেনে হয়তো দ্রুত জবাব দিয়েও ফেলেন প্রকাশক, আমি সব দেখব। ব্যস, প্রকাশকের আশ্বাসে ইচ্ছা পোষণকারী লোকটা তখন থেকেই একজন লেখক বা কবি বনে যান। আর প্রকাশক চেষ্টা করেন তাকে বিভিন্নভাবে, কৌশলে একজন লেখক বা কবি হিসেবে পরিচিত করাতে। প্রতিবছর এমন লেখকের সন্ধান পাওয়া যায় কতিপয় প্রকাশক ও প্রকাশনার বদৌলতে। এবারের বইমেলায় অনুসন্ধান চালালে এমন অ-লেখক ও সুযোগসন্ধানী প্রকাশকের সংখ্যা নেহায়েত কম হবে না।
সম্প্রতি একটি ঘটনা সমাজে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ আলোড়িত হয়েছে। মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া এই প্রচারণার জন্য কাজ করেছে বলা যায়। ঘটনাটি খন্দকার মোশতাক ও তিশার অসম সম্পর্ক নিয়ে। পত্রিকান্তরে জানা যায়, মোশতাকের বয়স তিশার বয়সের চেয়ে অনেক বেশি। সাধারণত এই বয়সের পার্থক্য আমাদের সমাজে নানা ও নাতির মধ্যে দেখা যায়। বলা যায়, মোশতাক ও তিশার বিয়ের এই ধরনের সম্পর্ক আমাদের সমাজে মোটেও প্রচলিত নয়। যদিও এর ব্যতিক্রম কদাচিৎ দেখা যায়। মোশতাক ও তিশার বিষয়টি তেমনই। পাশ্চাত্যে এক ধরনের সম্পর্ক রয়েছে, যেটাকে ‘সুগার ড্যাডি’ বলা হয়। অল্প বয়সের মেয়েরা অর্থনৈতিক নির্ভরতা ও প্রাচুর্যের মোহে এই ধরনের সম্পর্কের প্রতি আকৃষ্ট হয় তার নিজের পারিবারিক গণ্ডি ছেড়ে। এই ক্ষেত্রে বয়স্ক ব্যক্তি অর্থের বিনিময়ে তার জৈবিক চাহিদা মেটাতে অল্প বয়সের মেয়ের প্রতি হাত বাড়ায়। সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা বা শৃঙ্খলা এখানে গৌণ হয়ে পড়ে। যা হোক, পত্রিকান্তরে আরো জানা যায়, মোশতাক ও তিশার ঘটনার পেছনে অনুযোগ, অভিযোগও ছিল। তিশার অভিভাবকদের ভাষ্যমতে, মোশতাক জোরপূর্বক ঘটনাটি ঘটিয়েছে। ঘটনাটি মোটেও কাক্সিক্ষত ছিল না। কারণ ঢাকা শহরের প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুলের ছাত্রী ছিল তিশা। ফলে স্কুল ও স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার গায়ে অপবাদের কালিমাও লেপন হয়। খন্দকার মোশতাক সেই স্কুলের গভর্নিং বডির একজন প্রবীণ মেম্বর ছিলেন। ফেসবুক, মূলধারার প্রচারমাধ্যম ও ইউটিউবে বেশ ফলাও করে প্রচারিত হয় ঘটনাটি। অভিভাবক শ্রেণির মানুষরা মোটেও পছন্দ করেনি এই ধরনের সম্পর্ককে, ঘটনাকে। যা হোক, তাদের সম্পর্ক নিয়ে পক্ষে, বিপক্ষে অনেক বক্তব্য দেয়া হয়। ব্যক্তি অধিকার নিয়ে যারা সোচ্চার, তাদের কারোর কারোর মতে, এমন ঘটনায় সমস্যা কোথায়। আবার যারা সামাজিক শৃঙ্খলার কথা ভাবেন, নিজেদের কন্যা সন্তানের কথা ভাবেন, তাদের কারোর কারোর মতে, এ ধরনের সম্পর্ক মোটেও ঠিক নয়। এর পেছনে নিশ্চয়ই অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে তারা মনে করেন। যা হোক, এরই মধ্যে এই দম্পতি ইউটিউবে নিজেদের একটা পেজ খুলে তাদের সম্পর্কের বিভিন্ন দিক ও খুনসুটি উপস্থাপন করে, যার কোনো ইতিবাচক প্রভাব নেই সমাজে, বরং লজ্জা ও শঙ্কার কারণ বলে মনে করেন অনেকে। মূল কথা, রক্ষণশীল মানসিকতার মানুষ এটাকে ভালো চোখে দেখেননি, দেখছেন না। তারা মনে করেন, ব্যক্তি অধিকার মানে কিন্তু সামাজিক শৃঙ্খলায় আঘাত করা বা ভেঙে দেয়ার চেষ্টা নয়।
এবারের বইমেলায় মোশতাক-তিশার প্রেমবিষয়ক বই প্রকাশিত হয়েছে। যতদূর জানা গেছে, লেখার চেয়ে ছবি বেশি। বইটিতে কেবলই তাদের প্রেম-ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে। স্বাভাবিক সম্পর্কের কাছে যা অসংলগ্ন বোধ হয়েছে কারোর কারোর। মেলায় তরুণরা তাদের তিরস্কার করে ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে তারা মেলা থেকে বের হতে বাধ্য হয় এবং সেটা নিরাপত্তাকর্মীর সহায়তায়। এ ঘটনা বইমেলার শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়েছে বলে অনেক লেখক, পাঠক মনে করেন। সাধারণত বইমেলার পরিবেশ থাকে ভাবগাম্ভীর্য ও বাঙালিয়ানার ভাবে, মূল্যবোধে চলে তার আলাপন। যা হোক, সম্ভবত প্রকাশক ভেবেচিন্তে কাজটি করতে সম্মত হয়েছেন। করতেই পারেন, এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু বইমেলার মতো একটি জাতীয় আয়োজনে, অনুষ্ঠানে কী উপস্থাপন হবে বা হচ্ছে, সেই বিষয়ে সতর্কতা জরুরি কিনা, দেখা ও জানার প্রয়োজন আছে কিনা, উত্তর খোঁজা জরুরি বলে অনেকেই মনে করছেন। সমাজকে বিশৃঙ্খল করে, রাষ্ট্রকে বিব্রত করে বা রাষ্ট্রবিরোধী কোনো প্রকাশনা যেমন নিষিদ্ধ, তেমন জাতীয় বইমেলায় কী ধরনের, কেমন গুণগত মানসম্পন্ন বই নির্বাচিত হবে তারও একটা মানদণ্ড থাকা বাঞ্ছনীয়। সমাজে শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনা কিন্তু অহরহ। সামাজিক সম্পর্কগুলো ফিকে হয়ে পড়ছে অস্থিতিশীল ও অতিরিক্ত প্রত্যাশায়। পারিবারিক ঐতিহ্য, সৌন্দর্য ধূসর হচ্ছে। নতুন প্রজন্ম হচ্ছে বিপন্ন, বিধ্বস্ত। লোভ, লালসায় বাড়ছে খুন, হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি। শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। কিংবা শিক্ষার গুণগতমান ঠিক করা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। আবার শিক্ষাঙ্গনেই ঘটছে নানান ধরনের অপকর্ম, অপরাধ। এমতাবস্থায় নৈতিক মূল্যবোধ, বিনয়, ভদ্রতা, শ্রদ্ধাবোধ ও মানব মর্যাদা তৈরির পথটা ক্ষীণ করবার পাঁয়তারা কেন?
বাঙালি সমাজের জীবন-যাপনের একটা পরম ঐতিহ্য রয়েছে। যেখানে পরিবার ও তার কাঠামো অপার সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। পরিবার থেকে পরিবারের সৃষ্টি হয়। মানবজীবনের স্বপ্নগুলো আসে এই পরিবার থেকে। সেই স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব বর্তায় সমাজের ওপর। ফলে সমাজকে সুস্থ, সুস্থির রাখার প্রয়োজনীয়তা থেকেই যায়, প্রয়োজন পড়ে। এমন কোনো আচরণই প্রত্যাশা নয় যাতে কিনা সমাজে ইতিবাচক প্রভাব না পড়ে, নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাংলা সংস্কৃতি, কৃষ্টি মানেই কেবল বাংলায় কথা বলা নয়, জীবনাচরণে, বিশ্বাসে, আদর্শে বাঙালি সভ্যতাকে ধারণ করা, অনুসরণ করা।
পকেটে টাকা থাকলে যা ইচ্ছা তাই করবার প্রবণতা এখন অনেকেরই। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের রাজনীতিবিদ হওয়া, চলচ্চিত্রে অভিনয়, সংগীত শিল্পী বনে যাওয়া, লেখক কিংবা নাট্যকার হওয়া ইত্যাদি এখন মামুলি ব্যাপার। এমনকি শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার মন চাইলে এরা সেটাও নিয়ে ছাড়ে। এতে একদিকে এই শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে যেমন অকৃত্রিম ও ভালো কিছু পাওয়া সম্ভব হয় না, যা সমাজকে ভালো পথ দেখাতে পারে। অন্যদিকে শিশু-কিশোর-তরুণ-যুবরা মন্দের দিকে ঝুঁকে পড়ে, কৌতূহলবোধ করে।
প্রচারমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে। অথচ আজকাল দেখা যায়, ভালো বা ইতিবাচক ঘটনার চেয়ে মন্দ বা নেতিবাচক ঘটনা প্রচারে প্রচারমাধ্যমগুলো বেশি তৎপর বা সক্রিয়। এর পেছনে যে কারণ তা হলো, প্রচারমাধ্যমের কাটতি বাড়ানো। কৌতূলবশত ব্যক্তি নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি ঝোঁকে। আবার প্রতিটি প্রচারমাধ্যমের অনলাইন ভার্সন রয়েছে। সেখানে ভিউয়ার্স বাড়ানোর জন্য, কে কার সঙ্গে পরকীয়া করেছে, অসম সম্পর্ক গড়েছে, কে কার সঙ্গে ফোনালাপে কী বলেছে ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য পায়। এত বেশি নেতিবাচক ঘটনার পেছনে প্রচারমাধ্যমগুলো ছুটে যে, সাধারণ মানুষ আর ইতিবাচক বা ভালো ঘটনার সন্ধান আর পায় না। ফলে যেটা হয়, পথে-ঘাটে, অফিস-আদালতে, পরিবারে সর্বত্রই এসব মুখরোচক আলোচনা হতে দেখা যায়। এতে শিশুরা বড়দের কাছ থেকে ভালো কিছু শুনতে পারে না। একজন বলছিলেন, প্রচারমাধ্যম থেকে ভালো কিছু আশা করা বেকুবের শামিল। কারণ হিসেবে তার মতে, অধিকাংশ প্রচারমাধ্যমের মালিক ব্যবসায়ী, সাংবাদিক নয়। আবার অনেক সাংবাদিক আদর্শচ্যুত হয়ে ব্যবসায়ী। ফলে কোন সংবাদ দেশ, সমাজ ও জাতির জন্য প্রয়োজন, সেটা অনুধাবনের ক্ষমতা, যোগ্যতা তাদের নেই। কিংবা থাকলেও তারা সেটা আড়াল করে চলে।
আতঙ্কিত একজন লেখক জানতে চাইছিলেন, বইমেলা কি ভবিষ্যতে লেখকের সন্ধান দেবে, নাকি টাকাওয়ালাদের বিনোদন পার্ক হয়ে উঠবে? এমন প্রশ্নের সহজ উত্তর দিতে পারে কেবল বইমেলা সংশ্লিষ্টরা। তারা কেমন বই সংগ্রহ করবে মেলার জন্য, প্রতিটি বইয়ের রিভিউ করা এসব মেলাপূর্ব কাজ। বইমেলার পবিত্রতা ও উদ্দেশ্য সুরক্ষা করতে না পারলে এর ভয়ংকর থাবা পড়বে বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সার্বভৌমত্বে। ইদানীং আরো একটা বিষয় চোখে পড়েছে, পাঠকের চেয়ে সেলফি তোলার মানুষের সংখ্যা বইমেলায় বেশি। হাতে যে কোনো লেখকের বই নিয়ে পোজ দিয়ে ছবি তুলে চলে যাচ্ছে। এমন দৃশ্য বেশ বেমানান। বইমেলার যে গুরুত্ব বা মহত্ত্ব, সেটা আর থাকছে না।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়