জলবায়ু অর্থায়ন ছাড় করুন, অস্ত্র প্রতিযোগিতা আর নয় : নিরাপত্তা সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী > বিশ্ব নেতাদের প্রতি ৬ প্রস্তাব শেখ হাসিনার

আগের সংবাদ

স্বাস্থ্য শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ : কমছে বিদেশি শিক্ষার্থী > শিক্ষক সংকটও চরমে > বিদেশে চাকরি ও প্রশিক্ষণে বাধা

পরের সংবাদ

স্মার্ট রাজস্ব আয় ব্যবস্থাপনা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রায় একই আর্থসামাজিক ভূরাজনৈতিক সমতলে অবস্থিত ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনাম, বিশেষ করে কর আহরণ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে সেসব দেশে প্রয়োজনীয় সংস্কার উদ্যোগের দ্রুত বাস্তবায়নের কারণে। যেমন- ভারত ১৯৬১ সালে, মালয়েশিয়া ১৯৬৭ সালে ঔপনিবেশিক আমলের আয়কর আইনকে যুগোপযোগী করে নেয়। ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া কয়েক বছর পরপর তাদের আয়কর আইনকে রীতিমতো ঢেলে সাজায়। একই সমতলে অবস্থানরত কমনওয়েলথ সদস্য দেশ বাংলাদেশে আয়কর আইনের আধুনিকতম সংস্করণ ১৯৮৪ সালে, তাও অর্ডিন্যান্স আকারে। তা যুগোপযোগী করতে, আইন আকারে পাস ও প্রবর্তনে দেড় যুগ ধরে কসরত চলার পর চালু হয়েছে ২০২৩ এর জুনে। বাংলাদেশ ও ভারতের কর ব্যবস্থা, সুবিধা, ফরম্যাট মূলত একই। তবে একটা বড় প্রশাসনিক পার্থক্য হলো, বাংলাদেশের রাজস্ব বোর্ড পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কর, এক মন্ত্রণালয় এবং একজন প্রশাসনিক চেয়ারম্যানের অধীনে। ভারতে তা নয়, সেখানে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ করের প্রশাসন আলাদা। ভারতে প্রত্যক্ষ কর (আয়কর) অর্থ মন্ত্রণালয়ের এবং পরোক্ষ কর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকেও ভারতের কর বিভাগ বাস্তবায়নকারী হিসেবে স্বশাসিত। কেন্দ্রের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পলিসি প্রেসক্রিপশন ও থ্রেসহোল্ড দেয়ার ব্যাপারে তাদের নিয়ন্ত্রণ ও একটা শক্তিশালী অবস্থান যেমন আছে, তেমনি রাজ্য পর্যায়ে আছে স্থানীয় কর আইন ও ব্যবস্থাপনার সমান্তরাল প্রণয়ন ও প্রয়োগের সুযোগ।
আরেকটি হলো হিসাব সংরক্ষণ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের একটা দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। বাংলাদেশেরও আছে, কিন্তু হিসাব পদ্ধতি, কোম্পানির আইন সব মিলিয়ে দেশগুলোতে একটা টেকসই সংস্কৃতি গড়ে উঠলেও সে সড়কে বাংলাদেশের ওঠার প্রয়াস প্রলম্বিত হচ্ছে। বাংলাদেশে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এক হাতে হয়। তাই এখানে ডিসক্রিয়েশনারি পাওয়ার প্রয়োগের ক্ষেত্রে নীতিগত বিষয়গুলো অনেক জটিল, স্বেচ্ছা ব্যাখ্যা আচারি ও নিবর্তনমূলক হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে আইনের ব্যাখ্যা ধোঁয়াশে হয়ে যায়। ভারত, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ায় ওই সমস্যা তেমন একটা নেই। তারা অনেকটা স্বচ্ছ সংহত একটা আধুনিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়েছে।
ভারতে পরোক্ষ কর ব্যবস্থাপনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। কারণ দেশটির দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আমদানি-রপ্তানির নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর সঙ্গে যেহেতু শুল্ক ও মূল্য সংযোজন করের বিষয় জড়িত, সেহেতু সে মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাখা হয়েছে শুল্ক ও ভ্যাট দপ্তরকে। ভ্যাট আইন প্রণয়ন ও প্রবর্তনে বাংলাদেশ যথেষ্ট ধীর এবং এখনো দোটানায়। ভ্যাট মধ্যস্বত্বভোগীদের দখল থেকে সরকারি তহবিলে আনার আইনকানুন কলাকৌশল যেন সহজেই কুলিয়ে উঠতে পারছে না। বাংলাদেশে আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো যে মূল্য নির্ধারণ কিংবা ট্যারিফ ঠিক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ট্যারিফ কমিশন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন এনবিআর শুল্ক কর হার নির্ধারণ ও আরোপের সময়, সেটিকে তেমন একটা আমলে নেয় না। একইভাবে আমদানি-রপ্তানি শুল্ক পরিশোধ-সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা বা প্রজ্ঞাপন জারি করতে গেলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি আনতে হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের মধ্যে মতামতের রশি টানাটানিতে শুল্ক আহরণ মাঠে মারা যায়। এই ঝামেলা ভারতে নেই, নেই মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে; ভিয়েতনামের পরিস্থিতি আরো স্বচ্ছ ও সাবলিল। ভারতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই আমদানি-রপ্তানি বিধির আলোকে শুল্ক করাদি আরোপ করে। ভারত, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়ায় শুল্কায়ন সিদ্ধান্তদানকারী টায়ার বা লেয়ার অনেক কম। অধিকাংশ দেশে ট্যারিফ কমিশন শুল্ক আরোপ থেকে শুরু করে সবকিছু দেখে। বাংলাদেশের ট্যারিফ কমিশনের সঙ্গে এনবিআরের ভালো যোগাযোগ নেই। গণশুনানি করে ট্যারিফ কমিশন। কিন্তু শুল্ক আরোপ করে এনবিআর। এই জটিলতা নিরসনে সংস্কারের কথা বলা হলেও তাতে খুব একটা অগ্রগতি নেই।
কর ব্যবস্থাপনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে আছে ভিয়েতনাম। দেশটির কর ব্যবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের মৌল পার্থক্য হলো ব্যক্তি এবং করপোরেট কর সম্পূর্ণ ব্যক্তি বা কোম্পানির ওপরই অর্পিত। কর পরিশোধ তাদের দায়-দায়িত্বে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ব্যক্তি যা ঘোষণা দেবে, তার ভিত্তিতেই কর আরোপ হবে। কালেভদ্রে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা দ্রুত নিরীক্ষা ও নিরসন করা হয়। নিরসনের স্বাধীনতা সেখানে দেয়া আছে। ব্যক্তি করের ক্ষেত্রে ইউনিভার্সাল সেলফ অ্যাসেসমেন্ট বাংলাদেশে প্রবর্তনের সময় মনে করা হয়েছিল, ব্যক্তি করদাতাদের যদি কর অফিসে এসে রিটার্ন পূরণ করতে হয়, তাতে অনেক সময় লাগে এবং জনে জনে এভাবে পরীক্ষা করে নেয়াও সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ইউনিভার্সল সেলফ ডিক্লারেশন সঠিকভাবে দেয়া হচ্ছে না- এই অনুযোগ-অভিযোগ সন্দেহে অডিটের নামে করদাতাদের বারবার ডাকা হচ্ছে। এতেই কর প্রদানে আগ্রহ ও দায়িত্বশীলতায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হচ্ছে। ব্যক্তিকে যে ঘোষণা করার অধিকার দেয়া হলো, শেষ পর্যন্ত পারস্পরিক সংশয়-সন্দেহ, হয়রানির অভিযোগের ভাগাড়ে পড়ে অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে। নোটিস পেয়ে অফিসে গিয়ে ধন-সম্পদের ব্যাখ্যা দিতে করদাতারা অনেক ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে প্রায়ই অভিযোগ উঠছে। আবার করদাতারা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন না বলে রাষ্ট্র ও রেভিনিউয়ের স্বার্থে তাদের ডাকতে হচ্ছে। সীমিত লোকবল সম্পন্ন কর বিভাগের মনোযোগ ও সময় বিদ্যমান করদাতাদের পেছনে ব্যয়িত হচ্ছে। ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য এখানে। সেখানে আয়করের ক্ষেত্রে বলে দেয়া হয়েছে সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব ব্যক্তির, কোম্পানির। কর যা দেয়া হবে, কর অফিস তাই নেবে। এভাবেই চলছে। কোনো কোনো সময় অভিযোগ পেলে সেটি খতিয়ে দেখা হয়। বাংলাদেশের মতো গয়রহভাবে অডিট করা হয় না সেখানে। সেখানে কর আইন বেশ সুসংজ্ঞায়িত ও বিস্তৃত। সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা আছে সব কিছু। ফলে ফাঁকি দেয়ার সুযোগগুলো তেমন নেই। প্রতি বছর সংস্কার ও সহজীকরণের দিকেই তাদের মনোযোগ বেশি।
বাংলাদেশে সহজীকরণের প্রয়াস চলছে তো চলছেই, পদ্ধতি সাপোর্ট করছে না। ঘুরে-ফিরে দেখা যায় একটা আন্তঃঅবিশ্বাস বিরাজ করছে। নতুন আয়কর আইনে উৎসে কর কেটে নেয়ার এবং জরিমানার ভয়, কর রেয়াত কেড়ে নেয়ার বিধিবিধানের ছড়াছড়ি নতুন আয়কর আইনে প্রত্যক্ষ করকে পরোক্ষ করের লেবাস পরানোর প্রবণতা বেশি। ফলে কর আহরণকারী ও করদাতার মধ্যে পরস্পরকে এড়িয়ে যাওয়ার এবং ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এ ধরনের ঘটনা ভিয়েতনামে খুব কম। সেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্যও সহজ ও পদ্ধতিমাফিক করায়ন ও আহরণের এবং বিভিন্ন কর রেয়াতের ব্যবস্থাও আছে। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য হলো এখানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক কর সুযোগ-সুবিধার ঘোষণা থাকলেও রাজস্ব বিভাগের কাছে গিয়ে বাস্তবে তা আরেক রকম মনে হয়। একটার সঙ্গে আরেকটার সঙ্গতি নেই। ভিয়েতনামে এ ধরনের জটিলতা ও অসঙ্গতি খুব একটা নেই। রাজস্ব বিভাগ যা বলছে, সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠানও তাই বলছে। বাংলাদেশে এ রকম সমরূপতা নেই। ভিয়েতনামে বিদেশি বিনিয়োগ বেশি আসার পেছনে এই নীতিগত সংহতি একটা বড় ভূমিকা রাখছে।
মালয়েশিয়ায় যেমন মাইডা (মালয়েশিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি) সার্বিকভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সমন্বয় করে। সেখানে কর, কাস্টম পলিসি সব এক জায়গাতে করা হয়েছে। অর্থাৎ মাইডা যা বলবে ওটাই শেষ কথা। ভিয়েতনামের সঙ্গে মালয়েশিয়ার পার্থক্য হচ্ছে, তারা সব বিষয় সমন্বয় করে একটিমাত্র প্রতিষ্ঠানের কাছে সব ধরনের ক্ষমতা দিয়েছে।
১৮৬০ সালে জেমস উইলসন (১৮০৫-১৮৬০) ব্রিটিশ ভারতে প্রথম আয়কর আইন প্রবর্তন করেন। ব্রিটিশরা ভারতের শাসনভার নেয়ার পর প্রথম অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিল তাকে। ১৮৫৯ সালে তিনি ভারতে আসেন, ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল তিনি প্রথম বাজেট বক্তৃতায় ‘জনসেবার’ জন্য রাজস্ব আহরণের যে ফরম্যাট-ফর্মুলা দিয়েছিলেন। এখনো বাংলাদেশ, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ কমনওয়েলথ দেশগুলোতে তা অনুসরণ করা হচ্ছে। শুধু সংস্কার হয়েছে দৃষ্টিভঙ্গির। যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতি কর সংস্কৃতিতে ও অবকাঠামোয় ততটা উন্নত নয়, সেহেতু উন্নত বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি, রীতিপদ্ধতি ও নিয়মকানুন সরাসরি কাট পেস্ট করে অনুসরণে সাফল্য আসতে ও টেকসই হতে বিলম্ব হচ্ছে। যে স্টেজে যে এটিচুড বা মনোভঙ্গি (মাইন্ডসেট) বা উপলব্ধি থাকার কথা, সেটায় না থেকে যদি এটা ভাবা হয়, উন্নত অর্থনীতির মতো আমাদের সব করদাতারা শিক্ষিত, কর দানে দায়িত্ব সচেতন এবং তারা আইন-কানুন সব বোঝেন ও জানেন, তাহলে কর-দৃষ্টিভঙ্গি (মাইন্ডসেট) ভিন্ন আঙ্গিকে চলে যাবে। এমন অবস্থায় রাজস্ব আহরণ পরিবেশ পরিস্থিতি প্রগ্রেসিভ না হয়ে রিগ্রেসিভ হতে পারে। নতুন করদাতা আসতে যেহেতু চাচ্ছে না বা তাদের আনা যাচ্ছে না, সেহেতু তাদের স্থলে বিদ্যমান করদাতাদের ওপর চাপ বেড়ে গেলে তারাও পথ খুঁজতে পারেন কীভাবে কর দেয়া থেকে ফাঁকি দিয়ে পরিত্রাণ মিলতে পারে।
বাংলাদেশ রাজস্ব আহরণের অবস্থান ভারত, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় পিছিয়ে থাকার আর যেসব কারণ তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য অবারিত কর অব্যাহতি আর ট্যাক্স অ্যামনেস্টি। বাংলাদেশে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শনের জন্য দেয় কর ও জরিমানা আরোপের সঙ্গে অনৈতিক পন্থায় অর্জিত আয়ের ওপর কর হার হ্রাস বা জরিমানা ছাড় দেয়ার কিংবা ‘উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না করার সুযোগ দেয়া’কে এক করে দেখা হয়। দেখা যায়, একজন লোকের অপ্রদর্শিত অর্থ ঘোষণার সুযোগে দুর্নীতিজাত কালো টাকার মালিককে দেয়া হচ্ছে বিশেষ কর ছাড়। এটি একটি বড় ধরনের কর প্রণোদনা। আবার বলা হচ্ছে, কালো টাকার উৎস নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না অর্থাৎ দুর্নীতিবাজকে রাষ্ট্র সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বরং ইমিউনিটি দেয়া হচ্ছে। প্রতিবেশী ভারতে ১৯৯৭ ও ২০১৫ সালে কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ দেয়া হয়েছিল, সেখানে করের ও জরিমানার হার হ্রাস, জিজ্ঞাসাবাদেও অব্যাহতি ছিল না। আর এ সুযোগ ছিল নির্দিষ্ট সীমিত সময়ের জন্য। ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াতেও তাই। এসবের ব্যতিক্রম একমাত্র বাংলাদেশেই।
বাংলাদেশের নতুন ভ্যাট আইনের দুর্ভাগ্য যে, অস্ট্রেলিয়ান একজন পরামর্শক তার মুসাবিদা করে দিয়েছেন। আইনটি প্রয়োগ প্রবর্তন বিলম্বিত হচ্ছে। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত যেসব দৃষ্টিভঙ্গিকে আধুনিকীকরণ করে আইনের সঙ্গে সমন্বয় করেছে, এখানে যদি সেভাবে আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট আইনের সংস্কার করা যায়, তাহলে বহু সমস্যার সমাধান হবে। রাজস্ব আহরণের পালে বাতাস বইবে। ধার করে উন্নয়নের ঘি-ভাত খাওয়া থেকে নিষ্কৃতি পাবে অসম্ভব সম্ভাবনার অর্থনীতির এই বাংলাদেশ।
আমেরিকাতে আয়কর আইন কঠোর হওয়ার কারণে সবাই আয়কর দিতে বাধ্য। বাংলাদেশে পেশাজীবীরাসহ শহরের বাড়ির মালিকরা পর্যন্ত বা গ্রামের ধনী কৃষক তারা আয়কর এড়িয়ে যেতে পারছে। বাংলাদেশে মনিটরিং সক্ষমতায় প্রচুর ঘাটতি রয়েছে।
যদি সঠিক হিসাবের মাধ্যমে কাউকে বলা যেত, আপনি সারা বছর ২৫ টাকা আয়কর দিয়েছেন, কিন্তু আপনার আয়কর হয়েছে ২০ টাকা। আপনি ৫ টাকা ফেরত পাবেন। এই নেন আপনার বাড়তি অর্থটা। বাড়তি অর্থ ফেরত দেয়ার সংস্কৃতিটা যখন চালু হবে তখন কিন্তু কর দেয়ার ক্ষেত্রে উন্নাসিকতা, অনাগ্রহ দূর হবে। নতুন আইনে বাড়তি অর্থ ফেরত দেয়ার বিষয়টিকে রাখঢাকের মধ্যে না রেখে বাড়তি অর্থ ফেরত দেয়ার প্রথা চালু হয়, তাহলে কর প্রদানে স্বেচ্ছা প্রণোদনা ফিরে আসবে। ২০০৮ সালে প্রবর্তিত জাতীয় পরিচয়পত্র যদি আর্থ-প্রশাসনিক, রাজস্ব সংগ্রহ সব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়, তাহলে এটি হবে বাংলাদেশে যুগান্তকারী সংস্কার বা বিপ্লব। এনআইডির সঙ্গে ই-টিন ও অন্যান্য বিষয়ের সংযোগ করানো গেলে সব পেশাজীবীও এর ভেতরে এসে যাবেন। স্বয়ংক্রিয়ভাবে হিসাব মেলানো বা মনিটর না করা গেলে ফাঁকি দেয়ার পথ প্রশস্ত হবে।
বিদেশে যেমন কেউ গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে, তাকে কোথাও থামতে হবে না। সে টোল দিয়েছে, কিন্তু রিসিটের জন্য তাকে ঘুরতে হচ্ছে না, আবার টোলের টাকা সরকারের কোষাগারে পৌঁছানো নিয়ে অনিশ্চয়তায় তাকে ভুগতে হচ্ছে না। কিংবা টোল স্টেশনের ইজারা নেয়া নিয়ে গণ্ডগোলও নেই। গাড়ির মালিকদের চিপস সরবরাহ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টোলের অর্থটা তার ব্যাংক হিসাব থেকে কেটে নেয়া হয়। সম্প্রতিক একটি সংস্কারের কথা- যেমন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই অডিট রিপোর্টের একটি কপি জয়েন্ট স্টক রেজিস্ট্রারের অফিসে (আরজেএসসি) জমা দেয়ার কথা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিতে সব প্রতিবেদন পরীক্ষা করার সময় ও লোকবল তেমন নেই। ফলে ভুয়া প্রতিবেদন দাখিলের চল চালু হয়েছে। ফলে অনেকে এনবিআরে এক ধরনের প্রতিবেদন, ব্যাংকে অন্য ধরনের প্রতিবেদন দেয় অনেকে। এটা নিয়েই বহু ফাঁকির ঘটনা ঘটে। এ জন্য গত বছর থেকে আইসিএবি, আরজেএসসি, এফআরসি, এনবিআর, ব্যাংলাদেশ ব্যাংক একই অডিট রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে, তা সব সমন্বয় করে একীভূত ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রতিবেদনে গরমিল থাকলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এ ধরনের সৃজনশীল সংস্কারের কাজ করতে হবে। (বাকি অংশ আগামীকাল পড়–ন)

ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়