দেয়ালচাপা পড়ে শ্রমিক নিহত

আগের সংবাদ

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

পরের সংবাদ

ভোরের কাগজের ৩২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী : গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের সামনে চ্যালেঞ্জ কী? প্রত্যাশাই বা কী? ভোরের কাগজের ৩২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ সাক্ষাৎকারে নিজস্ব অভিমত তুলে ধরেছেন দেশের চার বিশিষ্ট নাগরিক। তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন সিনিয়র রিপোর্টার ঝর্ণা মনি।

শাহরিয়ার কবির, সভাপতি, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি
বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় সমস্যা এবং রাষ্ট্রের সমস্যা প্রায় একই। রাষ্ট্রের ৫৩ বছর হয়ে গেছে, এখনো আমরা মীমাংসা করতে পারিনি রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক কে? সংবিধানের বলা হয়েছে রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। সংবিধানে রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্র কোন পথে যাবে- দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্র কি সংবিধান মানছে? আমাদের সাংবিধানিকভাবে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। সাংবিধানিকভাবে বলা হয়েছিল বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক, ধর্ম নিরপেক্ষ। রাষ্ট্র কি এখন সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে? সমস্যা হচ্ছে রাষ্ট্র বিভাজিত। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং বিপক্ষে। এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক- স্বাধীনতাবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি এখনো রাজনীতি করছে। সেই রাজনীতি করার জন্য তারা যথেষ্ট বন্ধুও পাচ্ছে। আমরা ৩২ বছর আন্দোলন করেছি জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের জন্য। বঙ্গবন্ধু এদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। এদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল হয়েছে। কিন্তু বন্ধ হয়নি। এমন পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যমকে কাজ করতে হচ্ছে। ফলে গণমাধ্যমেও বিভাজিত রাজনীতি প্রতিফলিত হচ্ছে।
আবার কিছু কিছু গণমাধ্যম তথাকথিত নিরপেক্ষ সাজে। মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে কোনো নিরপেক্ষতা নেই। হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নতুবা বিপক্ষের। যারা নিরপেক্ষ সাজে তারা কার্যত বাংলাদেশের বিপক্ষে কাজ করে। সত্য আর মিথ্যার মধ্যে নিরপেক্ষতার জায়গা নেই। এই জায়গায় ভোরের কাগজ দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। এজন্য ভোরের কাগজকে আমাদের অভিনন্দন। আমরা চাই, ভোরের কাগজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আরো অনেক দূর এগিয়ে যাক।
এই বাংলাদেশকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের যে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর যে দর্শনের বাংলাদেশ, যা বাহাত্তরের সংবিধানে প্রতিফলিত হয়েছিল, সেই দর্শনের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরকারের সব কার্যকলাপ- বৈদেশিক নীতি, শিক্ষানীতি, সামাজিক নীতি- সব ক্ষেত্রে এই আদর্শের প্রতিফলন হতে হবে। এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করবে গণমাধ্যম।
আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিরোধী শক্তিরা জেহাদ শুরু করেছে। মৌলবাদী অপশক্তি, পাকিস্তানপন্থিরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জেহাদ করছে। এর মোকাবিলায় সরকার দৃশ্যমান কিছুই করছে না। এসব ক্ষেত্রে গণমাধ্যম প্রতিবেদন করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। নারীর বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে যেসব বাড়াবাড়ি হচ্ছে- এসব ব্যাপারে গণমাধ্যমকে সোচ্চার হতে হবে। ওয়াজের নামে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার প্রচারে সারাদেশ সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। এতে লাখ লাখ টাকার ব্যবসা চলছে। এর উৎস কোথায়? এদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না? এসব বন্ধে গণমাধ্যমকে আয়না হিসেবে কাজ করতে হবে। কারণ একমাত্র ভরসা আমাদের গণমাধ্যম। গণমাধ্যমে আমরা আমাদের কথা বলতে পারছি। মানুষের কাছে সত্যিকার তথ্য তুলে ধরতে পারছি।

অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন, ইতিহাসবিদ, গবেষক
গণমাধ্যমে এখন সমস্যা হচ্ছে- একই সংবাদ বিভিন্ন মাধ্যমে অর্থাৎ বিভিন্ন পেপারে বিভিন্ন রকম। চোখের সামনে দশটি পত্রিকা রাখা হলে দেখা যাবে একটি সংবাদ বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তারা নিজেরা নিজেদের মতো করে অ্যাঙ্গেলভিত্তিক করে ব্যাখ্যা করেছে। ফলে ট্রু ফ্যাক্টস পাওয়া যায় না। অন্যদিকে পত্রিকা দেখলেই বুঝতে পারি তাদের মালিকপক্ষ কী চান। কেউ কেউ আবার আরেকপক্ষের বিরুদ্ধে সবসময় লেগেই থাকেন। এতে আমরা হয়তো অনেকের থলের বিড়ালের তথ্য পাই; কিন্তু এটি সুস্থতার লক্ষণ নয়। আবার আগে সম্পাদকরা প্রথম পাতায় কিংবা শেষ পাতায় মাঝেমধ্যে বিশেষ সম্পাদকীয় লিখতেন। এখন এর বদলে মালিক-সম্পাদক শ্রেণি তৈরি হয়ে তাদের লেখা কম বরং ছবি বেশি দেখা যায়। শুধু তাই নয়, কে কোন গ্রুপ করছেন, কে কত স্তুতি করছেন, সেসবই বেশি। ফলে সুষ্ঠুতা বিরাজ করছে না। এসব আগে ছিল না।
পাঠক হিসেবে আমরা শুধু বিনোদন কিংবা খেলার সংবাদই পড়বো এমনটা নয়। এর বাইরের সংবাদকেও গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। অনুসন্ধানীমূলক প্রতিবেদন খুব কম। আগে অনুসন্ধানীমূলক প্রতিবেদন বেশি হতো। এখন অনেক কম হচ্ছে। অন্যদিকে একটি বিশেষ ধর্মকে গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ পাতা আমরা চাই না। সবার জন্য সমান হওয়া উচিত। এছাড়া আমরা আশা করব, সংবাদের মেদ না বাড়িয়ে আসল বিষয়টি তুলে ধরবে গণমাধ্যম। গুরুত্বহীন সংবাদকে গুরুত্বপূর্ণ করে প্রচার বা প্রকাশ করা, আবার অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদকে গুরুত্বহীন করে উপস্থাপন করার প্রবণতা বন্ধ করা উচিত।
প্রতিষ্ঠার পর ভোরের কাগজ সংবাদের ভারসাম্য রক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারা অব্যাহত রেখে এগিয়ে যাক ভোরের কাগজ।

অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ দুটি প্রত্যয়ের বিশেষ করে ডিজিটাল বাংলাদেশের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি দিকই রয়েছে। ইতিবাচক দিক হচ্ছে আমরা হাতের মুঠোয় খবর পাচ্ছি। কোর্ট থেকে প্যারিফ্যারি পর্যন্ত নিউজ চলে যাচ্ছে। কিন্তু নিউজগুলো যেন বস্তুনিষ্ঠ হয়। যে খবরটা যাচ্ছে, এখন কিন্তু ডিজিটাল যুগে মানুষের কাছে যে খবরটা যাচ্ছে, তার গ্রহণযোগ্যতাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ যদি না যায়, মানুষের মধ্যে তাহলে বিভ্রান্ত তৈরি হবে। অপতথ্য যেন না যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার।
মানুষের দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো, এই যে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, এগুলো নিয়ে নিউজ হওয়া উচিত। কেন দ্রব্যমূল্য বাড়ছে, কেন প্যারিফ্যারিতে একজন কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না, অথচ সেটি একশ গুণের চেয়ে বেশি হয়ে যাচ্ছে যখন বাজারে আসছে, বিশেষ করে রাজধানীর বাজারে আসছে। এই যে কমিউনিকেশন গ্যাপ, বাজারের যে গ্যাপ, মধ্যসত্ত্ব শ্রেণি- এদের নিয়ে নিউজ হওয়া উচিত। এটি একটি উদাহরণ মাত্র। দৈনন্দিন বিষয়গুলো নিয়ে অবশ্যই নিউজ হওয়া উচিত।
ডিজিটাল বিষয়গুলোর মধ্যে যাদের হাতে স্মার্ট ফোন আছে, তারা সেই সুবিধা পাচ্ছে। ডিজিটালাইজেশনের সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে। কিন্তু বাংলাদেশের অনেকের কাছে স্মার্ট ফোন নেই। অনেকেই বাটন ফোন ব্যবহার করেন। তাদের কাছে ল্যাপটপ নেই বা একটা ট্যাব নেই। এদেরকে আমাদের টার্গেট করতে হবে। স্কুলগুলো বিশেষ করে গ্রামের স্কুলে ডিজিটাল ইনভেস্টমেন্ট বেশি জরুরি। এখানে যে ঘাটতি রয়েছে, সেসব বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করা নিয়ে গণমাধ্যম বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
নারী-পুরুষ বৈষম্য রয়েছে তা তুলে ধরা, ডিজিটাল ডিভাইসও নারী-পুরুষের বৈষম্য করছে কখনো কখনো সেসব বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন করা দরকার। দলিত, হরিজন শ্রেণি, থার্ড জেণ্ডার, ট্রান্স জেণ্ডার, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ বৈষম্য দূরীকরণ, সমবন্টন, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে ভোরের কাগজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এক্ষেত্রে ভোরের কাগজসহ প্রতিটি গণমাধ্যমকেই আরো সোচ্চার হওয়া উচিত।

অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
গণমাধ্যমের অনেক চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রিন্ট মাধ্যমের। কারণ বর্তমান যুগে প্রিন্ট মাধ্যম বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে গেছে। এখন ডেটা ডিজিটাল, অনলাইন- এসব দিকে মানুষ বেশি ঝুঁকে গেছে। এমনকি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও এখন খুবই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আগে গতানুগতিক যেসব মাধ্যম ‘মেইন স্ট্রিম’ মাধ্যম হিসেবে পরিচিত ছিল, যেসব মাধ্যমগুলো ছাড়া মানুষের দিন অচল ছিল, ওইদিন পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন সময়ের সঙ্গে, যুগের সঙ্গে পরিবর্তন হয়ে পাল্লা দিয়ে গণমাধ্যমকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। সামনের পৃথিবী হয়তো মোবাইল ফোনে, অনলাইন, ফেসবুক, ইউটিউব, ওদিকে চলে যাবে।
ডিজিটাল দিকে তাল মিলিয়ে অনেক কাগজও কিন্তু অনলাইন ভার্সন করছে। ইউটিউবে নিউজ ও ভিডিও আপলোড করছে। স্টুডিও বানাচ্ছে। এসব কাজ করলে অবশ্যই ভোরের কাগজসহ অন্যান্য প্রিন্ট মিডিয়া টিকে থাকবে। যারা করতে পারবে, তারা ভালো করবে আর যারা পারবে না, তাদেরকে দূরে সরে যেতে হবে।
আর গণমাধ্যমের কাছে প্রত্যাশা অনেক। মাধ্যম যাই হোক না কেন, পেপার, টেলিভিশন, অনলাইন কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হোক তা যেন নিরপেক্ষ হয়। বস্তুনিষ্ঠ হয় এবং সত্য হয়। এই তিনটা বিষয় আমি চাই। যথার্থ রিপোর্ট আমি চাই। যথার্থ লেখা আমি চাই। বস্তুনিষ্ঠ এবং পক্ষপাতমুক্ত প্রতিবেদন চাই। এছাড়া অনুসন্ধানীমূলক সাংবাদিকতার ঘাটতি রয়েছে আমাদের। ভালো অনুসন্ধানী রিপোর্ট আমরা চাই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়