পাঠ্যবই থেকে বিতর্কিত দুই লাইন প্রত্যাহারের আহ্বান চুন্নুর

আগের সংবাদ

চাঁদাবাজির লাইসেন্স ‘ইজারা’

পরের সংবাদ

ট্রান্সজেন্ডার বিতর্ক এবং শরীফা প্রসঙ্গ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আইটিভির এক প্রেজেন্টারকে (চযরষষরঢ় ঝপযড়ভরবষফ) চাকরিচ্যুত করা হয়েছে গত বছর দুয়েক আগে। সেই প্রেজেন্টারের দোষটা ছিল, তার বয়সের চেয়ে অনেক জুনিয়র এক ছেলে-বন্ধুর সঙ্গে তার সম্পর্কের বিতিকিচ্ছিরি চাউর হওয়া। তার সম্পর্কটা দোষণীয় নয়, কারণ তা ব্রিটেনের আইনবহির্ভূত কিছু ছিল না। তবে তিনি সত্যটা লুকিয়ে ছিলেন এবং সে জন্য ‘দিজ মর্নিং’, ‘ডেন্সিং অন আইস’ এবং ‘দি ব্রিটিশ সোপ অ্যাওয়ার্ড’ অনুষ্ঠানগুলো থেকে তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। একজন হাইপেইড অর্থাৎ উচ্চ বেতনসম্পন্ন সেলিব্রিটি হিসেবে তিনি ব্রিটেন তথা পশ্চিমা গণমাধ্যমে পরিচিত ছিলেন।
এই প্রেজেন্টার আরো একটা কারণে গণমাধ্যমসহ তার অনুরাগী কিংবা দর্শকদের কাছে আরো পরিচিতি লাভ করেন। আর তা হলো আড়াই দশকেরও অধিক সময় বিবাহিত জীবন পেরিয়ে এসে তিনি নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন অন্য একটা জায়গায় এবং সেটা হলো তিনি নিজেকে সমকামী হিসেবে ভাবতে থাকেন এবং এখন তিনি ছেলে-বন্ধু নিয়েই আছেন।
এ রকম ব্যাপার পশ্চিমা সমাজে নতুন কিছু নয়, এক ধরনের বিকৃতি কিংবা সমলিঙ্গের প্রতি মেকি আকর্ষণ থেকেই নিজেরা এই গোত্রের না হয়েও তারা কিংবা সমকামীদের একটা বিরাট অংশ এখন নিজেদের এই গোত্রের বলে দাবি করে। ম্যানচেস্টারে প্রতি বছর একটা বিশাল ফেস্টিভ্যাল হয় এই রেইনবো প্রতীকের মানুষগুলো নিয়ে। এতে ছেলেরা মেয়ে সেজে এবং মেয়েরা ছেলে সেজে জোড়ায় জোড়ায় সারা শহর চষে বেড়ায়। হাজার হাজার নারী-পুরুষ এতে অংশ নেয়। সারা শহরটা উৎসবমুখর হয়। সমকামীদের প্রতি যে বিরূপ মন্তব্য ওঠে না, তা নয়। ঘৃণার বহিঃপ্রকাশও ঘটে। লাখো মানুষের ভিড়ে হাজার হাজার সমকামীর এই উৎসব ম্যানচেস্টারের জন্য এক বিশাল বৈচিত্র্য আনে, আনে ব্যবসার এক ভালো সাফল্য। আলোচনার শুরুতেই হাজারো ঘটনার মাঝে একজন সেলিব্রিটির কথাই উল্লেখ করেছি, যিনি হঠাৎ করেই নিজেকে সমকামী বিবেচনা করেছেন এবং ২৭ বছরের বিবাহিত জীবন শেষে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন একই লিঙ্গের অর্থাৎ সমলিঙ্গের গোত্রীয় হিসেবে এবং সে জন্যই ষাটোর্ধ্ব বয়সে পুরুষের সঙ্গে ঘর করা শুরু করেছেন। এটা হলো তার পছন্দ, ইংল্যান্ড কিংবা পশ্চিমা ধারায় এটা তার অধিকার। আর সে জন্যই আমার মনে হয়েছে পশ্চিমা সমাজে এ এক বিকৃত মনোবৃত্তি কিংবা বিকৃতির চাষাবাদ।
যুক্তরাজ্যে কনজারভেটিভ সরকারের (ডেভিড ক্যামেরুন) আমলেই সমকামীদের বৈধতা দেয়া হয়েছে এবং সমগোত্রীয়দের বিয়েও বৈধ করা হয়েছে। কিন্তু ওই একই টোরি সরকার এখন ক্ষমতায়। প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক এ আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি না দেখিয়ে তিনি শুধু বলছেন ‘পুরুষ পুরুষই এবং নারী নারীই … এটা একটা কমন সেন্স’। একইভাবে স্কটল্যান্ডের ফাস্ট মিনিস্টারও সমকামীদের নিয়ে বিরূপ সমালোচনা করেছেন। কিন্তু আইনের বৈধতা নিয়ে তারা কেউই কোনো প্রশ্ন তোলেননি।
কথা হলো, সমকামী এবং ট্রান্সজেন্ডার কি স্বগোত্রীয়? ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুটাতো ভিন্ন… ট্রান্সজেন্ডার কিংবা হিজড়া হলো সেসব ব্যক্তির একটি পরিচয়, যাতে তাদের লিঙ্গ পরিচয়, লিঙ্গ অভিব্যক্তি বা আচরণ সাধারণত সেই লিঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা তাদের জন্মের সময়ই নির্ধারিত অথচ তা লুকানো থাকে বছরের পর বছর। লিঙ্গ পরিচয় বলতে একজন ব্যক্তির পুরুষ, মহিলা বা অন্য কিছু হওয়ার অভ্যন্তরীণ অনুভূতি বোঝায়। লিঙ্গ অভিব্যক্তি বলতে বোঝায় একজন ব্যক্তির সেসব বৈশিষ্ট্য, যার মাধ্যমে তার আচরণ, পোশাক, চুলের স্টাইল, কণ্ঠ বা শরীরের বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে অন্যদের কাছে লিঙ্গ পরিচয় জানান দেয়া। এখন ইউরোপ কিংবা পশ্চিমা সমাজের একটা অংশের একজন পুরুষ কিংবা নারী নিজেকে এই গোত্রের একজন হিসেবে ছেলে যেমন মেয়েদের মতো পোশাক পরে মেয়েও ছেলেদের মতো আচরণ করে। যুক্তরাজ্যে ট্রান্সজেন্ডার নয়, সমকামী মানুষগুলোর সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই আছে এবং ধারণা করা হয় এ সংখ্যা ৫ লাখের কাছাকাছি। এদের একটা প্রধান অংশের এই সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত হওয়া বাহ্যত এ এক মেকি অভিনয়।
কারণ এরা অনেকেই হিজড়া শ্রেণির মানুষ নন। তবে বলতে দ্বিধা নেই, সেই যে জন্ম থেকে পাওয়া ট্রান্সজেন্ডারের মানুষগুলোর মাঝে এ রকম লোক দেখানো কোনো মেকি আচরণ থাকে না, তাদের আচরণটা থাকে জন্মগত। পৃথিবীজুড়েই এ রকম ব্যক্তি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন এবং সমাজ এদের মেনে নিয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এ নিয়ে কথাবার্তা উঠলেও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ট্রান্সজেন্ডার পরিচয় থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের উচ্চ আসনগুলোতে তাদের যোগ্যতায়ই জায়গা করে নিয়েছে।
উল্লেখ করা যায়, ভারতে জয়িতা মণ্ডল নামের ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি প্রথম বিচারকের আসনেও বসেছেন এবং সেখানে এখন পর্যন্ত বিচার ব্যবস্থায় অন্তত তিনজন একই শ্রেণির মানুষ আছেন। ২০২৩-এর এক হিসাব অনুযায়ী, ১১ হাজারেরও বেশি হিজড়া শ্রেণির মানুষ এখন ভারতে বসবাস করছেন। বাংলাদেশেও অন্তত ১০ থেকে ১১ হাজার ওই শ্রেণির মানুষ আছেন। এর মাঝে নজরুল ইসলাম রীতু নামে একজন জনপ্রতিনিধিও (ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান) আছেন। তবে এর বাইরে কতজন ট্রান্সজেন্ডার মানুষ আছেন, তা এখনো অজানা। আর এই হিসাবে আমাদের মেনে নিতেই হবে, বাংলাদেশে তথা ভারত উপমহাদেশে ট্রান্সজেন্ডার এ সমাজের ক্ষুদ্র হলেও এক অপরিহার্য অংশ।
সে জন্য বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা কোনো অযৌক্তিক বাচালতা নয়, সমাজ-সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশকে স্বীকৃতি দিয়ে এদের বাংলাদেশের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলাটা রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের নিয়ে বিভিন্ন এলাকায়ই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অপ্রীতিকর-বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন মানুষজন। কেউ কেউ এ বিষয়গুলো উপভোগ করেন, আবার অনেকেই বিরক্ত হন। অর্থাৎ ট্রান্সজেন্ডার কিংবা হিজড়া ইস্যুটা বহু চর্চিত-উচ্চারিত এবং মীমাংসিত বিষয়। এ নিয়ে বাংলাদেশে প্রশ্ন তোলা বিবেকহীনতার সমান।
সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ‘শরীফ থেকে শরীফা’ নিয়ে যে গল্পটি উপস্থাপন করা হয়েছে, তা হিজড়া সমাজকে মূলত তুলে ধরার একটা প্রয়াস। সারাদেশেই হিজড়াদের নিয়ে যে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন মানুষ, তাদের ব্যাপারে শিশুমনে বিরূপ মনোবৃত্তি যাতে দানা না বাঁধে তার একটা সচেতনমূলক বাস্তবতার চিত্র এটা।
ধর্মীয় দিক থেকে সমকামিতা পাপ কিন্তু ট্রান্সজেন্ডারতো সমকামিতার অংশ নয়। সত্য কথা হলো, এতে সমকামিতাকে বৈধতা দেয়াতো দূরের কথা, এখানে এ বিষয়ে কোনো কথাই উচ্চারিত হয়নি। বরং সমাজের অবহেলিত একটা অংশের করুণ বাস্তবতাকেই এখানে জায়গা করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝোড়ো হাওয়া বইয়ে দিয়েছেন কতিপয় মানুষ কিংবা একটা গোষ্ঠী। আমার বিশ্বাস, এই ঝড়ে যারা আরো হাওয়া লাগাচ্ছেন, তাদের অনেকেই এ গল্পটি পড়েননি কিংবা পড়লেও অহেতুক একটা সাম্প্রদায়িক ঝটিকা বাতাস বইয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালিয়েছেন।
বেগম রোকেয়া যখন সমাজে নারী শিক্ষা কিংবা নারী অধিকার নিয়ে একটা প্রবল ঝড় তুলেছিলেন, সমালোচনার প্রবাহেও এ ঝড়ে একটা পরিবর্তন এসেছিল সে সময়ে, যা এখনো পথ দেখায়। শুধু নারীদেরই নয়, পরিবর্তনকামী যে কোনো প্রগতির চাকায় বেগম রোকেয়ার দেখানো পথ একটা অনুরণন। ‘শরীফ থেকে শরীফার গল্প’ সমলিঙ্গের মানুষদের উচ্ছ¡সিত করার কোনো গল্প নয়, এমনকি সমাজ পরিবর্তনেরও কোনো অঙ্গীকার নয়, শুধু একটা অবহেলিত অংশকে সমাজ-সভ্যতার অগ্রযাত্রায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার একটা সচেতন উপস্থাপন মাত্র।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়