নাশকতা পরিকল্পনার অভিযোগে মুগদা থেকে গ্রেপ্তার ১

আগের সংবাদ

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টেনে তোলার চেষ্টা : সুফল মিলবে কি?

পরের সংবাদ

চাঁদাবাজির লাইসেন্স ‘ইজারা’

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কামরুজ্জামান খান : ভোজ্যতেল, চাল, ডাল, চিনি, মুরগিসহ সব ধরনের পণ্যই উৎপাদন পর্যায় থেকে ভোক্তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত দামে বিস্তর ফারাক রয়েছে। এক্ষেত্রে কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যায় দুই থেকে তিনগুণ। ভোজ্যতেল, চিনি, ডালের দাম সরকার নির্ধারণ করে দিলেও তা মানা হচ্ছে না। দাম বাড়িয়ে অধিক মুনাফার নেপথ্যে কী- ‘গলদ’ কোথায় তা নানাভাবে চিহ্নিত করেছে সরকারের একাধিক সংস্থা। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ও চাঁদাবাজিই ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে অভিযোগ বাড়তে থাকায় ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে সরকার হার্ডলাইনে গেছে। পণ্যের দাম বাড়ানোর নেপথ্যে কারা- তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে মাঠে নেমেছে পুলিশ-র‌্যাবসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজির অভিযোগে র‌্যাব ৬৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরসহ একাধিক সংস্থার ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত রেখেছে। তবে ইজারার নামে বেপরোয়া চাঁদাবজিকে দাম বাড়ার পেছনে বড় সমস্যা মানছেন সংশ্লিষ্টরা।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি হলে তা বন্ধে সংশ্লিষ্ট সবাইকে শক্তভাবে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নজরদারি করতে বলেছেন। নজরদারির ক্ষেত্রে তিনি একটি সুনির্দিষ্ট এরিয়ার কথা বলেছেন। অনেক সময় পণ্যের দামের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজির প্রসঙ্গ আসে। এক্ষেত্রে তিনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে খুবই শক্তভাবে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন, এটি (পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি) যেন কোথাও না হয়।
এর আগে পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের হল অব প্রাইডে অনুষ্ঠিত গত ডিসেম্বরের মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় বলেছেন, একটি চক্র সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে চায়। দাম বাড়া প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সভায় অতিরিক্ত

আইজিপি (প্রশাসন) মো. কামরুল আহসান, অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. আতিকুল ইসলাম, পিবিআইএর অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার, সিআইডির অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ সব মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অংশ নেন। জেলার পুলিশ সুপাররা অনলাইনে সভায় যুক্ত ছিলেন। আইজিপির ওই নির্দেশের পর সারাদেশে দাম বাড়ানোর পেছনের সিন্ডিকেটের খোঁজে নেমেছে পুলিশ।
র‌্যাব মুখপাত্র খন্দকার আল-মঈন বলেছেন, পণ্যবাহী ট্রাকে বিভিন্ন সংগঠন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামে চাঁদাবাজির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অযৌক্তিকভাবে বেড়েছে। ঢাকায় অন্তত পাঁচ থেকে ছয়টি স্থানে পণ্যবাহী ট্রাক থেকে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। খন্দকার মঈন বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়কে পণ্যবাহী গাড়িতে চাঁদাবাজি করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা ইজারাদারদের নির্দেশে কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রতি রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার ওপর অবস্থান নেয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পণ্যবাহী যানবাহন রাজধানীতে প্রবেশের সময় তারা লেজার লাইট, লাঠি ও বিভিন্ন সংকেতের মাধ্যমে গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভারদের কাছ থেকে অবৈধভাবে চাঁদা আদায় করে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা চাঁদা আদায়ের রসিদও দিয়ে থাকে। চালকরা তাদের চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে গাড়ি ভাঙচুর, চালক-হেলপারকে মারধরসহ প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়। তারা প্রতিটি ট্রাক ও পণ্যবাহী যানবাহন থেকে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা আদায় করে থাকে। কখনো সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, কখনো শ্রমিক সংগঠন, কখনো কল্যাণ সমিতি, কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামে এই চাঁদা আদায় করা হয়। চাঁদার টাকা ইজারাদারদের কাছে জমা দেয়। তারা সিন্ডিকেটের মধ্যে টাকা ভাগবাঁটোয়ারা করে। চাঁদা উত্তোলনকারীরা প্রতিরাতে মজুরি হিসেবে ৬০০-৭০০ টাকা পায়। প্রতিটি স্পট থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।
জানা গেছে, পণ্যের দাম বাড়ার নেপথ্যে অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘ইজারা’র নামে চাঁদাবাজি। সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ রাজস্ব খাতের আয়ের জন্য হাট-বাজার ইজারা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে পণ্য পরিবহন থেকেও ইজারার টাকা তোলার কথা উল্লেখ থাকে। পৌর এলাকায় ‘কুলিবিট’ নামে পরিচিতি একটি ইজারা খাতের সঙ্গে পণ্য পরিবহন থেকে টাকা তোলা হয়। পণ্যের দামে এর প্রভাব পড়ে। এমন চাঁদাবাজি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভায় একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। পরে স্বরষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে স্থানীয় সরকার (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়েরও সভা হয়েছে। ঢাকা জেলার ধামরাই পৌরসভার এমন ইজারা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সব পৌরসভায় চিঠি দিয়ে এমন ইজারা না দিতে নির্দেশনা দিয়েছে। এর মধ্যে সড়ক-মহাসড়কের পাশের হাট-বাজার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো ধরনের ইজারা না দিতে নির্দেশনা দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পেয়ে জেলা প্রশাসকরা ইউএনওর পৌরসভায় চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু অনেক পৌরসভা তা আমলেই নিচ্ছে না। প্রতিটি হাট-বাজারে যাওয়া পণ্য পরিবহন থেকে নামালে ‘কুলিবিট’ নামের খাতে চাঁদা দিতে হয়। এটা ওপেন সিক্রেট। আর এই চাঁদার প্রভাব পড়ে পণ্যের দামে। ঢাকার পাশের একটি পৌরসভায় চলমান ইজারার দরপত্রের তালিকার ১৪ নম্বরে থাকা সড়ক-মহাসড়কের উভয় পাশে বিভিন্ন মার্কেট, কাঁচাবাজার, ফলবাজার প্রভৃতি ব্যবসার উদ্দেশে পরিবহন করা মালামাল লোড-আনলোড কুলিবিট (লেবার হ্যান্ডেলিং) দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এর কাক্সিক্ষত দর ধরা হয়েছে এক কোটি ২৮ লাখ ২৬ হাজার টাকা। ভ্যাট-ট্যাক্স মিলিয়ে এর অর্থ দাঁড়ায় এক কোটি ৭০ লাখ টাকা। দরপত্রের দাম ধরা হয়েছে ২৬ হাজার ৪০০ টাকা। পে-অর্ডারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রায় দুই কোটি টাকা অগ্রিম দিয়ে যিনি এই ইজারা পাবেন তাকে বছর ধরে লভ্যাংশসহ টাকা তুলতে হয়। যার প্রভাব পড়ে পণ্যের বাজারে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে দেশের প্রায় সব বাজারেই এমন ইজারা চালু থাকায় পণ্যের দামে এর প্রভাব পড়ছে। মন্ত্রণালয় নিজেদের আয়ে-ব্যয় সামলাতে বলায় পৌরসভাগুলো এমন উদ্ভট খাত বানিয়ে ‘ইজারার নামে চাঁদাবাজির বৈধ লাইসেন্স’ দিচ্ছে। এমন পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশ-র‌্যাব অভিযানে নেমে হোচট খেয়েছে একাধিকবার। অভিযানকালে ইজারাদার অনুমোদনের কাগজ নিয়ে হাজির হলে বিপাকে পড়ছে পুলিশ-র‌্যাব।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়