ঢাকার জিনজিরা : বিয়ের পরদিনই বরের মৃত্যু

আগের সংবাদ

তৃণমূলে কোন্দল বাড়ার শঙ্কা

পরের সংবাদ

কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ও জোহরা বেগম কাজী

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চিকিৎসাবিজ্ঞানে নারীর যাত্রাপথ ইউরোপেও কণ্টকাকীর্ণ ছিল, ভারতে তো বটেই। পুরুষের বেলাতেই যেখানে মানুষে মানুষে ছোঁয়াছুঁয়ির প্রশ্নে পাপ-পুণ্যের প্রশ্ন জড়িত হয়ে পড়েছিল, পরিশুদ্ধ হওয়ার আচারও মানতে হয়েছে, হরেক রকমের বর্ণবাদ চর্চাই সমাজ নির্মাণের মৌল কাঠামো হয়ে পড়েছিল, সেখানে নারীর বেলাতে বৈষম্য কতটা প্রকট তা অনুমেয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম বছর ১৮৬১-তেই কাদম্বিনী বসুর জন্ম। কিন্তু নারীর জন্য সে সময়টা কেমন ছিল তা বুঝতে কাদম্বিনীকে নিয়ে লেখা মোহাম্মদ আলী খানের গ্রন্থে উদ্ধৃত মায়াসুন্দরীর ১৮৭৫ সালের উদ্ধৃতিটি যথার্থ : ‘আমরা কী কুক্ষণেই নারী হইয়া এই বঙ্গদেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছি… আমরা রীতিমতো লেখাপড়া শিখিতে পাই না। ইদানীন্তন আমাদের মধ্যে বিদ্যার অঙ্কুর উঠিতে আরম্ভ করিয়াছে বটে কিন্তু সমাজের কু-নিয়মবশত তাহা অঙ্কুরাবস্থায় থাকিয়া যায়। পিতামাতা কন্যাদিগকে বিদ্যালয়ে প্রেরণ করেন বটে। কিন্তু সেরূপ বিদ্যালয়ে দেয়া আর না দেয়া দুই সমান। দশ বছর হইতে না হইতেই বিদ্যালয় হইতে ছাড়ানো হইল, কেন কন্যাটির এখন বিবাহের সময় উপস্থিত।’
একই সময়ে বামাবোধিনী পত্রিকায় গৃহল²ীর কাছে প্রত্যাশার একটি অসম্পূর্ণ তালিকা দেয়া হয়েছে : কায়মনোবাক্যে স্বামীর সেবাদাসী, ‘তাঁহার বিপদ-তরঙ্গে তরুণী, তাঁহার শোক-ব্যথায় সন্তাপ-হারিনী, তাঁহার রোগ-শয্যায় স্বাস্থ্যরক্ষিণী, আলাপনে পরিতোষিনী, তাঁহার ক্ষুধাতৃষ্ণায় তৃপ্তিদায়িনী, তাঁহার ক্লেশ-চিন্তায় শান্তিবিধায়িনী, ধর্মানুষ্ঠানে শুভার্থিনী, পুণ্যকর্মে সহধর্মিণী…।’ তাকে রন্ধনশৈলীতে শীর্ষে থাকতে হবে, তাকে দাসী, প্রেমানন্দময়ী, শান্তিপ্রদায়িনী, পুত্রব্রতশীলা, সুশীলা সঙ্গিনী, দময়ন্তী, শিবানী, গৃহিণীসহ এমন আরো কয়েক ডজন গুণের আধার হতে হবে। কিন্তু তাকে পড়াশোনা করে চাকরি-বাকরি করতে হবে, সংসারের দায়িত্ব নিতে হবে এমন প্রত্যাশা তার কাছে কারোরই নেই। তাছাড়া নারীর কাছে প্রত্যাশার যে ফিরিস্তি তা পূরণ করতে গেলে তার পড়াশোনা করার সুযোগই বা কোথায়!
বাংলাদেশের বরিশালের ব্রজকিশোর বসুর কন্যা কাদম্বিনীর জন্ম ও শৈশব ভাগলপুরেই, ১৩-১৪ বছরে এলেন কলকাতায়, মিস এনেট সুসানাহ অ্যাক্রয়েড পরিচালিত হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন নারী শিক্ষার আংশিক সমর্থন করলেও তাদের বিজ্ঞান, জ্যামিতি এবং এমনকি লজিক পড়ার যৌক্তিকতা অস্বীকার করেন। স্কুল স্থাপনে উদ্যোক্তাদের একজন ৩১ বছর বয়সি দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী কাদম্বিনীর প্রতি আকৃষ্ট হন। অন্যত্র তার বয়স ২৯ বছর ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মিস অ্যাক্রয়েডকে সহযোতিায় আরো এগিয়েছেন : শিবনাথ শাস্ত্রী, দুর্গামোহন দাস, আনন্দমোহন বসু, ভগবান চন্দ্র বসু, মনমোহন ঘোষ, অন্নদাচরণ খাস্তগীর প্রমুখ।
গ্রন্থকার মোহাম্মদ আলী একটি কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য দিয়েছেন- এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিস অ্যাক্রয়েড ১৮৭৫ সালে বাংলাদেশের বাকেরগঞ্জের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হেনরি বেভারিজকে বিয়ে করেন এবং পরের বছর মার্চ মাসে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাকেরগঞ্জ চলে আসেন। বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যায়। (এই তথ্যে পরের বছর বাকেরগঞ্জ চলে আসা অংশটি সম্ভবত সঠিক নয়, কারণ ১৮৭৫ সালেই ই আই বার্টন হেনরি বেভারিজের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। হেনরি বেভারিজ ১৮৭০-এর শুরু থেকে ১৮৭৫-এর কোনো এক সময় পর্যন্ত ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেন।)
কাদম্বিনী এলেন বেথুন স্কুলে। জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন (১৮০১-১৮৫১) প্রতিষ্ঠিত স্কুল ভারতে নারী শিক্ষায় জাগরণ এনেছে। কাদম্বিনী বসু ১৮৭৮ শিক্ষাবর্ষের এনট্র্যান্স পরীক্ষার্থী, আগে কখনো কোনো নারী এই পাবলিক পরীক্ষায় বসার ‘ধৃষ্টতা’ দেখাননি। দেখাবেই বা কেমন করে- কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রিত এই পরীক্ষা দেয়ার কোনো সুযোগই নেই। একই সময়ের আর একজন নারী শিক্ষার্থী চন্দ্রমুখী বসুও (১৮৬০-১৯৪৪) পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু তার দেরাদুন নেটিভ খ্রিস্টান গার্লস স্কুলের অধ্যক্ষ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা মেয়েদের জন্য উন্মুক্ত নয়’। তারপরও অধ্যক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়কে লিখলেন, বিশেষ অনুমোদন নিয়ে চন্দ্রমুখী বসু পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলেও তার নাম দাপ্তরিকভাবে গেজেটভুক্ত হলো না, তিনি সার্টিফিকেট পেলেন না। একই সংগ্রামে নামলেন কাদম্বিনী বসু, তার পেছনে শক্তিদাতা এবং তার হয়ে লড়াই করা মানুষটি হচ্ছেন দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী।
সে সময় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আর্থার হবহাউস (১৮১৯-১৯০৪)। অক্সফোর্ডের স্নাতক এবং লিঙ্কনস ইন-এর ব্যারিস্টার; হবহাউস ১৮৭৫ থেকে ১৮৭৭ ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন শেষে নাইটহুড লাভ করেন। প্রগতিশীল এই মানুষটি কাদম্বিনীর জন্য পরীক্ষার দরজা খুলে দিলেন এবং তা কার্যত ভারতের নারী সমাজের জন্যই খুলে গেল। কিন্তু তারপরও প্রতিটি স্তরেই বাধা অপসারণ করে তাকে পরীক্ষায় বসতে হলো।
এনট্র্যান্সে বসার কথা ছিল কাদম্বিনী আর সরলা বসুর। সরলার মায়ের মৃত্যু হলো, বিয়ের সমন্ধও এলো, তিনি চিকিৎসক পাত্রের স্ত্রী সরলা রায় হয়ে গেলেন। কাদম্বিনী পরীক্ষায় পাস করাটা সমাজের কম গাত্রদাহের সৃষ্টি করেনি। গ্রন্থকার ২২ সেপ্টেম্বর ১৮৭৭-এর সমাচার চন্দ্রিকা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন : ‘…কিন্তু তাহাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি লইয়া যে কি ফল হইবে, বলিতে পারি না। বাঙালি মেয়েরা কি বিএল পরীক্ষা দিয়া আদালতে ওকালতি করিবেন? আমরা দেখিতেছি ইংরেজি সভ্যতা প্রবেশ করাতে এদেশের সর্র্বনাশ হইল।’
সংবাদ প্রভাকর কাদম্বিনীর পরীক্ষা পাসের পর ৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৯ লিখেছে : …আমরা জিজ্ঞাসা করি যে শ্রীমতি কাদম্বিনী এক্ষণে কোন বিদ্যালয়ে পড়িবেন? যুবকদিগের সহিত কোন কলেজে পাঠ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব এবং অন্য বিদ্যালয়ই বা কোথায়?
কাদম্বিনীকে সগর্বে ধারণ করতেই বেথুন স্কুল কলেজে পরিণত হলো। তিনি এফ এ পরীক্ষা দেবেন। শিক্ষার্থী মাত্র একজন। লেফটেন্যান্ট গভর্নর বেথুন কলেজ চালাতে অর্থও বরাদ্দ করলেন। কেবল এফএ নয় কাদম্বিনী ও চন্দ্রমুখী ১০ মার্চ ১৮৮৩ সমাবর্তন উৎসবে বিএ ডিগ্রির সার্টিফিকেটও পেলেন। এপ্রিলে বামাবোধিনী লিখল : ভারতেতিহাসের সর্বপ্রথম মহানন্দকর এ ঘটনাটি স্বর্ণাক্ষরে খেদিত হউক- গত ১০ মার্চ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিদান মহাসভায় কুমারী কাদম্বিনী বসু ও কুমারী চন্দ্রমুখী বসু বিএ উপাধি দ্বারা ভূষিত হইয়াছেন।
কাদম্বিনী ডাক্তার হবেন। তিনি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন ২৩ জুন ১৮৮৩ (২৩ জুন তারিখটা বাঙালির জন্য বেদনার্ত দিন, এ দিন তারা পলাশীতে ১৯০ বছরের জন্য স্বাধীনতা হারায়) শিক্ষকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নারীর মেডিকেল শিক্ষার বিরোধী, সহপাঠী ছাত্ররাও মেনে নিতে পারছেন না। প্রধান বিরোধী বিলেত থেকে এমআরসিপি ও এফআরসিএস করে আসা ইংরেজ পতœীর স্বামী অধ্যাপক রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ।
এর মধ্যে কাদম্বিনী দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর সঙ্গে সংসার শুরু করেন, সন্তানের জননী হন এবং পড়াশোনাও অব্যাহত রাখেন। তিন বছরের মাথায় প্রথম এমবি পরীক্ষাতে অধ্যাপক রাজেন্দ্রচন্দ্র তাকে পাস নম্বরের চেয়ে এক নম্বর কম দিয়ে ফেল করিয়ে দেন। কলেজের অধ্যক্ষ কাদম্বিনীর রিভিউ পিটিশন গ্রহণ করেন। তিনি পঞ্চম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিলেন। এবারো সেই একই অধ্যাপক তাকে ফেল করালেন। পুরুষশাসিত সমাজের প্রতিনিধি হয়েই যেন অধ্যাপক এই পরিশ্রমী ছাত্রীকে মনে করলেন তার প্রতিপক্ষ। প্রিন্সিপাল তার নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগ করে কাদম্বিনীকে গ্র্যাজুয়েট অব দ্য মেডিকেল কলেজ অব বেঙ্গল ডিগ্রি প্রদান করলে তার প্র্যাকটিস করার সুযোগ সৃষ্টি হলো।
প্রথম বাঙালি নারী ম্যাট্রিকুলেট, প্রথম এফএ, প্রথম বিএ এবং প্রথম ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৩ উচ্চশিক্ষার জন্য জাহাজযোগে আমেরিকা যাত্রা করলেন। তবে ইংল্যান্ডে পৌঁছেই এডিনবরা রয়াল কলেজ অব সার্জনসে ট্রিপল ডিপ্লোমা পরীক্ষায় বসার সিদ্ধাই নিলেন। তিনি পরীক্ষায় বসলেন, ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হলেন। আমেরিকা না গিয়ে প্রার্থিত ডিগ্রি হয়ে যাওয়ায় ১৬ নভেম্বর ১৮৯৩ কলকাতায় ফিরে আসেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দেশ তাকে স্বাগত জানায়নি। উপযুক্ত পদে গ্রহণ না করে তাকে ইডেন হাসপাতালের আউটডোর বিভাগে দায়িত্ব দেয়া হয়। শ্রম ও দক্ষতায় অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলের স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যার প্রথম ভারতীয় নারী অধ্যাপকের পদটি তিনি অলঙ্কৃত করলেন। ক্রমাগত বাধা ঠেলতে ঠেলতে ক্লান্ত হয়ে এক সময় চাকরি ছেড়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করলেন। পরবর্তী কর্মজীবনে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হন- কংগ্রেস অধিবেশনে প্রথম ভারতীয় নারী বক্তাও তিনি। ৩ অক্টোবর ১৯২৩ মাত্র ৬২ বছর বয়সে প্রথম বাঙালি নারী ডাক্তার প্রয়াত হন।
১৮৮৬-এর মার্চে ফিলাডেলফিয়া উইমেন্স মেডিকেল কলেজ থেকে এমডি ডিগ্রি নিয়ে ভারতে ফিরে আসা আনন্দীবাই গোপালরাও যোশী, ভারতের প্রথম নারী চিকিৎসক, কিন্তু তিনি ফিরে এলেন য²ায় আক্রান্ত হয়ে। তার আগে ১৪ বছর বয়সে নিজের ১০ দিন বয়সি শিশু সন্তানের মৃত্যু তাকে প্রত্যক্ষ করতে হয়। তারপরও তিনি ভাগ্যবান কাদম্বিনীর মতো বাঙালি ভারতীয়দের উপেক্ষার শিকার হননি। তার সঙ্গে মেডিকেল গ্র্যাজুয়েট হন কিওকি ওকামি এবং সাবাত ইসলাম যথাক্রমে জাপান ও সিরিয়ার প্রথম নারী চিকিৎসক। আনন্দীবাই গোপালরাও যোশী ভারতের প্রিন্সলি স্টেট কোলাপুরের আলবার্ট এডওয়ার্ড হাসপাতালের ফিমেল ওয়ার্ডের প্রধান নিয়োজিত হলেন। পরের বছর ২২ পূর্তির আগেই ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৭ তিনি য²ায় পুনাতে মৃত্যুবরণ করেন।
প্রথম জাপানি চিকিৎসক আনন্দীবাই যোশীর তিন বছরের জুনিয়র কিওকি ওকামি (১৮৫৯-১৯৪১) পাশ্চাত্যের মেডিসিনের ডিগ্রি নিয়ে স্বদেশ জাপানে ফিরলেন এবং নৌবাহিনীর একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক তাকাকি কানেহিরোর আমন্ত্রণে জিইকি হাসপাতালে যোগ দিলেন। কিন্তু তিনি নারী বলে সম্রাট মাৎসুহিতো তার চিকিৎসা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তা ওকামির আত্মসম্মানে আঘাত করে। তিনি পদত্যাগ করে টোকিওর মিনাটোতে নিজেই ক্লিনিক খুলেন এবং স্ত্রীরোগের চিকিৎসা দিতে থাকেন। তিনি য²া রোগীদেরও চিকিৎসা করতেন। এক সময় প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করে দেন এবং শিক্ষকতা শুরু করেন। কেবল নারী ও শিশুর জন্য একটি ছোট হাসপাতাল এবং একটি নার্সিং স্কুল স্থাপন করেন। তিনি নার্সদের অ্যানাটমি পড়াতেন। তিনি নারী হওয়ার পরও তার হাসপাতালে জাপানি নারী রোগীর আগমন ছিল অত্যন্ত কম। কেবল বিদেশি ধর্মযাজক নারীদের ওপর নির্ভর করে ক’বছর হাসপাতাল চালিয়ে তা বন্ধ করে দেন। নিজেও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪১ মৃত্যুবরণ করেন। সাবাত ইসলাম বাউলি (১৮৬৭-১৯৪১) সিরিয়ার ইহুদি-কুর্দিশ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার ওইমেনস মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করেন এবং আনন্দীবাই যোশীর চার বছর পর ১৮৯০ সালে ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি দামেস্ক ফিরে যান, সেখান থেকে কায়রো। তার কর্মজীবন সম্পর্কে কোনো প্রামাণিক দলিল কেউ উপস্থাপন করতে পারেননি। ১৯৪১ সালে তার মৃত্যু হয়।
*****
জোহরা বেগম কাজী প্রথম বাঙালি মুসলমান নারী চিকিৎসক। তার ছোট বোন শিরীন কাজী বোনকেই অনুসরণ করেছেন, তিনি দ্বিতীয় বাঙালি মুসলমান নারী চিকিৎসক। তার ভাই কাজী আশরাফ মাহমুদও চিকিৎসাশাস্ত্র পড়তে শুরু করেছিলেন, ছেড়ে দিয়ে পরে উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক হন, তার কবিখ্যাতি অধ্যাপনার খ্যাতিকে ছাড়িয়ে। তাদের বাবা কাজী আবদুস সাত্তার ১৮৯৫ সালে তখনকার মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজের এলএফএম ডিগ্রি নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য ভারতে যান। সন্তানরা ছোটবেলা থেকেই হিন্দি, হিন্দুস্তানি ও উর্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে বসবাস ও পড়াশোনার কারণে তাদের অবাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
ডাক্তার জোহরা বেগম কাজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার এবং কথা বলার সুযোগ আমার হয়েছে। সংক্ষিপ্ত হলেও আত্মজীবনীমূলক একটি সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের কথা এবং তার সময়কার কিছু কথা বলে গেছেন। তার কথা থেকেই কিছু অংশের উদ্ধৃতি দিচ্ছি : বাবার চাকরির সুবাদে ছোটবেলা থেকেই ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছি। ছোটবেলা থেকেই আমি মানবসেবা করার জন্য ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। ১৯২৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইন্টারমিডিয়েট কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করি। তারপর এশিয়ায় প্রথম মহিলাদের জন্য দিল্লিতে স্থাপিত লেডি হার্ডিঞ্জ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই… ১৯৩৫ সালে এমবিবিএসে প্রথম হই এবং অত্যন্ত সম্মানজনক ভাইসরয় পদক পাই।
উল্লেখ্য, তিনিই ছিলেন একমাত্র মুসলিম ছাত্রী। পারিবারিক সূত্র ধরেই তিনি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। গান্ধীপুত্র রামদাস তার প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়েছিলেন, এ নিয়ে ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর একটি লেখা রয়েছে। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের একজন। ৭ নভেম্বর ২০০৭ ডাক্তার জোহরা কাজী মৃত্যুবরণ করেন।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়