প্রধানমন্ত্রীর তিন বিশেষ সহকারী নিয়োগ

আগের সংবাদ

অনন্য সংসদের ঐতিহাসিক সূচনা

পরের সংবাদ

নেতৃত্বে শীর্ষে সংখ্যায় কম

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৩০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৩০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি : বাংলদেশে ১৯৯১ থেকে এখন পর্যন্ত গত ৩৩ বছরের মধ্যে (২০০৭-২০০৮ এই দুই বছর ছাড়া) ৩১ বছরই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দুজন নারী- শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া। এর মধ্যে টানা চতুর্থবার ও মোট পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে বিশ্বে রেকর্ড গড়েছেন শেখ হাসিনা। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দেয়া নারীদের সংখ্যা এখনো হাতেগোনা। প্রধানমন্ত্রী, সংসদ উপনেতা ও স্পিকার নারী। জাতীয় পার্টির একটি অংশের প্রধান এরশাদপতœী রেগম রওশন। বিএনপি চেয়ারপারসন নারী- এমন আত্মতুষ্টি রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব বাড়াতে কোনো কাজে আসছে না। ২০২০ সালের মধ্যে সব কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনীতিতে নারীর অংশ নেয়া বাড়লেও নেতৃত্ব পর্যায়ে নারীর উপস্থিতি কম। আরপিও সংশোধন করে নতুন করে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময় বাড়িয়েছে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে সব রাজনৈতিক দলে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতে প্রান্তিক পর্যায়ে সচেতনতা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ জরুরি বলেও জানিয়েছেন তারা।
মূলত ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময় ২০০৮ সালে শামসুল হুদা কমিশন দেশে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রথা চালু করে। ওই সময় নিবন্ধনের শর্ত হিসেবে রাজনৈতিক দলে নারী নেতৃত্ব বাড়ানোর বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়। ২০২০ সালের মধ্যে সব দলকে সব স্তরে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করার শর্তারোপ করা হয়। বিষয়টি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশেও যুক্ত করা হয়। ওই হিসেবে চার বছর আগে ইসির শর্ত পূরণের সময় শেষ হয়েছে। তবে শুরু থেকেই নিবন্ধন আইনের এ শর্তটির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল একাধিক ধর্মীয়ভিত্তিক রাজনৈতিক দল। তারা এই শর্ত বাতিলের দাবি করে আসছে। সবশেষ কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন আয়োজিত সংলাপেও একাধিক ধর্মভিত্তিক দল নিবন্ধনের এই ধারা বাতিলের সুপারিশ করে।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বাম দলগুলো নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর পক্ষে। আওয়ামী লীগ ইসির কাছে চিঠি দিয়েও শর্ত পূরণের সময় বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। নির্বাচন কমিশনও এই শর্ত পূরণের সময় ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়িয়ে আরপিও সংশোধনীর প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠানোর পর এটি পাস হয়।
এগিয়ে আওয়ামী লীগ, শূন্য ইসলামী দলগুলো : ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে নারী নেতৃত্বের বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সবশেষ কাউন্সিলে (ডিসেম্বর ২০২২) ৭৯ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারী রয়েছেন ২০ জন। এ হিসেবে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারীর অংশগ্রহণ ২৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। দলটির ৮১ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির দুটি পদ শূন্য রয়েছে। দলটির শীর্ষ নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া দলটির সভাপতিমণ্ডলীতে ৩ জন, সম্পাদকমণ্ডলীতে ৭ জন ও কেন্দ্রীয় সদস্য পদে ৯ জন নারী রয়েছেন। এর বাইরে আওয়ামী

লীগের ৪৫ জন উপদেষ্টার মধ্যে নারী রয়েছেন ৫ জন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগে নারী নেতৃত্ব ছিল মাত্র ১১ শতাংশ। সেই হিসেবে দেড় দশকে দলটির নারী নেতৃত্ব দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারী নেতৃত্ব বাড়লেও তৃণমূলে এ চিত্র হতাশাজনক। তৃণমূল সংগঠনগুলোর মধ্যে কেবল নারী উইং ছাড়া নারী নেতৃত্ব নেই বললেই চলে। দলটির সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের চিত্রও একই রকম। দলের ৮টি সহযোগী ও দুটি ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের মধ্যে যুব মহিলা লীগের বাইরে শীর্ষ দুটি পদের মধ্যে কেবল কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক নারী।
এর আগে ২০১৯ সালের ২১তম জাতীয় সম্মেলনে শেখ হাসিনা দলের সর্বস্তরের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিতের প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন দেয়া হয় এবং পরে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রেও যুক্ত করা হয়। তবে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত দলটির সম্মেলনে গঠনতন্ত্র ফের সংশোধন করে নারী নেতৃত্বের শর্ত পূরণের সময় বাড়ানো হয়। অন্যদিকে বিএনপির ৫০২ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় নির্বাহী কমিটির তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, স্থায়ী কমিটি ও নির্বাহী কমিটি মিলিয়ে মোট নারী সদস্যের সংখ্যা ৬৭ জন। সেই হিসেবে বিএনপিতে নারী নেতৃত্ব রয়েছে মাত্র ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
এদিকে বর্তমানে ইসিতে নিবন্ধিত ৩৯টি দলের মধ্যে ধর্মভিত্তিক দলের সংখ্যা ১০টি। এসব দল তাদের কমিটিতে নারীদের রাখার একেবারেই বিপক্ষে। দলগুলোর কমিটিতে নারী সদস্য ১০ শতাংশের নিচে। তাদের বেশির ভাগই আবার দলের নেতাদের সহধর্মিণী। ইসি ও দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। ইসির নিবন্ধন তালিকায় ৩৫ নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ ইসলামি ফ্রন্ট। তাদের নির্বাচনী প্রতীক মোমবাতি। দলটির কেন্দ্রীয় কমিটিতে কোনো নারী সদস্য নেই। বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছেন আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী। এই দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ৪০ সদস্যের হলেও তাতে কোনো নারী সদস্য নেই।
দ্বাদশ নির্বাচনে অংশ নেন পাঁচ শতাংশের কম নারী : সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতাকারী প্রার্থীদের মধ্যে নারী প্রার্থী পাঁচ শতাংশেরও কম! নির্বাচনে তিনশ আসনের জন্য প্রতিদ্ব›িদ্বতা করা বৈধ মোট ১৮৯১ জন প্রার্থীর মধ্যে নারী প্রার্থী ছিলেন ৯২ জন। শতাংশের হিসাবে যা ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এর মধ্যে ১৪টি দলের ৬৮ নারী। আর ২৬ জন নারী লড়াই করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। ওই হিসেবে নির্বাচনে ২৭টি দলের মধ্যে ১৪টি দল নারী প্রার্থী দিয়েছিল। প্রায় ৫০ শতাংশ দলের নারী প্রার্থী ছিল না। আর ৩০০ আসনের হিসেবে ১৮৭টি আসনে নারী প্রার্থী ছিল না। দলগত হিসেবে, আওয়ামী লীগের ৭ দশমিক ৬০ শতাংশ নারী প্রার্থী ছিলেন। জাতীয় পার্টির ২৬৪ প্রার্থীর মধ্যে ৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ নারী প্রার্থী। স্বতন্ত্র ৩৮২ প্রার্থীর ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ নারী। নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন ২২ জন। অন্যদিকে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে ১৮৪৮ জন প্রার্থীর মধ্যে নারী ছিল ৬৮ জন। শতাংশের হিসেবে সেই নির্বাচনে নারী প্রার্থী ছিল ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আর ৪৭ জনের মন্ত্রিপরিষদে ৪ জন মাত্র নারী।
প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ : মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি ভোরের কাগজকে বলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের যতটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব এজন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমানে রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে নারীর সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়। জাতীয় সংসদে নারী নেত্রীরা অনেক ক্ষেত্রেই ভালো কাজ করছেন। যতটুকু সম্ভব কাজ করছেন। তবে তাদের বিষয়ভিত্তিক কাজ নিয়ে চিন্তা করার অনেক সুযোগ আছে। ছোট ছোট সেমিনার করা উচিত। আর শুধু সমস্যা নয়, সমাধানের পথটাও বলতে হবে। মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। পাশাপাশি সমাজকেও প্রস্তুত হতে হবে। আমরা নারীদের কতটুকু এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই, সমাজ মানসিকভাবে কতটা প্রস্তুত নারীর ক্ষমতায়নে, সেটাও দেখতে হবে। নারী স্বাবলম্বী হলে রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব বাড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোতেও নারীর অবস্থা নামেমাত্র। বর্তমানে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় ও স্থায়ী কমিটিতে নারী এক-তৃতীয়াংশ প্রতিনিধি থাকার কথা থাকলেও তা নেই। এভাবে নারীকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম ভোরের কাগজকে বলেন, রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ আশানুরূপ নয়। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিশ্রæতি পূরণ হয়নি। যেমন স্থানীয় সরকারে, সংসদে ও গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ (আরপিও) অনুযায়ী দলে নারীর অংশগ্রহণ আশানুরূপ ও ফলপ্রসূ নয়। তিনি বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি, জাতীয় সংসদে ৩৩ শতাংশ আসন নিশ্চিত করা। সংরক্ষিত আসন বাড়িয়ে ১০০টা করে সরাসরি নির্বাচিত করে নিয়ে আসা। কিন্তু ৫০টা আসনেই মনোনীত করে রাখার বিধান আছে। ফলে সংসদে কোনো রকম নারী সমস্যার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে না।
বাংলাদেশ নারী প্রগতির নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির ভোরের কাগজকে বলেন, নারীকে রাজনীতির সমঅংশীদার করতে হলে একদিকে যেমন নারীর জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে, অন্যদিকে তাদের দায়-দায়িত্বও দিতে হবে। থাকতে হবে দল ও নেতৃত্বের ইতিবাচক মনোভাব। নারীদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার জন্য তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোতে গড়ে তুলতে হবে নারীবান্ধব পরিবেশ। সহিংসতা ও সা¤প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দেশের সব গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিকে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই এবং রাজনৈতিক সহিংসতা ও সা¤প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইকে অভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে হবে। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেন, যারা অসা¤প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে সব অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড. মহসিন রেজা ভোরের কাগজকে বলেন, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ যত বাড়বে সমাজ ও রাষ্ট্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে। নীতিনির্ধারণীতে নারীর অধিকার বাড়লে বৈষম্য দূর হবে।
তিনি বলেন, দলের সবস্তরে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর রোডম্যাপ জরুরি। এছাড়া এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও একটি মনিটরিং সেল থাকতে পারে। যারা প্রতি বছর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসবে এবং আইনটি বাস্তবায়নের অগ্রগতি মনিটর করবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়