যাত্রাবাড়ীতে যুবকের লাশ উদ্ধার

আগের সংবাদ

ব্যাংক খাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেকর্ড তারল্য সহায়তা

পরের সংবাদ

বন্যাকে সম্মানিত করে ভারত সম্মানিত

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

যে কোনো পুরস্কার একজনকে দেয়া হয় তার সেই সময় পর্যন্ত কৃত কাজের স্বীকৃতি হিসেবে। যে কোনো দেশের মানুষের কাছে জাতীয় পুরস্কার প্রাধান্য পায়। ভারতে সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার ‘ভারত রতœ’। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘পদ্মবিভূষণ’। তৃতীয় সর্বোচ্চ পদক ‘পদ্মভূষণ’। চতুর্থ ‘পদ্মশ্রী’। জাতি, পেশা, অবস্থান বা লিঙ্গের পার্থক্য ছাড়াই বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এই সম্মাননা প্রদান করা হয়। ১৯৫৪ সালের ২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির এক অধ্যাদেশ বলে এই সম্মাননা প্রবর্তিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এই সম্মাননা প্রবর্তিত হয়েছিল তিন-বর্গের ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মানের ‘প্রথম বর্গ’রূপে। যদিও ১৯৫৫ সালে এই সম্মাননার ধরন পরিবর্তন করা হয়। প্রথমে স্থিরিকৃত ছিল শুধু ভারতীয় নাগরিকদের এই পুরস্কার দেয়া হবে। কিন্তু অতি দ্রুত সেই সীমারেখা তুলে নেয়া হয়।
এবারে পদ্মশ্রী পুরস্কার দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে। পুরস্কার প্রাপকদের মধ্যে অনেকেই এমন উচ্চতায় আসীন হন, যাকে সম্মানিত করে প্রদানকারীরাও সম্মানিত হন। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা সেই উচ্চতার শিল্পী। আমার একটা নিজস্ব অভিজ্ঞতা ভাগ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ২০১৪ সালে যখন তিস্তা বিতর্ক তুঙ্গে, তখন আমি নিছকই মজা করে সোশ্যাল মিডিয়াতে লিখেছিলাম রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে ভারতকে দিয়ে দাও, আর তিস্তা নিয়ে নাও। ঝড় বয়ে গিয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়াতে। ভারতীয় বাঙালিরা এই পোস্টের পক্ষে ঝড় বইয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের বন্ধুরা যেভাবে বিরুদ্ধ মন্তব্য করেছিলেন, তাতে বোঝা গিয়েছিল রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার জনপ্রিয়তা কোন উচ্চতায় পৌঁছেছে। কলকাতায় রবীন্দ্রসংগীতের বাণিজ্যিক অনুষ্ঠানে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার অনুষ্ঠানের প্রবেশ মূল্য যতই বেশি হোক, খুব দ্রুত টিকেট নিঃশেষিত হয়।
এর আগেও বাংলাদেশের অনেককেই পদ্ম পুরস্কারে সম্মানিত করেছে ভারত সরকার। কূটনীতিবিদ প্রয়াত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। আর তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘পদ্মশ্রী’ পেয়েছেন প্রতœতত্ত্ববিদ এনামুল হক। বিস্মৃতপ্রায় ঢাকা জাদুঘরকে ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে রূপান্তর করেন জাদুঘর আন্দোলনের পথিকৃৎ এনামুল হক। আহসান মঞ্জিলকে জাদুঘরে পরিণত করার মূল উদ্যোক্তাও তিনি। ২০২১ সালে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক সন্জীদা খাতুন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীককে পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত করে ভারত সরকার। তারও আগে ২০১৩ সালে সমাজকর্মী ঝর্ণাধারা চৌধুরীকে পদ্মশ্রী খেতাবে ভূষিত করে ভারত সরকার। ২০১৪ সালে সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে পদ্মভূষণ খেতাব দেয়া হয়, যা বিদেশি কোনো প্রাপকদের মধ্যে সর্বোত্তম। এবার পাচ্ছেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।
কীভাবে পুরস্কারপ্রাপকরা নির্বাচিত হন? শ্রেষ্ঠত্ব এই পুরস্কারের জন্য নির্বাচনের মূল ভিত্তি। পেশা, মর্যাদা বা লিঙ্গের কোনো বৈষম্য ছাড়াই যেসব ব্যক্তি এই পুরস্কারগুলোর জন্য যোগ্য তাদের নির্বাচিত করা হয়। কলা, সাহিত্য, শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রকৌশল, পাবলিক অ্যাফেয়ার্স, খেলাধুলা, সমাজকর্ম, চিকিৎসা, সিভিল সার্ভিস, বাণিজ্য ও শিল্পসহ অনেক ক্ষেত্রে বিশিষ্ট এবং ব্যতিক্রমী অর্জনকারীদের পদ্ম পুরস্কার দেয়া হয়। প্রতি বছর প্রধানমন্ত্রী পদ্ম পুরস্কারের নাম বিবেচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে গঠিত এই কমিটিতে রয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদ সচিব, রাষ্ট্রপতির সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব এবং ৪-৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। প্রতি বছর প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে এই সম্মানগুলো ঘোষণা করা হয়।
আপনারা কেউ ডা. দিলীপ মহলানবিশের নাম জানেন? কলেরা কিংবা ডায়রিয়া রোগে ওআরএসের বহুল প্রয়োগের সূচনা যার হাত ধরে, সেই প্রয়াত বাঙালি চিকিৎসক দিলীপ মহলানবিশ ২০২৩ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা পদ্মবিভূষণ খেতাব পান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বনগাঁ সীমান্তে কলেরায় আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষকে বাঁচানোর নেপথ্যে মূল ভূমিকা ছিল এই ডা. দিলীপ মহলানবিশের। বস্তুত তার উপস্থিত বুদ্ধিতেই স্যালাইন সূচের মাধ্যমে ধমনীতে প্রবেশ করানোর বদলে পানীয়ের সাহায্যে খাওয়ানো শুরু হয়। নুন-চিনি-বেকিং সোডার জল দিয়ে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন দিলীপ। পরে তার হাত ধরেই স্বীকৃতি পায় ওআরএস। অথচ তার মুখে একটি আক্ষেপ শোনা গেছে যে ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষকে একাত্তরে বাঁচিয়েছিলাম, কই ওরা তো মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা আমায় দিল না’।
বছরখানেক আগে কলকাতা বইমেলার সময় বাংলাদেশের একজন নামি টিভি সাংবাদিককে নিয়ে কবি জয় গোস্বামীর ফ্ল্যাটে হাজির হয়েছিলাম। সেই সাংবাদিক সাক্ষাৎকার পর্বের একটি অংশে প্রশ্ন রেখেছিলেন যে বাংলাদেশের লেখক-সাহিত্যিকরা এপার বাংলায় কি তেমনভাবে সমাদৃত? কবি জয় গোস্বামী সক্ষোভে বলেছিলেন- ‘১৯৯২ সালে তসলিমা নাসরিন, ১৯৯৪ সালে আনিসুজ্জামান, ১৯৯৬ সালে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ২০০০ সালে আবার তসলিমা নাসরিন, ২০০৮ সালে হাসান আজিজুল হক, ২০১৭ ও ২০২০ সালে আবার আনিসুজ্জামানকে আনন্দ পুরস্কার দেয়া হয়। ১৯৮৮ সালে সন্জীদা খাতুনকে রবীন্দ্র পুরস্কার এপার বাংলাই দিয়েছিল। আমাদের দেশের জাতীয় স্বীকৃতি পদ্ম পুরস্কার বাংলাদেশের ক’জন পেয়েছেন খোঁজ নিন। এবার আমাকে ভারতের একজনের নাম বলুন, যাকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোনো পুরস্কার বাদে অন্য কোনো স্বীকৃতি দিয়েছে- সাহিত্যে, শিল্পে, ভাস্কর্যে। এমনকি এই দেশ থেকে যারা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বা আপনাদের দেশের পটভূমিকায় সাহিত্য প্রকাশ করেছেন, তাদের একজনকেও আপনাদের দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে তেমন একটা নাম আপনি বলুন। আমাদের বই পর্যন্ত আপনাদের বইমেলায় প্রবেশাধিকার পায় না, আর কলকাতা বইমেলায় আপনাদের দেশের প্যাভিলিয়ন হয়। বইমেলা উৎসর্গ হয় বঙ্গবন্ধুর নামে। আসলে বাংলাদেশ এখনো সেই সাবালকত্ব অর্জন করেনি, যাতে তারা এপার বাংলার কৃতীদের সম্মান জানাতে পারে। আমার মনে আছে আমি মিনমিন করে বলেছিলাম যে ‘তা কেন জয়দা, সমধারা সাহিত্য পত্রিকা, পূর্ব-পশ্চিম সংস্থা ও আরো কিছু সংস্থা এখন এ দেশের কবি-সাহিত্যিকদের সম্মান জানাচ্ছে।’ কবি জয় গোস্বামী উত্তরে বলেছিলেন, ‘কিছু উদারচেতা উদ্যোক্তা আছেন, তা আমি জানি। কিন্তু তারা সংখ্যায় নগণ্য। তাও তাদের প্রদত্ত পুরস্কারের সংখ্যা একটা বা দুটো। কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্তরে বা বড় সংবাদপত্ররা তারা কখনো দিয়েছে কি?’ উত্তরে আমি ও আমার বন্ধু সাংবাদিক নীরব থেকেছি। সেই সাক্ষাৎকার প্রচারের পরে বাংলাদেশের কোনো হেলদোল দেখা যায়নি।
আচ্ছা কৃতীদের কোনো দেশ হয়? অথচ বাংলাদেশের স্বীকৃতি প্রদানের প্রধান শর্ত বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পশ্চিমবঙ্গীয় কোনো স্টল থাকে না। সুনীল, শক্তি, শঙ্খ, সমরেশ, শীর্ষেন্দু, জয়, আবুল বাশার কিনতে কলকাতা চল বা অনলাইন ভরসা। একটা-দুটো সমধারা বা পূর্ব-পশ্চিম সীমানা ভাঙলেও সার্বিক বাংলাদেশ আজো কূপমণ্ডূক। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত ভারত সরকার তাকে বা বাংলাদেশকে ধন্য করেনি, বরং এই দেশ অর্থাৎ ভারত ধন্য হয়েছে তাকে সম্মানিত করার সুযোগ পেয়ে। বর্তমান ভারতের মন্ত্র- ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ অর্থাৎ ‘সারা বিশ্ব এক পরিবার’-এর সার্থক প্রয়োগ রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার পদ্মলাভ।

অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়