আন্তঃবিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে গ্লেনরিচ চ্যাম্পিয়ন

আগের সংবাদ

বায়ুদূষণে বিপর্যস্ত দেশ

পরের সংবাদ

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান প্রসঙ্গে

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের চরিত্রটা যে জাতীয়তাবাদী ছিল এটা সবাই স্বীকার করবেন। জাতীয়তাবাদের শক্তি কতটা তা ওই অভ্যুত্থানে অভিব্যক্ত হয়েছে এবং সেই সঙ্গে তার সীমাও যে উদ্ঘাটিত হয়নি তাও নয়। অভ্যুত্থানটি ছিল নব্যঔপনিবেশিক পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের রক্ষক ও প্রতিনিধি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। আক্রান্ত হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা যে শক্তি গড়ে তুলেছিলেন এবং যেভাবে দখলকামীদের বাধ্য করেছিলেন আত্মসমর্পণে সেই শক্তিটা জাতীয়তাবাদের ভেতরেই ছিল এবং থাকে। এটা আমরা প্রত্যেকটি দেশেরই সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে দেখেছি। এখন দেখছি ইউক্রেনের মানুষ অত্যন্ত শক্তিশালী রুশদের বিরুদ্ধে লড়ছেন সেই ক্ষেত্রটিতে। খুব ভালোভাবেই দেখেছি এবং দেখছি ফিলিস্তিনের জনগণ যেভাবে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছেন ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে সেখানে। আসলে জাতীয়তাবাদ দুই ধরনের- একটি আগ্রাসী অপরটি আত্মরক্ষী। আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ প্রতিক্রিয়াশীল, আত্মরক্ষায় নিয়োজিত জাতীয়তাবাদ প্রগতিশীল। প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদ কেমন নৃশংস হতে পারে তা একাত্তরের গণহত্যায় আমরা দেখেছি, যেমন দেখেছিল ইহুদিরা হিটলার যখন তাদের ওপর নিধনযজ্ঞ চালায় তখন। হিটলারের নাৎসি জাতীয়তাবাদীরা যা করেছিল ঠিক একই রকমের কাজ এখন ইহুদি জাতীয়তাবাদীরা করছে; ফিলিস্তিনিদের কেবল যে তাদের বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করছে তা নয়, তাদের প্রতিজ্ঞা মনে হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের পরিচয়টিকেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার।
স্বীকার করতেই হবে যে জাতীয়তাবাদীরা আত্মস্বার্থ সচেতন ও অহঙ্কারী হয় এবং ওই অহঙ্কারের ভেতরে নৃশংসতার উপাদান লুকানো থাকে; যার প্রকাশ দেখা গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হয়ে এসেছে তখন জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির ওপর আমেরিকানদের অ্যাটমবোমা বর্ষণের নৃশংসতার ভেতর। এখনো দেখছি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর বিশ্বব্যাপী তৎপরতায়।
অনেকেই অবশ্য জাতীয়তাবাদ জিনিসটাকেই অপছন্দ করেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন চলছে, তার ভেতরেই ১৯১৬ সালে, নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির বিশ্বসুনামে-সমৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদ বিষয়ে তিনটি বক্তৃতা দেন। দুটি আমেরিকায়, একটি জাপানে। বক্তৃতা তিনটিতে তিনি জাতীয়তাবাদকে ভয়াবহ এক আপদ বলে বর্ণনা করেছেন। আসলে তিনি কিন্তু যাকে আমরা প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ বলছি তার বিরুদ্ধে বলছিলেন না। বলছিলেন পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে; যারা ওই বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে। তবে বক্তৃতায় তিনি যে ভারতীয়দের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের প্রশংসা করেছেন, তাও কিন্তু নয়। ভারতের সমস্যাকে তিনি রাজনৈতিক বলে মানেননি, বলেছেন ভারতের সমস্যা সামাজিক। তবে যোগ করেছেন যে সেটা কেবল ভারতের ক্ষেত্রে সত্য নয়, সব জাতির বেলায়ই সত্য হয়ে উঠেছে।
১৯২২ সালে লিখিত ‘নেশন’ নামের একটি ইংরেজি প্রবন্ধে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে অনেক বেশি মূল্যবান বলে উল্লেখ করেছেন জাতির তুলনায়। ব্যক্তিই সৃষ্টি করে; জাতি কোনো কিছু সৃষ্টি করে না, জাতি পারে উৎপাদন করতে ও ধ্বংস করতে। ব্যক্তি যে জাতির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা অবশ্যই ঠিক। কিন্তু ব্যক্তি তো একা থাকতে পারে না, তাকে সমাজের সঙ্গে, অর্থাৎ সমষ্টির সঙ্গে যুক্ত হতে হয়। সে জন্য জাতি গড়ে ওঠে এবং ভারতবর্ষীরাও একটি জাতি। এই ছিল রবীন্দ্রনাথের মতো। ভারত যে বহুজাতির একটি দেশ এটা রবীন্দ্রনাথ কখনো স্বীকার করেননি; যেমন স্বীকার করেননি গান্ধীজি এবং আধুনিক ভারতে চিন্তার গঠনে এরা দুজনই ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসও বলেছে ভারতে জাতি একটিই, নাম তার ভারতীয় জাতি। এই মতের বিপরীতে মুসলিম লীগ বলেছে, আমরা কম কীসে, আমরাও একটি জাতি। এই দ্ব›েদ্ব জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িকতায় পরিণত হয়েছে এবং সম্প্রদায় নিজেকে জাতি বলে চিহ্নিত ও পরিচিত করেছে। ফলে ভারতবর্ষের জাতি সমস্যার সমাধান হয়নি- দেশ ভাগ হয়েছে, কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এখনো সমানে চলেছে। ক্ষেত্রবিশেষে আগের তুলনায় অধিক জোরেই চলছে।
জাতীয়তাবাদের বিষয়ে ওই বক্তৃতাতে রবীন্দ্রনাথ ভারতের ঐক্যের কথা বলেছেন। তার মতে এ ঐক্য যতটা সম্ভব ঢিলেঢালা (ধং ষড়ড়ংব ধং ঢ়ড়ংংরনষব), তবে আবার যতটা সম্ভব শক্তও (ধং পষড়ংব ধং ঃযব পরৎপঁসংঃধহপবং ঢ়বৎসরঃঃবফ)। এবং এই ঐক্য যা তৈরি করেছে তা হলো “ংড়সবঃযরহম ষরশব ধ টহরঃবফ ঝঃধঃবং ড়ভ ধ ংড়পরধষ ভবফবৎধঃরড়হ, যিড়ংব পড়সসড়হ হধসব রং ঐরহফঁরংস”।
কেবল তাই নয়, ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন যখন বঙ্গভঙ্গের উদ্যোগ নেয় তখন যে স্বদেশি আন্দোলন হয় তার বুদ্ধিবৃত্তিক দিকটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ; সেই সময়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য একটি ‘মহাজাতি’ গঠনের অত্যাবশ্যকতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, যে দেশে একটি মহাজাতি গড়িয়া উঠে না, সে দেশে স্বাধীনতা হইতেই পারে না। স্বাধীনতা কাহার স্বাধীনতা? ভারতবর্ষের বাঙালি যদি স্বাধীন হয় তবে দাক্ষিণাত্যের নায়ার জাতি নিজেদের স্বাধীন বলিয়া গণ্য করিবে না। (‘সমস্যা’ : ১৯০৮) দেখা যাচ্ছে যে, ‘জাতি’তে আপত্তি থাকলেও ‘মহাজাতি’ গড়া প্রয়োজন বলে তিনি ধরে নিচ্ছেন। আবার এটাও মেনে নিচ্ছেন যে, ভারতবর্ষের মানুষদের মধ্যে ঐক্যের একটি বন্ধন থাকা সত্ত্বেও তারা সবাই এক জাতির নয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের বাঙালির সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের নায়ার জাতির দূরত্ব কেবল যে ভৌগোলিক তা নয়, সাংস্কৃতিকও এবং সংস্কৃতির প্রধান উপাদান যে ভাষা রবীন্দ্রনাথই তো সেটা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন যে বাঙালিকে যে বাঙালি বলা হয় তার কারণ হচ্ছে, ‘আমরা বাংলা বলে থাকি’। (‘বাংলাভাষা-পরিচয়’) ঘধঃরড়হধষরংস বক্তৃতাতে অবশ্য তিনি এই পার্থক্যকে ‘জাতি’গত না বলে ‘বর্ণ’গত (ৎধপরধষ) বলেছেন এবং ভারতকে একটি জাতি হিসেবেই উল্লেখ করেছেন, কিন্তু ভারতীয়দের ‘সামাজিক’ ঐক্যের ভিত্তিটাকে তিনি ধর্ম বলেই মেনে নিয়েছেন; যদিও গান্ধীজির মতো তিনি ‘রামরাজ্যে’র কথা বলেননি। বিস্তর ও বহুবিধ দূরত্ব সত্ত্বেও, এখানে কিন্তু নিজের অজান্তেই তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির তাত্ত্বিকদের কাছাকাছি চলে গেছেন। ঐক্যের ধর্মীয় সূত্রের ব্যাপারে ‘দেশহিত’ নামের প্রবন্ধে আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ভারতের কণ্ঠস্বরকে ‘এক করিয়া তুলিতে পারে ধর্ম। প্রয়োজনের প্রলোভনে ধর্মকে বিসর্জনে বিশ্বাসের বন্ধন শিথিল হইয়া যায়।’ ১৯১৩ সালে লিখিত ‘আত্মপরিচয়’ নামের প্রবন্ধে নিজের পরিচয় তিনি ‘হিন্দু’ বলেই দিয়েছেন এবং জানিয়েছেন যে, ‘হিন্দু কোনো বিশেষ ধর্ম নহে। হিন্দু ভারতের ইতিহাসের একটি জাতিগত পরিণাম’। কিন্তু ধর্ম তো কেবল বিশ্বাসের ব্যাপার নয়, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন ও শোষণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের যন্ত্রও। এবং রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ হতেন না যদি সেটা না জানতেন। তাই তো দেখি ১৯৩২ সালে লিখিত ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে আগের অবস্থান ত্যাগ করে তিনি বলছেন, ‘যে দেশে প্রধানত ধর্মের মিলই মানুষকে মেলায়, অন্য কোনো বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য।’ (কালান্তর) এও আমরা জানি যে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে তিনি তিন মাসের বেশি সক্রিয় থাকতে পারেননি, কারণ তিনি দেখছিলেন যে আন্দোলনে সাম্প্রদায়িকতার উপাদান ঢুকে পড়ছিল।
কিন্তু ভারতবর্ষীয়দের ঐক্যের ধারণা ভারতীয় মনীষীদের অধিকাংশই পরিত্যাগ করেননি। তাদের বক্তব্যে ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে হিন্দু ধর্মের কথাই এসে গেছে, প্রচ্ছন্নভাবে হলেও। ভারতীয়তা নিয়ে তারা গর্বও করেছেন; তাদের সেই অনুভূতিতে ভাববাদিতা স্থান পেয়েছে, বস্তুবাদিতাকে আড়াল করে। সেই সময়ে কেবল মাত্র কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকেই বহুজাতিত্ত্বের বিষয়টা উল্লেখিত হয়েছে; তাও খুব জোর দিয়ে নয়। তাছাড়া কমিউনিস্ট পার্টি রাজনৈতিকভাবেও মোটেই শক্তিশালী ছিল না। তারা যে জাতীয়তাবাদী দুই দলকে- কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে- পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবে এটা সম্ভব ছিল না; দেশভাগের সময় তাদের আওয়াজগুলোর একটি ছিল, ‘গান্ধী জিন্নাহ এক হও’; দেশভাগকে তারা মেনে নিয়েছে, এবং অল্প পরেই ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হায়’ বলে অসময়োচিত ঘোষণা দিয়ে এগোতে গিয়ে নিজেদের জন্য তো বটেই, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্যও বিপদ ডেকে এনেছে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়