বাংলাদেশে বাণিজ্য বাড়াতে চায় মিসর : বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রদূূতের সাক্ষাৎ

আগের সংবাদ

স্বতন্ত্র এমপিরা কী চান

পরের সংবাদ

বায়ুদূষণে বিপর্যস্ত দেশ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেবিকা দেবনাথ : ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে বায়ুদূষণ। মহানগর, জেলা এমনকি উপজেলা পর্যায়েও বায়ুদূষণের শিকার সর্বস্তরের মানুষ। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ এবং গর্ভবতী নারী বায়ুদূষণের বেশি শিকার হচ্ছেন। বায়ুদূষণে বিপর্যস্ত পুরো দেশ। বিপর্যস্ত জনস্বাস্থ্য। বায়ুদূূষণের কারণে বাড়ছে শ্বাসতন্ত্রের জটিল রোগসহ নানা ব্যাধি। বাড়ছে এসব রোগে মৃতের সংখ্যাও। বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন শ্বাসের মাধ্যমে দূষিত বায়ু ফুসফুসে নিচ্ছে। বায়ুদূষণজনিত রোগে বছরে ৭০ লাখ মানুষ মারা যায় বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
গত ১ বছরে রাজধানী ঢাকার বায়ু একদিনের জন্যও স্বাস্থ্যকর ছিল না। এমনকি দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে বলে গবেষণায় মিলেছে। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (আইকিউএয়ার) তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ধারাবাহিকভাবেই ঢাকার বায়ুর মান অস্বাস্থ্যকর হচ্ছে। গতকাল বুধবার ও মঙ্গলবার ঢাকার বায়ুর মান ছিল অস্বাস্থ্যকর। আইকিউএয়ারের সূচকের মান অনুযায়ী, গতকাল ঢাকার বায়ুর মান ছিল চতুর্থ অবস্থানে। ঢাকার স্কোর হলো ২০০। অর্থাৎ এখানকার বায়ুর মান অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে রয়েছে। ঢাকার বায়ুর মান দুর্যোগপূর্ণ ছিল গত বছরের জানুয়ারিতে, যা গত ৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়।
প্রসঙ্গত, আইকিউএয়ারের স্কোর শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকলে বায়ুর মান ভালো বলে বিবেচিত হয়। ৫১ থেকে ১০০ হলে মাঝারি বা সহনীয় ধরা হয়। সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয় ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর। ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়। স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া ৩০১-এর বেশি হলে তা দুর্যোগপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে কিছুটা উন্নত হয়। দ্রুত নগরায়ন, ইটভাটা, জৈবশক্তি পোড়ানো, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ, পুরনো যানবাহন চলাচল, নি¤œমানের জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এবং আন্তঃসীমান্ত বায়ুর

গুণমান বাংলাদেশে বাতাসের মান নি¤œ হওয়ার প্রধান কারণ।
বায়ুদূষণের কারণে বিভিন্ন বয়সের মানুষ শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দূষণজনিত কারণে বছরে মারা যাচ্ছে প্রায় দুই লাখ মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের (ইপিআইসি) গবেষকরা বলছেন, দূষণের কারণে গড়ে সাত বছর করে আয়ু হারাচ্ছে বাংলাদেশিরা।
দূষণের জন্য দায়ী : ইট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। দেশে ৭ হাজারের বেশি ইটভাটা রয়েছে। বছরে প্রায় ২৩ বিলিয়নের বেশি ইট বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। জিডিপিতে ইটশিল্প প্রায় ১ শতাংশ অবদান রাখছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে বায়ুদূষণের জন্য ৫৬ শতাংশই দায়ী হলো ইটভাটা। ইটভাটা থেকে বায়ুমণ্ডলে যেসব দূষিত উপাদান যোগ হচ্ছে এর মধ্যে পার্টিকুলেট ম্যাটার, কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও কার্বন ডাইঅক্সাইড উল্লেখযোগ্য। ২০১৯ সালে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ছিল ২০২৫ সালের মধ্যে মাটির ইট ব্যবহার পর্যায়ক্রমে পুরোপুরি বন্ধ করা। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০২৫ সালের পরিবর্তে ২০২৮ সাল পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, ঢাকার বাতাসের মান বিশ্বের অন্য শহরের চেয়ে খারাপ হওয়ার অন্যতম কারণ মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিভিন্ন ধরনের ৫৯ লাখেরও বেশি যানবাহন রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে ২০ লাখের বেশি যানবাহন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গাড়ি থেকে কালো ধোঁয়া নিঃসরণকারী যানবাহন হরহামেশা চোখে পড়লেও এগুলোর বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।
তথ্যমতে, কমপক্ষে ৫ লাখ মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন চলাচল করছে সড়কে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২২ অনুযায়ী সব মোটরযানের নিঃসরণ মাত্রা কার্বন মনোক্সাইড, হাইড্রোজেন ও নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহ এবং ক্ষুদ্র বস্তুকণা- এই তিন পরিমাপে হিসাব করা হয়। ডিজেলচালিত একটি যাত্রীবাহী গাড়ি প্রতি কিলোমিটারে সর্বোচ্চ এক গ্রাম কার্বন মনোক্সাইড, শূন্য দশমিক ৭ গ্রাম হাইড্রোজেন ও নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং শূন্য দশমিক ৮ গ্রাম বস্তুকণা নিঃসরণ করতে পারবে। এর বেশি হলে সেটি বায়ুদূষণ করবে।
জানা যায়, ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বায়ুদূষণ মোকাবিলায় বাংলাদেশ ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। দ্য স্টেট অব গেøাবাল এয়ার কোয়ালিটি ফান্ডিং ২০২৩ অনুসারে, চীন এবং ফিলিপাইনের পরেই বায়ুদূষণ রোধে আন্তর্জাতিক তহবিলের ৩য় শীর্ষ গ্রহীতা ছিল বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য অর্থায়ন কোনো সমস্যা নয় বরং সঠিক পদক্ষেপের অভাবই মূল সমস্যা।
স্বাস্থ্যর ওপর বিরূপ প্রভাব : গবেষণায় দেখা গেছে, ইটভাটা থেকে নির্গত দূষিত উপাদান মানবদেহের রেসপিরেটরি সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। পার্টিকুলেট ম্যাটার মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বায়ুতে পার্টিকুলেটস ম্যাটারের উপস্থিতিতে মানুষের মৃত্যুর হার আগের তুলনায় ৩ গুণ বাড়িয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত সালফার ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতির কারণে মানুষ চোখ, নাক, গলাসহ অ্যাজমাটিক সমস্যা বাড়ছে।
বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণায় বলা হয়, বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষ সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে এর অধিকাংশই বায়ুদূষণজনিত। বায়ুতে মিশে থাকা অতি ক্ষুদ্রকণা এতটাই ক্ষুদ্র যে এটি সহজেই মানুষের চোখ-নাক-মুখ দিয়ে ঢুকে রক্তের সঙ্গে মিশে যায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, কিডনি ও লিভার। তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে প্রজনন স্বাস্থ্যে। এর ফলে পুরুষের শুক্রাণু তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটছে, কমে যাচ্ছে শুক্রাণুর মান। অন্যদিকে মেয়েদের ডিম্বাণুও কমেছে কল্পনাতীতভাবে। আবার যেসব ডিম্বাণু আছে, সেগুলোও ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব দুর্বল বা নষ্ট ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর নিষেক ঘটে যে ভ্রূণ তৈরি হয় সেটা গর্ভে জায়গা করতে পারে না। আবার জায়গা করতে পারলেও গর্ভপাত হয়ে যায়। আর এ সমস্যা প্রজন্মান্তরে চলতে পারে।
বায়ুদূষণের বিষয়ে প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এম এইচ চৌধুরী লেলিন বলেন, বায়ুদূষণের সঙ্গে মানুষের শ্বাসতন্ত্রের সরাসরি সংযোগ রয়েছে। ফলে শ্বাসতন্ত্রের প্রায় সমস্ত রোগ অর্থাৎ যাদের অ্যাজমাসহ বিভিন্ন ধরনের শ্বাসতন্ত্রের অ্যালার্জি আছে সেগুলো বেড়ে যাওয়া শঙ্কা থাকে, যা এরইমধ্যে আমরা দেখছি। শিশুদের ক্ষেত্রে জন্ম নেয়ার পরে নবজাতক এবং ছোট শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পূর্ণাঙ্গ থাকে না। ফলে যত বায়ুদূষণ হবে তত তার শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা বাড়তে থাকবে। এক্ষেত্রে শ্বাসের টানসহ ফুসফুসের নানাবিধ রোগ হতে পারে। এছাড়া স্নায়ুর সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
এদিকে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর,বি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় কম বায়ুদূষণের শিকার মায়েদের তুলনায় অধিক বায়ুদূষণে ভোগা মায়েদের ‘প্রিটার্ম বার্থ’ (সময়ের আগে জন্মদান) ও কম ওজনের বাচ্চা প্রসবের ঝুঁকি অনেক বেশি।
বায়ুদূষণ প্রতিরোধে বিজ্ঞানসম্মতভাবে কলকারখানা গড়ে তোলা, যানবাহনের ধোঁয়া, গাড়ির কালো ধোঁয়া, ধূমপান, যেখানে সেখানে কাগজ, নোংরা না পোড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। মৃত জীবদেহের পচনের ফলে যাতে বায়ুদূষণ না হয় সেজন্য আশপাশের জীবজন্তু মারা গেলে তা মাটিচাপা দিতে হবে। যতদূর সম্ভব ধূমপান এড়িয়ে চলতে হবে। রাস্তা নির্মাণের কাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করার পরামর্শ দিয়েছেন পরিবেশবিদরা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়