হিযবুত তাহরীরের শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার

আগের সংবাদ

নারীনেত্রীদের দৌড়ঝাঁপ

পরের সংবাদ

অযোধ্যায় শ্রীরাম মন্দির নির্মাণ ও কিছু কথা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আগামী ২২ জানুয়ারি উদ্বোধন হবে রামলালা মন্দিরের। অযোধ্যার রামমন্দিরের গর্ভগৃহে স্থাপন করা হবে শ্রীরামের একটি বাল্যমূর্তি। মূর্তিটির উচ্চতা ৫১ ইঞ্চি। এ উপলক্ষে অযোধ্যায় সাজসাজ রব। শ্রীরামচন্দ্র ভারতে আরাধ্য দেবতা। প্রধানত হিন্দিভাষী অঞ্চলে। বহির্বঙ্গে তাকে নিয়ে ঈশ্বর বিশ্বাস তীব্রতম। ধর্ম মূলত বিশ্বাসনির্ভর। তাই শ্রীরামের জন্মভূমি যে অযোধ্যায়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু বিশ্বাস করেন শ্রীরামের জন্মস্থান বর্তমান অযোধ্যায়।
ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঘটনা : বাবরি মসজিদের অভিলিখন থেকে জানা যায়, মুঘল সম্রাট বাবরের আদেশে সেনাপতি মীর বাকী ১৫২৮-২৯ (৯৩৫ হিজরি বর্ষে) এ মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। জনসাধারণের মাঝে এই বিশ্বাস প্রচলিত, মীর একটি রামমন্দির ধ্বংস করে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন; কিন্তু এর পক্ষে যে যুক্তি পাওয়া যায়, তা প্রশ্নবিদ্ধ। তবে হিন্দু আমজনতার বিশ্বাস, এখানেই রাম জন্মেছিলেন।
রাম জন্মভূমি নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত : অযোধ্যার রাম জন্মভূমি নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ১৮৮৫ সালে। ১৮৮৫ সালে মহান্ত রঘুবর দাস রাম চবুতরা এলাকায় একটি মন্দির বানানোর অনুমতি চান। বাবরি মসজিদের মুতাওয়াল্লি মহম্মদ আশগর এর বিরোধিতা করেন। মামলা খারিজ হয়ে যায়, আদালত বলেছিল ওই এলাকায় মন্দির বানানোর অনুমতি দিলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা বাধার সম্ভাবনা থাকবে।
২২ ডিসেম্বর ১৯৪৯ সাল কিছু হিন্দু শ্রীরাম অনুগামী মসজিদের ভেতরে রামলালার বিগ্রহ রেখে দেন। ২৩ ডিসেম্বর দেশজুড়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ শুরু হয়। হিন্দু-মুসলিম দুপক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। ২৪ ডিসেম্বর ওই জমিকে বিতর্কিত ঘোষণা করে মসজিদে তালা ঝুলিয়ে দেয় ভারত সরকার।
১৯৫০ সালে রামলালার মূর্তিগুলোর পূজার অধিকারের আবেদন জানিয়ে ফৈজাবাদ জেলা আদালতে আবেদন করলেন গোপাল শিমলা বিশারদ ও পূজা চালিয়ে যাওয়ার জন্য মামলা করলেন পরমহংস রামচন্দ্র দাস। লাভ হলো না। ১৯৫৯ সালে ওই স্থানের অধিকার চেয়ে মামলা করল নির্মোহী আখড়া। কিন্তু আপত্তি করল সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড। ১৯৬১ সালে আবার তারা এই জমির অধিকার দাবি করল। মামলা চলতে থাকে। হিন্দুরা কখনোই তাদের দাবি ছাড়েননি। ১৯৮৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় আদালত সরকারকে নির্দেশ দেন, হিন্দু তীর্থযাত্রীদের প্রবেশাধিকার দিতে। সে সময়ে রাজীব গান্ধী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে উচ্চ আদালতে না গিয়ে এই সময় রাজীব গান্ধী রাম জন্মভূমি হিসেবে প্রচারিত গর্ভগৃহের তালা খুলে দেন। রাজীব গান্ধী ১৯৮৬ সালে পার্লামেন্টে পাস করা মুসলিম তালাকপ্রাপ্ত নারী বিলের কারণে হিন্দুদের চাপের মুখে ছিলেন। রামলালা দর্শনের জন্য ভক্তদের সুযোগ দেয়ার নির্দেশ মুসলিম সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া দৃষ্টি করে। ১৯৮৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, দিল্লির জামে মসজিদের ইমাম বুখারি এবং সৈয়দ সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সূত্রপাত : ১৯৮৯ সালের ১৪ আগস্ট এলাহাবাদ হাইকোর্ট নির্দেশ দেন, বিতর্কিত স্থানে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে হবে। ১৯৯০-এর ২৫ সেপ্টেম্বর গুজরাটের সোমনাথ মন্দির থেকে অযোধ্যার উদ্দেশে রামরথ যাত্রা শুরু করেন আদবানি। কিন্তু ২৩ অক্টোবর বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ সমস্তিপুরে রথ আটকে আদবানিকে গ্রেপ্তার করেন। অযোধ্যায় জমায়েত রামভক্তেরা অবশ্য ৩০ অক্টোবর বিতর্কিত জমিতে করসেবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিংহ যাদবের নির্দেশে পুলিশের গুলিতে ১৬ জন করসেবকের মৃত্যু হয়।
এর প্রতিক্রিয়ায় ১৯৯১ সালের জুনে পতন হয় মুলায়ম সরকারের। বিজেপি নেতা কল্যাণ সিংহ বিধানসভা ভোটে জিতে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ৭ অক্টোবর অযোধ্যায় বিতর্কিত ২ দশমিক ৭৭ একর জমি অধিগ্রহণ করলেন। কিন্তু এর তিন দিনের মাথাতেই হাসিম আনসারির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এলাহাবাদ হাইকোর্ট নির্দেশ দিল, বিতর্কিত জমিতে কোনো নির্মাণ চলবে না।
১৯৯২ সালের ২৭ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা জমা দিয়ে করসেবার অনুমতি দেয়ার আবেদন জানায় রাজ্য সরকার। বাবরি মসজিদের নিরাপত্তার আশ্বাসও দেয়া হয়। বিতর্কিত এলাকার বাইরে করসেবার অনুমতি দেন শীর্ষ আদালত। ৬ ডিসেম্বরের করসেবার ওপর নজরদারির জন্য পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেন সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু প্রশাসনের আশ্বাসে ফল মেলেনি। করসেবক ও রামভক্তেরা ঢুকে গুঁড়িয়ে দেন বাবরি মসজিদ।
ভগ্নস্তূপ থেকে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার পথে : বাবরি মসজিদ কাঠামোটি ভেঙে যাওয়ার পর তথাকথিত বিতর্কিত জমি এবং এর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ৬৭ একর হিন্দুদের জমি ৭ জানুয়ারি ১৯৯৩-তে (অ্যাক্ট ৩৩/১৯৯৩) ভারত সরকার অধিগ্রহণ করে। এর এক ইঞ্চি জমিও কোনো মুসলমানের সম্পত্তি ছিল না। কিন্তু ইসমাইল ফারুকী নামে একজন মুসলিম ভদ্রলোক ১৯৯৩ সালে সুপ্রিম কোর্টে মসজিদের সাইটটি অধিগ্রহণ করা যাবে না বলে আবেদন জানান।
প্রায় ২২ মাসের শুনানির পরে এই বেঞ্চ ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দের আগের পরিস্থিতিটি জানার জন্য ২০০৩ সালে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াকে জিপিআরএস রিপোর্টের ভিত্তিতে খননকাজের আদেশ দেয়। এএসআইর খনন রিপোর্টের ভিত্তিতে ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট রায় দেন, বিতর্কিত জমি সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া এবং রামলালার মধ্যে সমবণ্টন করে দেয়া হোক।
কিন্তু ২০১১ সালে ৯ মে অযোধ্যা জমি বিতর্কে হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ ঘোষণা করেন সুপ্রিম কোর্ট। মামলা চলতে থাকে। ২০১৭ সালের ২১ মার্চ প্রধান বিচারপতি জেএস খেহর যুযুধান পক্ষগুলোকে আদালতের বাইরে সমঝোতার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সমঝোতায় রাজি হয়নি বিবাদী মুসলিমরা। ফলে ২০১৯ সালের ৮ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট ৫ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ ঘোষণা করেন। ৬ আগস্ট, ২০১৯ সালের ৬ আগস্ট থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৪০ দিনের শুনানির পর ঘটল এই ঐতিহাসিক রায়দান। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈইয়ের নেতৃত্বে সর্বোচ্চ আদালত বললেন, কোনো ফাঁকা স্থানে এই মসজিদ নির্মিত হয়নি। পুরাতাত্ত্বিক খননে পাওয়া নিদর্শন অনুযায়ী সেখানে অনৈসলামিক উপাদান পাওয়া গেছে। তবে সেই উপাদানগুলো যে রামমন্দিরের, তা নিশ্চিত নয়। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন এখানেই রামের জন্মভূমি ছিল। সে কারণে এই অঞ্চলের দায়িত্ব পাবেন রামলালা বিরাজমান কমিটি। সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে অযোধ্যায় মূল ভূমিতে ৫ একর জমি দেয়া হবে মসজিদ গড়ার জন্য।
রামমন্দির নির্মাণে সরকারের ভূমিকা : রামমন্দির নির্মাণ বিজেপির ২০১৪ সালের ইশতেহারে থাকলেও মোদি সরকারের অবস্থান ছিল, আদালতই শেষ কথা বলবে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সব মিডিয়ার মাধ্যমে আলোচনার চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু ওয়াকফ বোর্ডের বিরোধিতার জন্য আদালতের বাইরে এর সমাধান হলো না। ফলে সুপ্রিম কোর্ট বাধ্য হলো ফয়সালা করতে।
এবার আশা যাক রায়দান সম্পর্কে। রায়দানের প্রথমেই বলা হয়েছে এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে। বলা হয়েছে কোনো জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতি যেন এতে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। এ কথাও বলে হয়েছে যে হিন্দুদের মধ্যে শ্রীরামের জন্মভূমি যে অযোধ্যা সেই বিশ্বাসের সত্যতা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তবে একটা কথা একজন সচেতন মুসলমানও নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে একটি স্থানকে যখন আপামর হিন্দু জনগোষ্ঠী তাদের আরাধ্য শ্রীরামের পবিত্র জন্মস্থান বলে মনে করেন সেই জায়গায় অযোধ্যাবাসী কিছু মুসলমানের নামাজ পড়ার ক্ষেত্র হিসেবে মসজিদ বানানোর জেদাজেদির কোনো যুক্তি নেই।
অযোধ্যায় মসজিদ কবে হবে : অযোধ্যায় মুসলিম পক্ষকে দেয়া ৫ একর জমিতে তৈরি হবে ভারতের সর্ববৃহৎ মসজিদ। ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট অযোধ্যার ধন্নিপুরে মসজিদ নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে। মসজিদ নির্মাণে তহবিল সংগ্রহের কাজ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে যাবে এবং নির্মাণ শুরু হবে মে মাস থেকে। ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন অ্যান্ড অযোধ্যা মস্ক ট্রাস্টের সভাপতি জাফর আহমেদ ফারুরি জানিয়েছেন, মসজিদের চূড়ান্ত নকশা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ প্রস্তুত হওয়ার সম্ভাবনা। এই মসজিদের নাম হতে পারে মহম্মদ বিন আব্দুল্লাহ অযোধ্যা মসজিদ। মসজিদটি আগের ১৫ হাজার বর্গফুটের পরিবর্তে ৪০ হাজার বর্গফুটের ওপর নির্মিত হবে। মসজিদের সঙ্গে থাকবে কমিউনিটি কিচেন, গবেষণাকেন্দ্র, হাসপাতাল, লাইব্রেরি ও একটি মিউজিয়াম। থাকবে অফিস ঘর, থাকার ব্যবস্থা থাকতে পারে। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো যে রামমন্দিরও যেমন কোনো সরকারি সাহায্য ব্যতিরেকে পুরোটাই দানের অর্থে তৈরি হয়েছে একইভাবে মসজিদ নির্মাতারাও সরকারের থেকে কোনো দান গ্রহণ করছেন না।
ভারত কতটা ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে : ভারতের অতীত বহুত্ববাদের। সাম্প্রদায়িকতার বীজ সমাজের মধ্যে চিরকালই ছিল। কিন্তু ভারতীয় বহুত্ববাদের ভেতরকার অভ্যন্তরীণ সংঘাত যাই থাক, সংহতি ও সমন্বয়ের এক বৃহৎ চিত্র যে ছিল, সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা আসার আগেই ভারতের সমাজে নিজস্ব ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য ছিল, সেই ঐতিহ্যই রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’-এর অন্তর্নিহিত শক্তি। এটা যতটা ধর্মের ব্যাপার, তার চেয়ে অনেক বেশি জীবনধারার। বরং বলা যায় পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষতা এ দেশে এক বিদেশি ধারণা, যা ভারতীয় সমাজে মিশে যেতে ব্যর্থ হয়েছে। ধর্মকে পুরোপুরি বাদ দেয়া তাই এই উপমহাদেশে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণ বা মসজিদ নির্মাণ কোনো এক পক্ষের জয় নয়। সব পক্ষের জয়।

অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়