আদালতে হাজির হতে হবে নুসরাতকে

আগের সংবাদ

কঠোর হচ্ছে বাজার তদারকি

পরের সংবাদ

অবশেষে পশ্চিমাদের ইউটার্ন : সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে রাজি যুক্তরাষ্ট্র > নতুন মাত্রায় উন্নীত হবে বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্ক

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য : ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’ বাংলা এই খনার বচনটি কূটনীতিতে এভাবে মিলে যাওয়া নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ করলেও অনেকেই তা বাস্তব বলে ভেবেছিলেন। বিশেষ করে ভোটের আগে মাঠের বিরোধী দল বিএনপিকে নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর দৌড়ঝাঁপ, র‌্যাবের ওপরে নিষেধাজ্ঞা এবং নানা হুমকিতে অনেকটা চাপে পড়েছিল বাংলাদেশ সরকার। একই সঙ্গে পশ্চিমাদের চাপ সামাল দিয়ে বাংলাদেশ ভোট করতে পারবে কিনা, ভোট হলেও সরকার টিকে থাকতে পারবে কিনা, ভোটের পর নতুন নিষেধাজ্ঞা আসবে কিনা-এমন সব বহু প্রশ্ন জনজীবনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু সবকিছুকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশে নির্ধারিত সময়ে যেমন ভোট হয়েছে তেমনি সরকারও গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন শেখ হাসিনা। এর পরেই যে পশ্চিমারা নানা কথা বলে আসছিল, তারা সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে যেমন যোগ দিয়েছেন তেমনি সরকার গঠনের পর মন্ত্রীরা অফিস শুরু করলে সেখানেও যেতে শুরু করছেন। বলছেন, সম্পর্ক উন্নয়নের কথা। বিশ্লেষকরা একে বলছেন ‘পশ্চিমাদের ইউটার্ন’। বাংলাদেশের ধারাবাহিক অগ্রগতিতে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতে সরকারকে সহযোগিতার প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন তারা।
নতুন সরকারের মন্ত্রীরা অফিস শুরু করেছেন এখনো এক সপ্তাহ পূর্ণ হয়নি। এরই মধ্যে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দূত চার্লস হুইটলি এবং জার্মানির রাষ্ট্রদূত আচিম ট্রোস্টার ব্যস্ত সময় কাটানো শুরু করেছেন। গত মঙ্গলবার ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে দেখা করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে দেখা করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দূত

চার্লস হুইটলি। একই দিনে পৃথকভাবে সচিবালয়ে কৃষিমন্ত্রী উপাধ্যক্ষ ড. আব্দুস শহীদের সঙ্গে তার দপ্তরে দেখা করেন জার্মানির রাষ্ট্রদূত আচিম ট্রোস্টার।
সব মিলিয়ে ‘ভোটের আগে এবং ভোটের পরে’ তাদের এই ব্যস্ততার মধ্যে বিরাট তফাত রয়েছে। ভোটের আগে তাদের ব্যস্ততা অনেকের মধ্যে নানা শঙ্কার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু এখন তাদের ব্যস্ততা বেড়েছে সম্পর্ককে আরো এগিয়ে নিতে। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের ঠিক আগে পরে অনেকটা নিষ্ক্রিয় ছিলেন তারা। তাদের এই নিষ্ক্রিয়তায় অনেকে ধরে নিয়েছিলেন, নির্বাচনপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ওপর বড় ধরনের বিধিনিষেধ আসতে পারে। তবে এখনো সেসবের কিছু হয়নি। বরং উল্টো মার্কিন রাষ্ট্রদূত, ইইউ রাষ্ট্রদূত এবং জার্মানির রাষ্ট্রদূত সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে তাদের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন।
জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, পশ্চিমাদের ইউটার্ন নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। একটা সময় তারা বেশি বলা শুরু করেছিল এবং মাঠের বিরোধী দলের কেউ কেউ ভেবেছিলেন, আমেরিকা সংঘাতিক একটা কিছু করে ফেলবে। কিন্তু তা হয়নি। কারণ আমেরকিা যা করে জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েই করে। এই মতামতকে প্রাধান্য দিয়েই ভোটের পরে আমেরিকার বিবৃতিতে সমালোচনার সঙ্গে নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করারও প্রত্যাশা ছিল। সেই কাজের বার্তাই সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে দিল। এখন দেখার বিষয় তারা এই অংশীদারত্ব এবং সম্পর্ককে কোথায় নিয়ে যেতে চায়?
জামার্নির রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুস শহীদ বলেন, স্বাধীনতার সময় থেকে জার্মানির সঙ্গে আমাদের একটা সুসম্পর্ক রয়েছে। তারা আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। জার্মানি উন্নত দেশ, কৃষিতে উন্নত। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতা করেছে এবং করবে। পূর্বাচলে আমরা একটি আন্তর্জাতিকমানের প্যাকিং হাউজ ও ল্যাব করতে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে জার্মানির কারিগরি সহযোগিতা দরকার। এ বিষয়েও তারা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা জার্মানিতে আম, আনারস, শাকসবজি রপ্তানি করতে চাই। তাদের বলেছি, উৎপাদন মান এবং প্যাকিং কোয়ালিটির ব্যাপারে আমরা কোনো আপস করব না।
সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে রাজি যুক্তরাষ্ট্র : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে তার দপ্তরে গতকাল বুধবার প্রথমবারের মতো বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। বৈঠকে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করতে একমত পোষণ করেন তারা। এ বিষয়ে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বড় উন্নয়ন সহযোগী। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে একসঙ্গে কাজ করব। নিষেধাজ্ঞা বা পশ্চিমা অস্বস্তি কাটল কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে হাছান মাহমুদ বলেন, উভয় দেশ আমাদের সম্পর্কটাকে আরো ঘনিষ্ঠ করার লক্ষ্যে এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে আরো কাজ করতে অত্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনা করেছি। তিনি বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথা হয়েছে। এই সমস্যার একমাত্র সমাধান তাদের নাগরিক অধিকার দিয়ে ফেরত পাঠানো। ফিলিস্তিনের গাজায় সংকটের কারণে বিশ্বের মনোযোগ রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে সরে গেছে। ১৫ লাখ রোহিঙ্গা আমাদের জন্য বিরাট চাপ। তাদের ফেরত পাঠাতে চাই আমরা।
স¤প্রতি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশে আসে দুই মার্কিন সংস্থা- এনডিআই, আইআরআইয়ের প্রতিনিধিরা। পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠকে সে প্রসঙ্গও উল্লেখ করা হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিজ থেকে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেননি। পর্যবেক্ষক পাঠানোর জন্য আমি নিজ থেকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। আর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান এবং সামরিক সহযোগিতা নিয়ে মার্কিন দূতের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
এদিকে হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠকের পর দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ এগিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন পিটার ডি হাস। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমি আমাদের পারস্পরিক স্বার্থকে এগিয়ে নিতে আগামী মাসগুলোতে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার অপেক্ষায় রয়েছি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, এই সাক্ষাৎ যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলার একটি সুযোগ। আজ আমাদের প্রাথমিক সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে, জলবায়ু এবং ব্যবসার সুযোগ স¤প্রসারণের মত বিষয় নিয়ে এবং রোহিঙ্গা সংকটের মতো পারস্পরিক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কীভাবে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি, তা নিয়ে আলোচনা করেছি। তিনি জানান, বৈঠকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
নতুন মাত্রায় উন্নীত হবে বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্ক : আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে ইইউয়ের সম্পর্ক নতুন মাত্রায় উন্নীত হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউয়ের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকটি খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে। আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিস্তারিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। আমাদের নতুন অংশীদারত্ব সম্পর্কের চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছি, যা খুব দ্রুতই সম্পন্ন হবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে চলমান বৈশ্বিক উত্তেজনা, যেমন রাশিয়ায় ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা, এগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি… এখান থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়। ইউক্রেন ইস্যু ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান নিয়ে আলোচনা করেছি। আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়গুলো দীর্ঘ মেয়াদে এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে আলোচনা করেছি।
তিনি বলেন, আগামী পাঁচ বছরে আমাদের দুই পক্ষের সম্পর্ক নতুন মাত্রায় উন্নীত হবে। এরই মধ্যে আমাদের সম্পর্ক উন্নয়ন অংশীদারত্ব থেকে রাজনৈতিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এর আগে আমরা রাজনৈতিক সংলাপ করেছি। সামনের দিনগুলোতেও উভয়পক্ষ নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলব। সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে চার্লস হোয়াইটলি বলেন, আজকের বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে আলাপ হয়নি। আমরা নির্বাচনের পর আমাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি। আজকের বৈঠকে আমরা আলাপ করেছি কীভাবে সামনের দিনগুলোতে এগিয়ে যাব। সামনের দিনগুলোতে আমরা একসঙ্গে কাজ করব।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের অনেকগুলো অগ্রাধিকার প্রকল্প রয়েছে প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে গেøাবাল গেট প্রকল্প ও রোহিঙ্গা সংকট ইত্যাদি। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তন থেকে অভিবাসন সংক্রান্ত সব বিষয় আমরা আলোচনা করেছি।
বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং রোহিঙ্গাদের অর্থায়নে সহায়তার বিষয়ে ইইউয়ের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ইইউর সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার দিয়ে ফেরত পাঠানো, এর বিকল্প কিছু নেই। রোহিঙ্গা ইস্যুর শুরুতে বিশ্ব স¤প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা ইস্যুর কারণে তা অনেকটা সরে গেছে।
ড. হাছান মাহমুদ বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু আমাদের জন্য একটা সমস্যা। সব মিলিয়ে ১৫ লাখ রোহিঙ্গা। এটা আমাদের জন্য একটা বাড়তি চাপ। নাগরিক অধিকার নিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে একযোগে কাজ করব। ইইউর রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইউরোপীয় বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করেছি। বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করেন। একই সঙ্গে ইউরোপীয় ফিন্যানসিয়াল ইনস্টিটিউটগুলো যাতে আমাদের বেসরকারি সেক্টরে বিনিয়োগ করতে পারে, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। ইইউর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংলাপে বসার বিষয়ে মন্ত্রী জানান, আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করেছি। অত্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়