উখিয়ায় ঘর থেকে বের করে রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যা

আগের সংবাদ

বিভাজন রুখতে তৎপর কেন্দ্র : আওয়ামী লীগ

পরের সংবাদ

অঙ্কটি খুব সোজা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একটি গøাসের ৩০ শতাংশ পানিতে ভরা। ৭০ শতাংশ খালি। জাতীয় নির্বাচনের ভোটের চেহারা বোঝাতে এই রকম একটি অঙ্ক সাজাতে পারেন আপনি। আবার এটাও বলতে পারেন যে গøাসটির ৭০ শতাংশ খালি। ৩০ শতাংশে পানি আছে। এটা একটি সহজ ধাঁধা। আপনি খালি অংশকে ধরবেন নাকি ভরা অংশকে?
বিকাল ৩টায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) সাংবাদিকদের বললেন ভোট পড়েছে ২৭ শতাংশ। আরো এক ঘণ্টা সময় আছে। ওই এক ঘণ্টায় আরো ১২ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে দাবি করেছেন সিইসি। শেষ না হলে চূড়ান্ত হিসাবে তিনি কী করে ঘোষণা করলেন যে ভোট পড়েছে ৪১ দশমিক ৯৯ শতাংশ? সবশেষ কাস্টিং ভোটের হিসাবে দশমিক ৯৯ রেখে দেয়া হয়েছে ভোটার জনগণের মনে বিশ্বাসকে পোক্ত করার জন্য। এবং যারা অবিশ্বাস করতে পারেন, সেই সজাগ-সচেতন তথাকথিত মধ্যবিত্তের মনে যাতে বিশ্বাস জন্মে যে, ঘোষিত ভোট প্রদানের হিসাবটি নির্ভুল। সিইসির এই সাইকো টেস্টে জিতে গেছে জনগণ। তারা এই হিসাব বিশ্বাস করেনি।
ভোটাররা বললেন, আমরা ৭ ঘণ্টায় ভোট দিলাম কথিত ২৭ ভাগ আর শেষ ১ ঘণ্টায় সেটা প্রায় ৪২ শতাংশে পৌঁছাল কী করে? সকাল থেকে গড়ে ৪ শতাংশেরও কম ভোট যেখানে কাস্ট হয়েছে, সেখানে এক ঘণ্টায় ১২ শতাংশ ভোট কাস্ট হওয়া প্রায় অসম্ভব। এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন সিইসি। তাকে তো নিয়োগ দিয়েছেন ওই মহামান্য রাষ্ট্রপতি, যিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ব্যতীত সাংবিধানিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারী নন। তার মানে সিইসি নিয়োগ পেয়েছেন পরোক্ষে প্রধানমন্ত্রীরই হাতে। আর কে না জানে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছারই প্রকাশ ঘটিয়েছেন সিইসি।
দ্বিতীয় একটি তথ্য আছে। তা হলো বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে সিইসি যখন বললেন এ পর্যন্ত ২৭ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়েছে। তখন পাশে দাঁড়ানো তার সেক্রেটারি বললেন, স্যার ভোট ৪০ শতাংশ পড়েছে। জাহাংগীর আলম সরকারের একজন সচিব। তাকে ইসির সচিব করে পাঠানোর উদ্দেশ্যই হলো সিইসিকে রাজনৈতিকভাবে গাইড করা। তিনি সেটাই করেছেন। সচিব জাহাংগীর যখন সিইসিকে সংশোধন করে বলেন, ভোট পড়েছে স্যার ৪০ শতাংশ। মানে, হাতে থাকা মাত্র আধা ঘণ্টায় ভোট পড়েছে সিইসির উচ্চারণের ২৭ শতাংশ হলেও তাকে অনেকেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করতে পারতেন। কিন্তু সেই আধা ঘণ্টায় কি প্রায় ১২ শতাংশ ভোট পড়তে পারে?
সকাল থেকে ভোট কাস্ট হওয়ার যে গড় গতি, তাতে আধা ঘণ্টায় ২ শতাংশের কম ভোটই পড়ার কথা। আর এক ঘণ্টার হিসাবে সাড়ে ৩ শতাংশই ভোট পড়ার কথা, যা সত্য ও গ্রহণযোগ্য বলে মনে হবে। কিন্তু এক ঘণ্টায় কীভাবে ১২ শতাংশ ভোট কাস্ট হলো? ম্যানুয়ালি এত ভোট কাস্ট হতে পারে না। তবে ডিজিটালি সেটা সম্ভব। আর যদি ১০ জনে মিলে সিল মেরে ভোট কাস্ট করে তাহলে ১২ শতাংশ ভোট কাস্ট হতেই পারে এবং সেটাই হয়েছে। আমরা বহু ভিডিও দেখেছি জাল ভোটের, সেখানে অনেকে মিলে নৌকায় সিল মারছেন। তাই কেউ বিশ্বাস করছে না যে, দিনশেষে প্রায় ৪২ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়েছে। ঘোষিত হার নিয়ে তাই সন্দেহ। এই সন্দেহ ঘোচানোর দায় ইসির বা সিইসির। কিন্তু সেই দায় তো কোনো আমলেই কোনো সিইসি বা ইসি ঘুচিয়ে প্রকৃত সত্য বলেছেন বলে মনে পড়ছে না আমাদের।
যারা নির্বাচনে জিতেছেন, তারা বলবেন ভোট কাস্ট হয়েছে ৪১ দশমিক ৯৯ শতাংশই। ভোটারদের আগ্রহকে সত্য প্রমাণের জন্য ওই হার মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। যদিও তা প্রদত্ত ভোটের অর্ধেকেরও ৮ শতাংশ কম। ওই কম সাংসদদের সম্মানকে কিছুটা হলেও ক্ষয় করে। তারা যদি ৫০ শতাংশ কাস্টিং ভোট দেখাতে পারতেন, তাহলে সাংসদদের শার্টে বা কাপড়ে কোনোরকম দাগ পড়ত না। ৪২ শতাংশে দাগ তো পড়লই সেই সঙ্গে অবিশ্বাসও জমল। ভোটাররা ভোটে উৎসাহ না পেলে প্রার্থীরা কী করবেন? আবার সরকারদলীয় লোকেরা বলবেন তাদের লোকেরা ভোট দিয়েছেন পুরো মাত্রায়, তাই ওই পরিমাণ ভোট প্রদত্ত হয়েছে।
আসলে কি তাই? আওয়ামী লীগের ভোটাররা বিশ্বাস করে যে তার দল তো জিতবেই। কারণ এই নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেই। বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করেছে। তাই আওয়ামী ভোটারদের ভোটে আগ্রহ কম। যে রকম উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রদর্শিত হয়েছে সরকারি-বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে তাতেও মনে হয়েছে ৭০/১০০ লোকের লাফালাফি, করতালি আর উদ্দীপনায় জমেনি দেশের মাঠ স্তরের মানুষের উৎসাহ। এ কারণেই কি সিইসিকে পার্সেন্টেজ বাড়িয়ে বলতে হলো? নাকি তিনি ১০/১৫ শতাংশকে ২৫/২৭ পর্যন্ত উঠানোতেই যৌক্তিক মনে করেছিলেন, যা বিশ্বাসযোগ্য হতো বা হতে পারত।

দুই.
দেশে ভোটারের সংখ্যা ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩। এদের মধ্যে পুরুষ ভোটার হচ্ছে ৬ কোটি ০৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯। আর নারীর সংখ্যা ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার হচ্ছেন ৮৫২ জন।
এবার নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেছেন ১ হাজার ৭০ জন। মোট নিবন্ধিত ২৭ দলের প্রার্থী এটা। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক প্রার্থী ছিল আওয়ামী লীগ থেকে। শাসক দলের প্রার্থী বেশি হওয়ায় প্রতিদ্ব›দ্বী সৃজন করতে দলের মনোনয়ন না পাওয়াদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানোর অনুমতি দিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে এলে মনোনয়নবঞ্চিতরা নির্বাচন করতে পারতেন না। বিএনপি নির্বাচনে আসেনি একটি শর্তে, তাহলো তারা চাইছিল নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা হোক। কিন্তু আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে ওই আইনটি বাতিল করেছে। আওয়ামী লীগ চেয়েছে তার সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। এই টানাপড়েনের সমাধান হয়নি। ফলে বিএনপি দাবি করেছে হাসিনা সরকারের অবসান হোক। হাসিনার পদত্যাগ চেয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এ ব্যাপারে অনড়। তিনি সংবিধানের বাইরে যাবেন না। কিন্তু একবারও বলেন না যে তিনিই ওই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার কায়েম করতে বিএনপিকে বাধ্য করেছিলেন। তখন তার রাজনৈতিক সঙ্গী ছিল জামায়াত। সেই জামায়াতকে আওয়ামী কাঁধ থেকে ফেলে দিতে হাসের মতো গা ঝাড়া দিয়ে পরিচ্ছন্ন হয়েছে, যাতে মনে হয় তিনি ও তারা কিছু করেননি। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েমের লক্ষ্যে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে মাত্র ১৭৩ দিন হরতাল করেছে। হরতালের দিন সরকারি কর্তারা অফিসে হেঁটে যাওয়ার পথে আওয়ামী কর্মীরা একজনকে ধরে ন্যাংটো করেছেন। সেই ভাইরাল হওয়া আমলার জীবনে কী কী অভিশাপ নেমে এসেছে, আমরা তার কোনো খোঁজ নিইনি। কেননা, আমরাও তো হাসের মতোই এক সুযোগসন্ধানী হাঁসজাতি। সব কিছু ধুয়ে মুছে ফেলতে পারি। আমাদের আমলারা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী হলেও ক্ষমতাসীন সরকারের তৃণভোজী ছায়া সরকার। কারণ তারাই সরকারের প্রধান প্রশাসনিক শক্তি বা ওয়েভ। এই ওয়েভ এতটাই সংগঠিত যে তারা ক্ষমতাসীন সরকারের এজেন্ট হিসেবে বা পলিটিক্যাল ইউনিট হিসেবে কাজ করেন। আমার মাথায় এটা কোনোভাবেই আসে না যে, যারা আমলাদের একজনকে নেংটো করে গোটা আমলা প্রশাসনকে নেংটো করে দিয়েছিল, সেই তারাই কীভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রীতিসমৃদ্ধ হয়ে কাজ করেন? প্রশাসনিক কালচারে কি এমন কিছু আছে যা তাদের ঝিগার আঁঠার মতো কামড়ে ধরেছে? নিজেদের লজ্জা আর হায়াকে তারা ক্ষমতার দরবারে বিশেষ কায়দায় ব্যবহার করেছে?

তিন.
ফিরে যাই একটি গøাসের বিষয়ে। গøাসটি পানিতে পূর্ণ থাকলে তা হতো শতভাগ পূর্ণ। গøাসটিতে ৪২ ভাগ পূর্ণ হলে খালির অংশ থাকে ৫৮ ভাগ খালি। পূর্ণ অংশের চেয়ে খালির অংশ বড় হলে পরিমাণে তারাই বৃহৎ অংশ। এবারের নির্বাচনে কথিত বা ঘোষিত ভোটপ্রদানের হিসাবে বোঝা যাচ্ছে ভোটারদের বৃহৎ অংশ ভোট দেয়নি বা ভোটপ্রদানে উৎসাহী ছিল না। তার মানে এটা হতে পারে যে তারা এই ভোটাভুটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ তারা ধরে নিয়েছে যে সরকার যা করছে তা রাজনৈতিকভাবে ভুল। দেশের প্রত্যেক ভোটারের অধিকার আছে তাদের মনোনীত প্রার্থীকে ভোট দেয়ার। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় গত দুটো নির্বাচনে সেই ভোটাররা তাদের অধিকার কায়েম করতে পারেনি সরকারের অনীহার কারণে। ভোটাররা যাতে ভোট দিতে না আসে, সেই কাজই করা হয়েছে। ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ জন প্রার্থীর বিপরীতে কোনো প্রতিদ্ব›দ্বী ছিল না। তাদের জন্য কাউকে ভোট দিতে হয়নি। কিন্তু তারা নির্বাচিত হয়েছেন বলে সেই সময়ের ইসি ঘোষণা দিয়েছিলেন। এতে করে তার নির্ধারিত দায়িত্ব পালন না করে সরকারের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। ইসির কমিশনাররা ভুলে গেছেন যে তাদের নিয়োগ দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য। কিন্তু সেই ইসি তা না করে ক্ষমতাসীন দলের হয়ে কাজ করেছেন। এবং তারা সংবিধানকেই লঙ্ঘন করেছেন। সংবিধানে শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে যে, নির্বাচন প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ হতে হবে। তা না হলে সেটা নির্বাচন হবে না। এই রকম লঙ্ঘন এবারো করা হলো বলে আমার ধারণা। ভোটপ্রদানের যে হার দেখানো হয়েছে তা নজিরবিহীন।
আমি কি ৪২ শতাংশ প্রদত্ত ভোটের ব্যালটপেপার দেখাতে পারব? তার তো সেগুলো সংরক্ষণ করার দায়িত্বও আছে। সেই সঙ্গে থাকতে হবে ব্যালট বইয়ের মুরিও। সেখানে থাকবে ভোটারের স্বাক্ষর বা টিপসহি। যদি না থাকে তাহলে সেই ভোটকে অবৈধ ধরা হবে। ফলে যারা নির্বাচিত হয়েছেন বলে সম্মানিত হয়েছেন, তারাও অবৈধ হয়ে যাবেন। গোটা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনই অবৈধ হয়ে যাবে। যে কোনো পরাজিত প্রার্থী হাইকোর্টে মামলা ঠুকে দিতে পারেন এই আবেদন জানিয়ে যে ভোটের আসল হিসাব এর মুরিবই ও ব্যালট চেক করা হোক। যে কোনো নাগরিকও সেটা করতে পারেন। মামলা শেষ না হলেও সংসদ চলতে পারে, এটাই আমরা দেখে এসেছি, কিন্তু ফল যদি সরকারি দলের বিরুদ্ধে যায় তাহলে কি সেই সেই সংসদ বৈধ বলে বিবেচিত হবে? এই রকম আরো বহু প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু এগুলোর কোনো সমাধান হয় না। কারণ অন্যায় ও অপরাধকেই আমরা প্রশ্রয় দিই। এরও কারণ আছে। মানসিকভাবে ও নৈতিকভাবে আমরা দুর্নীতিপরায়ণ। দুর্নীতির এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হতে হবে।

ড. মাহবুব হাসান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়