দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন : ৬ আন্তর্জাতিক সংস্থার বিবৃতি প্রত্যাখ্যান সরকারের

আগের সংবাদ

দুর্নীতির বিরুদ্ধে কড়া বার্তা

পরের সংবাদ

বিভাজন রুখতে তৎপর কেন্দ্র : আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মুহাম্মদ রুহুল আমিন : ‘একটি অদৃশ্য শক্তি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছে। সূ² কারচুপি করে মাদারীপুর-৩ আসনে নৌকাকে হারানো হয়েছে’- গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নিয়ে এমন অভিযোগ করেন আবদুস সোবহান গোলাপ। তিনি আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক। তার অভিযোগ মাদারীপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগমের বিরুদ্ধে। তাহমিনা কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। গোলাপ যখন মাদারীপুর প্রেস ক্লাবে বসে এমন অভিযোগ করছিলেন, সে সময় তার পাশে বসা আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মাদীরপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য শাজাহান খান। গোলাপ অভিযোগ করেন, ভোটকেন্দ্র থেকে নৌকার এজেন্ট বের করে দেয়া হয়েছে। লিখিত অভিযোগ করেও সুরাহা পাননি। নৌকায় ভোট দেয়ায় তিন শতাধিক বাড়িঘর ভাঙচুর করেছে, জ্বালিয়েছে, লুটপাট করেছে। প্রায় ৩৫ থেকে ৪০টি গ্রামের অনেক লোককে মারধর করা হয়েছে। ৩০ থেকে ৪০ জন গুরুতর আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিশ্বনাথ সরকার বিটু। ট্রাক প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেছেন রংপুর-২ আসনে। এখানে জয়ী হয়েছেন নৌকার প্রার্থী আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক। পরাজিত হওয়ার দিন থেকেই নানা অনিয়মের অভিযোগ করে আসছেন বিটু। গত শনিবার বিকেলে বদরগঞ্জের একটি কর্মী সমাবেশে তিনি অভিযোগ করলেন, নির্বাচনে তাকে জোর করে হারানো হয়েছে। প্রশাসন কথা রাখেনি। নির্বাচনের আগের রাত ৩টার দিকেই সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়। বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয় তার এজেন্টদের।
কুষ্টিয়া-২ আসনে নৌকা প্রতীকে জোটের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেছেন ১৪ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। এই আসনটি থেকে তিনি টানা তিনবার নৌকা প্রতীকে বিজয়ী হন। এবার তিনি হেরেছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী কামারুল আরেফিনের কাছে। ইনু পরাজয়ের পর নানা অভিযোগ তুলেছেন। তার অভিযোগ, জনগণের ভোটে নয়, আমাকে কারচুপির ভোটে হারানো হয়েছে। ১৮টি ভোটকেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে। আওয়ামী লীগের একটা অংশ প্রশাসনের সহযোগিতায় নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করেছে। যা দুঃখজনক। অবশ্য তিনি বলছেন, ৯৫ ভাগ জায়গায় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে, ৫ ভাগ জায়গায় হয়নি।
শুধু নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা গোলাপ, স্বতন্ত্র প্রার্থী কৃষক লীগের বিশ্বনাথ সরকার ও ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী জাসদের ইনু নন; হেরে যাওয়ায় এমন অভিযোগ করেছেন ‘নৌকা ও স্বতন্ত্র’র বেশ কয়েকজন প্রার্থী। যারা সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই নেতা। অবশ্য হেরে যাওয়ার বিষয়ে এই সব প্রার্থী শুধু মাত্র নিজ নিজ নির্বাচনী আসনেই এমনটা হয়েছে বলে দাবি করেছেন। সামগ্রিকভাবে তারা দেশের অন্যান্য আসনগুলোতে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের প্রসংশা করেছেন।
এদিকে একই দলের নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচনকে ঘিরে যে বিরোধ দেখা দিয়েছে, তা এখনো চলমান। নৌকা কিংবা স্বতন্ত্র যে প্রার্থীই বিজয়ী হয়েছেন, সেই প্রার্থীর অনুসারীরাই পরাজিত প্রার্থীর অনুসারীদের ওপর হামলা, ভাঙচুর করে আসছে। কাউকে কাউকে ভর্তি করানো হয়েছে হাসপাতালেও। কেউ কেউ আবার ভোটের পর থেকেই থাকতে পারছেন না নিজেদের বাড়িঘরে। জীবনও দিতে হয়েছে কয়েকজনকে।
গত শনিবার রাতে নোয়াখালী-২

আসনে (সেনবাগ ও সোনাইমুড়ি আংশিক) আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর রহমান ভূঁইয়ার এক কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত ওই কর্মীর নাম শাহেদুজ্জামান পলাশ। পলাশ স্থানীয় একটি ভোটকেন্দ্রে কাঁচি প্রতীকের পোলিং এজেন্ট ছিলেন। কাঁচি প্রতীকের প্রার্থী আতাউর রহানের অভিযোগ, ভোটকেন্দ্রে জাল ভোট ও অবৈধ প্রভাব বিস্তারের প্রতিবাদ করায় ভোটের দিন থেকেই নৌকার সমর্থকরা পলাশকে নানা হুমকি দিয়ে আসছেন। এই জেরেই তাকে খুন করা হতে পারে।
এদিকে ভোটের পরদিন থেকেই এক প্রার্থীর সমর্থকদের সঙ্গে আরেক প্রার্থীর সমর্থকদের দ্ব›দ্ব-সংঘাত বেড়েই চলেছে। একই দলের প্রার্থী হওয়ায় নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে বিভেদ। যা আগের নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে হতো। এবার নিজ দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে- যা নিয়ে উদ্বিগ্ন দলটির হাইকমান্ডও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির একাধিক নেতা ভোরের কাগজকে জানান, নিজ দলের প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতার সুফল আপাত দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগের ঘরে এলেও, ভবিষ্যতের জন্য দলে দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি হওয়ার শঙ্কা আছে। যা কাটিয়ে ওঠা দলের হাইকমান্ডের জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জের হবে। শুধু জাতীয় নির্বাচনই নয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতেও নিজ দলের প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচনী লড়াই হওয়ায় তৃণমূলে বিভেদ এখনো জিইয়ে আছে।
দলটির কোনো কোনো নেতা অবশ্য এমনটা মানতে নারাজ। তাদের মতে, সব কিছুই দলের নিয়ন্ত্রণেই আছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ ও ঢাকা-৮ আসনের নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ভোরের কাগজকে বলেন, ইতোমধ্যে আমরা সাংগঠনিকভাবে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছি। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে যারা জয়ী হয়েছে, তাদের সবাইকে স্বাগত জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনে কিছু কিছু বিদ্রোহী প্রার্থীর কিছু কিছু অভিযোগ আছে। এত বড় নির্বাচনে এ ধরনের কিছু বিষয় থাকবে। তবে কোথাও যেন কোনো ধরনের সংঘাত বা ভুল বোঝাবুঝি না হয়, নিজেদের ভেতরে যাতে আর কলহ না বাড়ে- সে জন্য দলের হাইকমান্ড থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে। এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণের দিকেই আসছে। আরেকটা বিষয় হলো, এটা নিয়ন্ত্রণের জন্য ভোটের দিন আমরা বিজয় মিছিল না করার জন্য দলের হাইকমান্ড থেকে নির্দেশ দিয়েছি। কেননা এটা হলে দ্ব›দ্ব-সংঘাত আরো বাড়তেই থাকত। নাছিম বলেন, নির্বাচনের আগে বা পরে আমাদের দেশে কিছু সমস্যা তৈরি হয়, এটা অতীতে আরো বেশি হতো। সেই তুলনায় এখন অনেক কমে গেছে। যেটুকু হচ্ছে, সে টুকু নিয়ন্ত্রণে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি। আর যারা ফৌজদারি অপরাধ করবে সে যেই হোক, তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাজেই সংঘাত বা বিভেদ ঠেকাতে সরকারের তো করণীয় আছেই, দলগতভাবেও আমরা কঠোর অবস্থানে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, একই দলের নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা একই আদর্শের। নির্বাচনের পর তাদের মধ্যে কোনো কলহ জিইয়ে থাকাটা উচিত হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ভোরের কাগজকে বলেন, একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে নৌকার প্রার্থীর পাশাপাশি দলের অন্য প্রার্থীরা যাতে নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে পারে, সে জন্য আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। কিন্তু দলের সব নেতাকর্মীই আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছেন। তারা সবাই একই আদর্শের। একই আদর্শের প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্ব›িদ্বতা থাকবে, কিন্তু কোনোভাবেই প্রতিহিংসা থাকতে পারে না। যে সব জায়গায় নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ, সংঘাত হচ্ছে, এসবের শিকার হচ্ছেন- তারা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে সহযোগিতা চাইতে পারেন। এমনকি নির্বাচন কমিশনের কাছেও অভিযোগ করতে পারেন। কিন্তু নির্বাচনের পর কোনো সংঘাত বা দ্ব›দ্ব কাম্য নয়। যারা দোষ করেছে, চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ও সাংগঠনিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য কতটুকু হুমকি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে, সে দিকে খেয়াল রেখে যদি ব্যবস্থা নেয়া হয় তাহলে দলের কোনো সমস্যা হবে না। কারণ আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল। দলটি গণতন্ত্রকে আরো বেশি উন্মুক্ত করে দিয়েছে। সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে জিইয়ে রাখার কোনো সুযোগ নেই। এখন সবাই একই আদর্শের প্রার্থী। সবার আদর্শ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন। তাহলে সেখানে বিভাজনটা কেন সৃষ্টি হবে? শুধু নিজের স্বার্থে হবে? আমি কেন জিততে পারলাম না, এটা মনে করলে আওয়ামী লীগের আদর্শের সঙ্গে তার মিল থাকল কোথায়?

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়