গাজীপুরে ট্রেনে কাটা পড়ে নারীর মৃত্যু

আগের সংবাদ

সরকারের তিন অগ্রাধিকার

পরের সংবাদ

অগণতান্ত্রিকতার কবলে নির্বাচনী সংস্কৃতি

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেবল শাসক বদলই ঘটে। কিন্তু ব্যবস্থা বদলের পাশাপাশি জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন ঘটে না। অতীত আমলেও নয়, এখন তো নয়ই। আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থাধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার বদলের বিষয়টি সাংবিধানিক। কিন্তু নির্বাচনী ব্যবস্থাকে মোটেও গণতান্ত্রিক বলা যাবে না। প্রতিবেশী ভারতকে বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা হয়। সেখানকার নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে অতীতে সুনাম থাকলেও গত ক’টি নির্বাচনের পর সেই সুনাম আর এখন নেই। তবে নির্বাচনী সহিংসতার বলি কিন্তু অতীতের ধারাবাহিকতায় আজ অবধি সেখানে ঘটে থাকে। আমাদেরও নির্বাচনে মানুষের প্রাণ হারানোর ঘটনা প্রতিটি নির্বাচনেই ঘটে এসেছে। প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীর প্রতিপক্ষের মধ্যকার সহিংসতার বলি হতে হয়েছে এযাবৎকালের প্রতিটি নির্বাচনে। তবে এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেবল একজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। যেটি অতীতের নির্বাচনের তুলনায় নিশ্চয় ব্যতিক্রম।
উপমহাদেশের খণ্ডিত তিন রাষ্ট্র যথাক্রমে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। ভারতে ক্ষমতাবদলে নির্বাচনী সাংবিধানিক ব্যবস্থা এখন পূর্বের তুলনায় দুর্বল হলেও ওই ব্যবস্থাই বলবৎ রয়েছে, এযাবৎ ছন্দপতন ঘটেনি। বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়েছে সামরিক জান্তাদের ক্ষমতা দখলে। ভারতে এযাবৎ ক্ষমতা বদল ঘটেছে জনরায়ে অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে। পাকিস্তানে আগাগোড়া রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখলে রেখেছে দেশটির সামরিক আমলাতন্ত্র। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই বেসামরিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলেও জিন্নাহর মৃত্যু, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের রহস্যজনক হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সামরিক আমলাতন্ত্রের অধীনে চলে যায়। পাকিস্তানের ইতিহাসে জুলফিকার আলী ভুট্টোই প্রথম জনরায়ে নির্বাচিত সরকার হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। কিন্তু তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার মধ্য দিয়ে প্রথম নির্বাচিত সরকারের পরিসমাপ্তি ঘটে। নওয়াজ শরিফ, বেনজির ভুট্টো এবং ইমরান খানের বেসামরিক সরকারের ওপর সামরিক আমলাতন্ত্র খড়গহস্ত চালিয়ে তাদের অপসারণ ও হত্যার পথ তৈরি করতে বিলম্ব করেনি। পাকিস্তানে নির্বাচিত সরকার বহাল থাকলেও নিয়ন্ত্রণ কিন্তু সেনাবাহিনীর। সেনাবাহিনীর আনুগত্য স্বীকার না করা মাত্র সরকারের পতনের ঘটনা দ্রুত ঘটে, নানা উছিলায়। তাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অতীতেও ছিল না, আজো নেই। গণতন্ত্র বিষয়ে পাকিস্তানকে নিয়ে আলোচনা বৃথা তাই।
আমাদের দেশে সামরিক শাসনের কবলে পড়ে নির্বাচনী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হোঁচট খেলেও জনগণের আন্দোলনের ফলে ফিরে এসেছে নির্বাচনী গণতন্ত্র। কিন্তু সামরিক সরকারের সংস্কৃতি নির্বাচিত সরকারের ওপর সিন্দাবাদের ভূতের ন্যায় চেপে বসেছে। আমরা দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানি রাষ্ট্রের অধীনে ছিলাম। তাই পাকিস্তানি শাসকদের সংস্কৃতি আমাদের নির্বাচিত সরকারগুলোর মধ্যেও ভর করেছে, সেটাও অপ্রত্যক্ষ নয়। তাই গণতন্ত্র নামে থাকলেও বাস্তবে আছে বলে ধারণা করা যাবে না।
দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫২ বছর হয়ে গেল। গণতন্ত্র যেন ক্রমাগত ক্ষয়ে ক্ষয়ে তলানিতে নেমে গেছে। এই ৫২ বছরব্যাপী দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কম আন্দোলন-সংগ্রাম হয়নি। মানুষ কম ত্যাগ-আত্মত্যাগ করেনি। কিন্তু নির্বাচনী ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক করা এবং জন আকাক্সক্ষার প্রতি দৃষ্টি দেয়ার তাগিদ একটি নির্বাচিত সরকারও দেয়নি। এতে মানুষের মধ্যে রাজনীতির প্রতি অনাস্থায় সম্পূর্ণ বিপরীত অভিমুখে যাত্রা করেছে। অর্থাৎ ইহজাগতিকতা ত্যাগ করে আধ্যাত্মিকতায় আশ্রয় খুঁজছে। মানুষকে তো দোষ দেয়া যাবে না। তারা আর কাঁহাতক ত্যাগ স্বীকার করবে! ত্যাগের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু মানুষের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি। রাজনৈতিক ফয়সালা রাজনৈতিকভাবেই আসবে, এই আশার পিছু তারা অন্তহীন ছুটেছে কিন্তু আশাহত হয়েছে বিগত ৫২ বছরে। তাদের আকাক্সক্ষার ন্যূনতম বাস্তবায়ন কোনো শাসকই করেনি। বিপরীতে তাদেরকে শোষণ করে এসেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের বারবার হতাশ করেছে। জনমানুষের হতাশায় দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ক্রমাগত স্ফীতি লাভ করেছে।
অথচ এ দেশের মানুষই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে উপলক্ষ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পরপরই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাকে পরিত্যাগ করে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাকে গ্রহণ করে; ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, সংগ্রাম এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম লাভ হয়েছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্র জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন করেনি, করবে না সেটা এ দেশের নেতারা সহসাই বুঝে গিয়েছিল। ওই সত্যটি উপলব্ধি করতে জনগণেরও বিলম্ব ঘটেনি। দীর্ঘ ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বহু ত্যাগ-আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিক ত্যাগ-আত্মত্যাগে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেও জনগণের কাক্সিক্ষত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো না। সাবেকী রাষ্ট্রের অনুরূপ জনগণ শোষণ-বঞ্চনার শিকারে পরিণত হয়ে এসেছে। সঙ্গত কারণে মানুষ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়েছে। আমাদের বিদ্যমান রাজনীতির প্রতি তাদের কোনো আস্থা-ভরসা নেই। তারপরও মানুষ আশা নিয়ে নির্বাচনে ভোট দেয়। এই ভোট নির্ধারণ করে কোন দলের দ্বারা শাসিত হবে। এখন তো সে-ব্যবস্থাও তামাশায় পরিণত হয়ে পড়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা বলে কার্যত এখন কিছু অবশিষ্ট আছে, তেমন ধারণাও করা যাবে না।
রাজনীতি এখন লাভজনক পেশায় পরিণত। ক্ষমতার পাশে থেকে পার্থিব অর্থবিত্ত লাভের মোক্ষম সুযোগ অন্য পেশার চেয়েও এক্ষেত্রে দ্রুত ঘটে। তাই ক্ষমতার রাজনীতির অভিমুখে ব্যবসায়ী, সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলাদের ইঁদুর দৌড় আমরা দেখে চলেছি। আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা যে তামাশায় পরিণত হয়েছে, এ বিষয়ে তো দ্বিমতের অবকাশ নেই। সব দলের অংশগ্রহণ ব্যতীত নির্বাচন সর্বজনীন হতে পারে না। প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কারাগারে আটক করে মামলা দিয়ে যে পরিস্থিতি ঘটানো হয়েছে সেটা নির্বাচনী গণতন্ত্রকে বিনাশের জন্য যথেষ্ট বলা ভুল হবে না। প্রতিদ্ব›িদ্বতাহীন নির্বাচনে একই দলের দলীয় প্রার্থীর পাশাপাশি স্বতন্ত্র এবং বিদ্রোহী প্রার্থীর বাতাবরণে নির্বাচনকে প্রতিদ্ব›িদ্বতামূলক হিসেবে দাঁড় করিয়ে নির্বাচনকে বৈধতা প্রতিষ্ঠার যে কৌশল সরকার নিয়েছে, শঠতার এই কৌশল কারো না বোঝার কারণ নেই। এ দেশের মানুষ শত-সহস্র বছরব্যাপী রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এসেছে। কাজেই ঘুমের মানুষকে জাগানো সহজ কিন্তু ঘুমহীন মানুষকে জাগানো সহজ নয়, মানুষ ঘুমের ভান করে আছে পরিস্থিতির কারণে। নির্যাতন, নিপীড়ন এবং ভয়-ভীতির কারণে। কেননা দেশে গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। চলছে একদলীয় শাসন। গত ১৫ বছরের সব নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা অভিন্ন। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। মানুষের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার একে একে হরণ করা হয়েছে। এমতাবস্থায় মানুষ ক্ষুব্ধ এবং হতাশ। দেশে ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করার ফলে মানুষ নিশ্চুপ পাথর হয়ে গেছে। ক্ষোভ-বিক্ষোভের ভয়াবহ পরিণতিতে নিশ্চুপ হওয়া ছাড়া তাদের উপায়ও নেই।
রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগ সরকারের তালুবন্দি। সরকার যা চাইছে, তারা তাই করছে, পার্থিব সুযোগ-সুবিধার মোহে পড়ে। রাষ্ট্রযন্ত্র কিংবা রাষ্ট্রের স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে অগণতান্ত্রিকতার সংস্কৃতি ও চর্চা এখন বিরাজমান। তারা সরকারের সব ধরনের অগণতান্ত্রিকতাকে বাস্তবায়নে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে। অর্থাৎ সর্বত্রই আনুগত্যের সংস্কৃতি বিরাজ করছে। অথচ সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের মালিক রাষ্ট্রের জনগণ। তারা জনগণের অর্থে মাসোহারা পেয়ে থাকেন, সাংবিধানিকভাবে তারা জনগণের সেবক। কিন্তু বাস্তবতা ঠিক বিপরীত।
আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীনে যে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়, এটি বিগত ৫২ বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখে এসেছি। নির্বাচন প্রহসন নিয়ে অনেকে সমালোচনা করছে বটে। তবে সম্মিলিত প্রতিবাদে শামিল হতে পারছে না। কঠোর হস্তে দমন-পীড়নে মামলা দিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করে এবং দ্রুত বিচার-কার্য সম্পন্ন করে সাজা দেয়া হচ্ছে। এই ভয়-আতঙ্কে মানুষ নির্বিকার হতে বাধ্য হয়েছে। সরকারবিরোধী কোনো কার্যক্রমকে সরকার বরদাশত করছে না। এমতাবস্থায় দেশে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিরাজ করছে সেটা কিন্তু বলার অবকাশ নেই।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়