নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো কোনো অপরাধ করেনি বাংলাদেশ : অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল

আগের সংবাদ

স্মার্ট মন্ত্রিসভার যাত্রা হলো শুরু : ব্যাপক রদবদল ঘটিয়ে নতুন মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টন, স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার, কাল টুঙ্গিপাড়া যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

মাস্টারদা সূর্য সেন : নির্ভয়ে গেলেন ফাঁসির মঞ্চে

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আগামীকাল মাস্টারদা সূর্য সেনের ফাঁসি দিবস। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মধ্যরাতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে সূর্য সেন ও বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তাদের ওপর ব্রিটিশ সেনারা নির্মম অত্যাচার করে। ব্রিটিশরা হাতুড়ি দিয়ে তাদের দাঁত ও হাড় ভেঙে দেয়। হাতুড়ি দিয়ে ইচ্ছামতো পিটিয়ে অত্যাচার করে। এই অত্যাচারের এক পর্যায়ে মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদার অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর তাদের অর্ধমৃত দেহগুলোকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে পুরো মৃত্যু নিশ্চিত করে জেলা খানা থেকে ট্র্রাকে তুলে ৪নং স্টিমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃতদেহ দুটোকে বুকে লোহার টুকরো বেঁধে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর সংলগ্ন একটি জায়গায় ফেলে দেয়া হয়। যাতে কেউ মাস্টারদা ও তারকেশ্বরের মৃতদেহও খুঁজে না পায়।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বিপ্লবী, ‘যুগান্তর’ দলের চট্টগ্রাম শাখার প্রধান এবং ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের প্রধান সংগঠক। পুরো নাম সূর্যকুমার সেন। ডাক নাম কালু। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অবস্থিত রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন। পরিবারে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না। পিতা রাজমনি সেন ও মাতা শশী বালা সেনের চতুর্থ সন্তান ছিলেন। তারা মোট দুই ভাই ও চার বোন ছিলেন। মাস্টারদা সূর্য সেন খুব অল্প বয়সেই তার মা-বাবাকে হারান। তিনি তার কাকা গৌরমনি সেনের কাছেই বড় হন। ছোটবেলা থেকেই সূর্য সেন পড়াশোনার দিকে পারদর্শী ছিলেন। তিনি দয়াময়ী উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তার প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং পরে নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পরে তিনি হরিশদত্তের ন্যাশনাল স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হন। এখানে তিনি এফএ পাস করে ও বিএতে ভর্তি হন। বেশকিছু কারণে তাকে এই কলেজ থেকে বিতাড়িত করা হয়। ফলে তাকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে থেকে তার বিএ কমপ্লিট করতে হয়। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ কমপ্লিট করার পর তিনি চট্টগ্রামে ফিরে এসে হরিশদত্তের ন্যাশনাল স্কুলেই শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের ফলে বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তিনি উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন।
১৯১৯ সালের পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে চট্টগ্রামের ছাত্ররা ক্লাস বর্জনসহ সভা-সমাবেশ করে। সভায় সূর্য সেন তার বক্তৃতায় ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন। অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী আফ্রিকা থেকে এসে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। তার ডাকে সাড়া দিয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষ উজ্জীবিত হয়েছিল। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরাও ছাত্র ধর্মঘট, হরতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আদালত বর্জন, সভা-সমাবেশ বক্তৃতাসহ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালাতে থাকে।
১৯২৯ সালে চট্টগ্রামের জেলা কংগ্রেসের সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। এতে সূর্য সেন সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। একই বছর ১৩ সেপ্টেম্বর লাহোর জেলে একটানা ৬৩ দিন অনশন করে বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মারা যান। এর প্রতিক্রিয়ায় সারা বাংলায় প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দেয়। বিক্ষোভ মিছিল ও সভায় নেতা সূর্য সেন বিপ্লবের পরবর্তী কার্যক্রমের পরিকল্পনা সদস্যদের সামনে তুলে ধরেন। বিপ্লবীরা স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার শপথ নেন। এর জন্য তারা ‘মৃত্যুর কর্মসূচি’ ঘোষণা করেন। প্রাথমিকভাবে হামলার দিন নির্ধারণ করা হয় ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু পুলিশি তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় এর তারিখ পিছিয়ে যায়। এ সময়েই গঠিত হয় সূর্যসেনের গোয়েন্দা দল। গোয়েন্দা দলের বিপ্লবীরা চট্টগ্রামে বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তাদের প্রস্তুতি চলে। সূর্য সেন গোপনে ইশতেহার প্রচার করেন। এতে তিনি কৌশল হিসেবে প্রচার করেন যে, ২১ এপ্রিল চট্টগ্রাম শহরের গান্ধী ময়দানে বিপ্লবীরা নিষিদ্ধ পুস্তক পাঠ করে আইন অমান্য করবেন।
১৯২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর টাইগার পাসের মোড়ে সূর্য সেনের গুপ্ত সমিতির সদস্যরা পাহাড়তলীতে অবস্থিত আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কারখানার শ্রমিকদের বেতনের ১৭ হাজার টাকার বস্তা ছিনতাই করে ছিলেন এবং এ ঘটনার কারণে কিছুদিন পরে গুপ্ত সমিতির গোপন বৈঠক চলাকালে সেখানে পুলিশ চলে আসে এবং গুপ্ত সমিতির সদস্য ও পুলিশের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে যাই। এ ঘটনাটিই ‘নাগরখানা পাহাড় খণ্ডযুদ্ধ’ নামে পরিচিত।
বিদ্রোহকে আরো তীব্র করার জন্য মাস্টারদা সূর্য সেন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চিটাগাং ব্রাঞ্চ গঠন করেন এবং ঠিক করা হয় ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল ৪টি দল মিলে ইংরেজদের ওপর আক্রমণ করবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী একদল বিপ্লবী রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে নেয়। এর ফলে চট্টগ্রাম সমগ্র ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অন্য একটি দল চট্টগ্রামের নন্দনকাননে টেলিফোন এবং টেলিগ্রাফ অফিসে আক্রমণ করে সব যন্ত্রপাতি ভেঙে দেয় এবং সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আরেকটি দল পাহাড়তলীতে অবস্থিত চট্টগ্রাম রেলওয়ে অস্ত্রাগার দখল করে সেখান থেকে উন্নতমানের রিভলবার ও রাইফেল লুণ্ঠন করে নেয় এবং একদল বিপ্লবী দামপাড়ায় পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক দখল করে নেয়। এই ঘটনার কারণে চট্টগ্রাম প্রায় ৪ দিনের জন্য ইংরেজমুক্ত হয়ে যায়।
১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল বিপ্লবীরা যখন জালালাবাদ পাহাড়ে অবস্থান করছিল তখন সশস্ত্র ইংরেজ সৈন্যরা তাদের ওপর আক্রমণ করে এবং দুই ঘণ্টার যুদ্ধের পর ব্রিটিশ বাহিনীর ১০০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন শহীদ হন। এই ঘটনাটিই ‘জালালাবাদ যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। আগ্নেয়াস্ত্র বহন করার কারণে মাস্টারদা সূর্য সেনকে ১৯৩৩ সালের প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এরপর ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মধ্যরাতে সূর্য সেনকে ফাঁসি দেয়া হয়।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর এক এক করে ছিটকে গেছেন সবাই। কেউ ধরা পড়েছেন, কেউ বা গুলিতে বা সায়ানাইডের বিষে মৃত্যুকে গ্রহণ করেছেন। কেউ বা একইরকমভাবে আত্মগোপন করে আছেন। সূর্য সেনকে খোঁজার জন্য তখন সব জায়গায় ঘুরছে পুলিশ। প্রতিটা বাড়ি, জঙ্গল, পাহাড় সবকিছু তোলপাড় করে ফেলা হচ্ছে। কোথায় তিনি? মাস্টারদা তখন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিবার। কেউ পুলিশের সঙ্গে কোনোরকম সহযোগিতা করছে না। করবেই বা কেন? মাস্টারদাকে প্রাণ দিয়ে রক্ষা করবেন সবাই। তখন ১৯৩৩ সাল। বিপ্লবী দলের কর্মী ব্রজেন সেন সূর্য সেনকে নিয়ে এলেন নিজের গৈরালা গ্রামে। ওই গাঁয়েরই বিশ্বাস বাড়ির বউ ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। এতটুকুও ভয় পেলেন না ওই মহিলা। প্রাণ থাকতে মাস্টারদাকে ধরা পড়তে দেবেন না। সেই অনুযায়ী ব্রজেন সেনের সঙ্গে চলত শলাপরামর্শ। এই পুরো ব্যাপারটাই সন্দেহজনক লাগল নেত্র সেনের। সম্পর্কে ব্রজেনের দাদা-প্রতিবেশী এই মানুষটি ভেবে পেলেন না, কী এমন আলোচনা চলে ছোট ভাই আর স্ত্রীর মধ্যে! মাঝে মাঝে খাবার নিয়েও কোথায় একটা যায়। কার জন্য এমন আয়োজন? তক্কে তক্কে ছিলেন নেত্র সেন। একদিন স্ত্রীর মুখ থেকেই বেরিয়ে এলো সেই ‘গোপন’ কথা। স্বয়ং মাস্টারদা রয়েছেন যে তার আশ্রয়ে! তাকেই সম্পূর্ণরূপে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা। চোখ চকচক করে উঠল নেত্র সেনের। আনন্দে তো বটেই; তবে এই আনন্দ লোভের। মদ আর জুয়া সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। ব্রজেন সেন আর সুশীল দাশগুপ্ত সক্রিয় হয়ে উঠলেন। কল্পনা দত্তসহ আরো কয়েকজনকে ওপারে নিয়ে গেলেন। মাস্টারদাকে নিয়ে যাওয়ার সময়ই গুলি এসে হাতে লাগে। পড়ে যান সুশীল। মাস্টারদা তা সত্ত্বেও চেষ্টা করে যান। যদি পালানো যায়! ওপারেও পৌঁছে গেলেন; কিন্তু ওই যে কথায় বলে না, নিয়তি। এক গোর্খা সেনার গায়ে গিয়ে পড়লেন সূর্য সেন। দীর্ঘ কয়েক বছরের অপেক্ষার পর, ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন তিনি।
ব্রিটিশদের ঘোষিত ১০ হাজার টাকার লোভে বাঙালি নেত্র সেন মাস্টারদাকে ধরিয়ে দিলেন।

এস ডি সুব্রত : কবি, সুনামগঞ্জ।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়