নির্বাচন নিয়ে ডিএমপির সঙ্গেমার্কিন প্রতিনিধি দলের বৈঠক : মধ্যাহ্নভোজ করালেন অতিরিক্ত কমিশনার হারুন

আগের সংবাদ

সুষ্ঠু নির্বাচনে তিন চ্যালেঞ্জ : ভোটার উপস্থিতি, বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা, প্রার্থীদের বিশৃঙ্খলা

পরের সংবাদ

নির্বাচন-নির্বাচন খেলা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গণতান্ত্রিক বিশ্বে একটি দেশের নির্বাচন অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। অনেক দিক থেকে এর গুরুত্ব। তবে প্রধান গুরুত্ব হলো, এ নির্বাচনই ঠিক করে দেবে- সামনের পাঁচটি বছর কে রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেবে। রাষ্ট্রের নেতৃত্ব বড়ই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সেখানে ক্ষমতা ও দায়িত্বসহ জনপ্রতিনিধিত্ব বিষয়টি বিদ্যমান। নির্বাচনটি ভুল হলে কিংবা ত্রæটিযুক্ত হলে সামনের পাঁচটি বছরও নষ্ট হতে পারে, ভুলও হতে পারে। এসবই গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয় সব গণতান্ত্রিক দেশেই বাংলাদেশ ছাড়া। বাংলাদেশে একটি প্রচলিত রাজনৈতিক বক্তব্য আছে- ‘সাংবিধানিক দায় রক্ষা’। এ দেশে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে করতে একসময় পার করে দিলে একপক্ষ এমন দাবি করে বসে। নির্বাচনটাকে সিরিয়াসলি নিতেই পারছে না এখানে রাজনৈতিক প্রধান দল দুটি। ফলে এখানে ৫ বছর পরপর নির্বাচন ঠিকই হচ্ছে; কিন্তু তা ঠিক নির্বাচনী আবহাওয়া প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে। তা যেমন সত্য রাজনীতিবিদদের জন্য, তেমনি সত্য ভোটারদের জন্য। এসব দেখে দেখে ভোটাররা আর কোনো আগ্রহ পাচ্ছে না নির্বাচনের প্রতি। ভোটাররা ধরেই নিয়েছে- এমন নির্বাচন দিয়ে সঠিক ফলাফল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই তারা ভোট দিতে গেল কি না গেল- তাতে কোনো তফাত নেই।
বাংলাদেশে নির্বাচনের প্রতি আগ্রহটাই শেষ হয়ে যাওয়ার পথে। এসব যে রাজনীতিবিদরা বুঝতে পারেন না তা নয়, তারাও বোঝেন। কিন্তু যারা নির্বাচনে অংশ নেয়, তারা ঠিক নির্বাচন চায় না; নির্বাচিত তকমাটি চায়। আর যারা নির্বাচনটি বর্জন করে, তারা নির্বাচনের ফলাফলটি অগ্রহণযোগ্য- এটাই শুধু দেখতে চায়। ফলে বাংলাদেশের জন্য এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে অমীমাংসিত একটি রাজনৈতিক সমস্যা। যার দায় দুটি রাজনৈতিক দলের হলেও ভুক্তভোগী এ দেশের সবাই। সমস্যাটির সৃষ্টি দুটি দলের হাত ধরেই। এক দল অন্য দলের হাতে নির্বাচনটি সুষ্ঠু হয়েছে- এটা মেনে নিতে পারেনি। সেই দ্ব›দ্ব মেটাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল। আওয়ামী লীগ তার সংসদ শক্তি দিয়ে সেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়ার পরই এ সমস্যার নতুন রূপ নেয়। আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে অতি সংবিধান দরদি, সংবিধানের মতো করে সংসদ নির্বাচন। বিএনপি বেঁকে বসে- কোনো বিশ্বাস নেই দলীয় সরকারের প্রতি; হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন। এই বিতর্কের মধ্যেই হয়ে গেল ২০১৪ এবং ২০১৮-এর দুটি নির্বাচন। দুটিই নতুন বিতর্ক হাজির করে বিতর্কের দুনিয়ায় আরো গতির সঞ্চার করে দিল। দেশের লোকদের বাইরেও যার পরিধি রচনা হলো- আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচনটি বেশ মুখরোচক আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়াল। ভারতের স্বার্থে ভারত চোখ বুজে প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচন নির্বাচন খেলাকে সমর্থন করে বিএনপির জন্য সুগম পথটি বেশ জটিল করে দিল। বিএনপির আলটিমেট ভরসা হয়ে দাঁড়াল ভারতবিহীন অন্য বিদেশি শক্তির প্রচ্ছন্ন সাহায্য। নির্বাচন বাংলাদেশের, কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো নির্ভরশীল নয় দেশের জনগণের ওপর। একদল পথ চেয়ে বসে থাকে ভারতের সুদৃষ্টি পেতে, অন্য দল পথ চেয়ে থাকে আমেরিকার দিকে।
বাংলাদেশে নির্বাচনটি ইতোমধ্যে কড়া নাড়ছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর রাজনৈতিক ইতিহাসের বিন্দুমাত্র ধারণা যাদের মধ্যে বিদ্যমান, তারা চোখ বুজেও বলে দিতে পারে- এ দেশে নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার প্রধান দল মাত্র দুটো- আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। এরশাদ প্রতিষ্ঠিত তৃতীয় দল জাতীয় পার্টি এরশাদ সাহেবের মৃত্যুর পর প্রতিযোগিতায় মাত্র তিনটি দল থাকলে যেমন একজন তৃতীয় হবেই, তাদের অবস্থা এখন তেমনটাই। চতুর্থ গণনায় ধরা যেত যে দলটিকে, সেই জামায়াতে ইসলাম নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত দল নেই আর। বাকি থাকল আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা অন্য ১৩টি দল এবং কিছু ইসলামী দল। এদের কোনো দলেরই স্বতন্ত্র শক্তি এমনটা নেই, যা নির্বাচনী সংস্কৃতিতে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলার শক্তি রাখে। ফলে দিনশেষে সেই কথাই- আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। এ দুটি দল নিয়েই বাংলাদেশের রাজনীতি, বাংলাদেশের নির্বাচন। এবারের সেই নির্বাচনে বিএনপি নেই। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সংখ্যা বাড়িয়ে প্রচার করার জন্য তাদের দলের বিরুদ্ধে নেতাদেরও স্বতন্ত্র প্রার্থী করার রাস্তা খুলে দিয়েছে। ১৪ দল আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা নিয়েই নির্বাচন যুদ্ধটা করতে পছন্দ করে। অন্যরা স্বতন্ত্র কিংবা নাম না-জানা কিছু রাজনৈতিক দল। তাহলে দুই-এ দুই-এ কী দাঁড়াল? নির্বাচন, না নির্বাচন-নির্বাচন খেলা? নির্বাচন নিয়ে খেলা করার জন্য কে কতটা দায়ী, তা হয়তো বিশ্লেষণের দাবি রাখে। তবে দুটি দলই যে দায়ী, তা অস্বীকার করার কোনো পথ নেই!
দুদলের নেতৃত্বে প্রকৃতপক্ষে দুজন ব্যক্তি। একজন বর্তমান দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যজন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বিদেশে পালিয়ে থাকা বিএনপির ২ নম্বর নেতা। বিএনপির ১ নম্বর নেত্রী অসুস্থ এবং মামলার জটিলতায় রাজনীতি থেকে সাইড ট্র্যাকে। আওয়ামী লীগের সব সিদ্ধান্ত, সব দায় একমাত্র তার সভানেত্রী শেখ হাসিনার হাতে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি সেখানে অচল এবং রাজনৈতিকভাবেও তাদের স্বার্থবিরোধী। কারণ তার মতো জনসমর্থন তার দলে অন্য কারো হওয়ার পথ কখনো প্রশস্তই হয়নি। বিএনপি এখন পর্যন্ত জিয়া পরিবারেরই সম্পদ হয়ে আছে। সব কর্তৃত্ব, ক্ষমতা- সবসময় এক হাতেই ছিল। জিয়ার জীবদ্দশায় তার হাতে এবং পরে বেগম জিয়ার হাতে। বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা এবং মামলার বেড়াজাল তাকে সাইড ট্র্যাক করায় বর্তমানে তারেক জিয়ার হাতে সর্বময় ক্ষমতা। তিনি লন্ডনে বসে দল চালাতে চাচ্ছেন- হটকারী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। বাংলাদেশে ঝুলছে তার বিরুদ্ধে আদালতের রায়। তিনি নেতা, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে অনুপস্থিত। দূর থেকে শুধু ঢিল ছোড়েন, আর বাংলাদেশে তাদের অন্য নেতারা দিশাহীন নৌকা চালাতে চালাতে একেবারে দিশাহারা। কিন্তু দলটি তেমন করে কখনো তা স্বীকার করে না। নেতাহীন, নেতৃত্বহীন প্রায় বলা যায় বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা। এত কিছুর পরও এ দেশে বিরোধী প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি। তাদের হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক বাংলাদেশের সর্বত্র বিদ্যমান। এই সমর্থকদের অনেকেই মনে-প্রাণে আওয়ামী লীগবিরোধী, হিন্দুবিরোধী, ভারতবিরোধী। তাই বিএনপির রাজনীতি মাঠে থাক আর না থাক, এই বিশাল বিরোধী সমর্থক তাদের আছেই। প্রায় নেতাহীন দলের ঝাণ্ডা বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের অগণিত সমর্থক। সেই সমর্থকদের জোরেই তারা ভোটযুদ্ধে এখনো আওয়ামী লীগের প্রধান এবং একমাত্র বিরোধী শক্তি। সুতরাং বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই আওয়ামী লীগ আর বিএনপির নির্বাচন। একজনকে বাদ দিয়ে অন্যজন শুধু খোলা মাঠে গোল দিতে পারে, মাঠে প্রতিদ্ব›িদ্বতা খেলা দেখাতে পারে না।
এমন বাস্তবতায় বিএনপিহীন নির্বাচন মাঠে নির্বাচনকে কি বলা যায়, তা বুঝতে কারো কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এমন একটি নির্বাচন পরিচালনা করতে নির্বাচন কমিশন যে আয়োজন করছে, যে অর্থের জোগান দিচ্ছে রাষ্ট্র- তার কতটুকু যুক্তি আছে, তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়বস্তু। এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী শুধু সরকারি দল কিংবা শুধু বিরোধী দল, এমনটা বলার উপায় নেই। সত্যি করে বললে দুটি দলই দায়ী গণতন্ত্রের এ অচলাবস্থার সৃষ্টির পথে। নির্বাচনে বিরোধী দলের উপস্থিতি শুধু বিরোধী দলের জন্যই আবশ্যকীয় নয়। এটা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দলের জন্যও। কেননা নির্বাচন অর্থবোধক হতে হলে দুটি দলেরই অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে হবে। আবার নির্বাচন ক্রমাগত বর্জন করার রাজনীতি করে নির্বাচনের ভাবমূর্তিকে ধ্বংস করার প্রয়াস বিরোধী দল যে করছে, তার রাজনৈতিক দায় তাদের নিতে হবে। আমি করব না, করতে দেব না- এমনটা বলে শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতাই বাড়ানো যায়; একটি প্রকৃত রাজনৈতিক দলের ভূমিকা পালন করা যায় না। এ বড় দুটি দলের রাজনীতি প্রকৃতপক্ষে বিদ্বেষ-হিংসা এত বেশি পরিমাণে বাড়িয়ে চলেছে, যার কারণে দেশের মানুষের কাছে রাজনীতিই হয়ে দাঁড়িয়েছে বিরক্তিকর। রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ হ্রাস পেতে পেতে শূন্যের ঘরে স্থান নিয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের চারদিকে যাদের এখন দেখা যায়, তারা রাজনৈতিক কর্মী; কোনো সাধারণ মানুষই শ্রদ্ধায় গদগদ হয়ে রাজনীতিবিদ কিংবা রাজনীতির পাশে দাঁড়াচ্ছে না। রাজনীতির এমন ক্ষতিকর অবস্থার দায় এড়াতে পারে না এ দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি।
রাজনীতিকে বাঁকা চোখে দেখে এখন অনেকেই। কেননা আজকের রাজনীতি আর সমাজ পাল্টানোর স্বপ্ন দেখে না; ভালো জীবিকা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। কেউ বিত্তশালী হতে চান, সমাজের সর্বনাশ করে নির্লজ্জভাবে অর্থ উপার্জন করতে চান; জনপ্রতিনিধি হলে তো কথাই নেই! অগাধ সুযোগ হাতের মুঠায়। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতা, অগাধ দাদাগিরির লাইসেন্স। আগে-পিছের সব কুকর্ম ধুয়ে-মুছে সাফ। এতে আপনার কিছু করার নেই। আপনি সিস্টেমের দাস। কেননা আজকের রাজনীতিতে সিস্টেম মানুষের পরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সিস্টেমের পরিবর্তন হচ্ছে না। সমাজে যা যা ঘটছে, একটু কান পাতলে কিংবা একটু বিশ্লেষণ করলেই বুঝবেন- সব দুই-দুই চারেই মিলে যাচ্ছে। এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে রাষ্ট্রীয় সংগঠনগুলোও বিষপানে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে থাকে। জবাবদিহিতা, জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা সব সংজ্ঞা তারা একে একে পালটে ফেলে নিজের স্বার্থ এবং রাজনীতির স্বার্থ দেখার কাজেই ব্যস্ত থাকে। কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় সংগঠনের কর্মকর্তারা এত বেশি বেশি রাজনীতি করেন যে, তাদের রাজনীতি কার্যকলাপের কাছে রাজনীতিতে থাকা মানুষগুলোও হার মানে। এমন একটি রাজনৈতিক কালচারে নির্বাচন করতে রাষ্ট্রের আর কিছু লাভ না হলেও ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির দিকটি তাকে গ্রহণ করতেই হচ্ছে এবং তাকে প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে আরো বেশি রাজনৈতিক সংঘাতের জন্য। তাই এমন নির্বাচন-নির্বাচন খেলার মাঠের এবং মাঠের বাইরের দুই খেলোয়াড় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়কেই এ অদক্ষ খেলার ক্ষতির দায়ভার নিতে হবে।

সুধীর সাহা : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়