রাজউক : তথ্য অধিকার আইন ও সিটিজেন চার্টার বিষয়ক কর্মশালা

আগের সংবাদ

মাথা নত করি না, তাই চক্রান্ত : নৌকায় ভোট চাইলেন প্রধানমন্ত্রী > যাদের নর্দমা থেকে তুলে এনেছি, তারা টাকা ছড়াচ্ছে

পরের সংবাদ

দ্বাদশ নির্বাচন প্রসঙ্গে দুটি কথা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

যখন লেখাটি লিখছি, তখন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে মাত্র ৬ দিন বাকি। রাজনৈতিক অঙ্গনে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যত নাটকীয়তা, উত্তাপ, পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি এবং নির্বাচন বয়কট করবার হুঁশিয়ারি, হুংকার সবই যেন ক্রমশ স্থিমিত হয়ে আসছে। এমনকি আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের বিষয়টিও উত্তাপ হারিয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচনকে মাথায় নিয়ে যিনি বা যারা ছিলেন অধীর, অস্থির সেই ঢাকায় মার্কিন অ্যাম্বেসির কর্তাব্যক্তিদের ছোটাছুটি করতে এখন তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। তাদের উত্তেজনা কমেছে বলে অনেকেই মনে করছে। কিংবা তারা অন্য কোনো কৌশলে হাঁটছে কিনা, সেই প্রশ্নও অনেকেরই। যা হোক, উপরন্তু বেড়েছে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা। প্রচারণার উত্তাপে দেশের শহর, গ্রামগঞ্জ ও প্রত্যন্ত অঞ্চল মুখরিত। পোস্টারে পোস্টারে, ব্যানারে ছেয়ে গেছে রাজপথ, অলিগলি, পাড়া-মহল্লা। আবার আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র বিধির বিষয়টি কোথাও কোথাও সহিংসতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না, বয়কট করেছে ফলে সেই জায়গাটি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দখলে চলে যাচ্ছে বা যেতে পারে বলে কারো কারো শঙ্কা রয়েছে। রাজনীতির যে সংস্কৃতি বাংলাদেশে, তাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একজন রাজনীতিক কখনোই ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না, ঊর্ধ্বে অবস্থান করতে দেখা যায়নি কখনোই। দল বা দেশের চাইতে ব্যক্তি-গোষ্ঠী স্বার্থই তাদের কাছে মুখ্য হয়ে থেকেছে। আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারে শক্তির লড়াই সব সময়ই থেকেছে। ফলে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে জনমনে বেশ শঙ্কা রয়েছে, রয়েছে সংশয়। এই শঙ্কা ও সংশয় যে সত্য, তা সাম্প্রতিক সময়ের সহিংস ঘটনাই বলে দিচ্ছে। বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের জন্য এটা সুখবর বয়ে আনবে কিনা শেষ অব্দি, একটা বড় ধরনের প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
যা হোক, বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার বিষয়টি ভবিষ্যতে তাদের অস্তিত্ব সংকটের অন্যতম কারণ হতে পারে বলে অনেকের ধারণা। তারা মনে করছে, বিএনপি তার অস্তিত্বকে দৃশ্যমান করতে ভোটে অংশগ্রহণ করতে পারত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির বারবার নির্বাচন বয়কট করার আচরণটি জনসংযোগ থেকে দলটিকে দূরে রেখেছে, দূরে ঠেলে দিয়েছে। দলটি যদি বিশ্বাস করে থাকে, জনগণ তাদের চাচ্ছে কিংবা একটা পরিবর্তনের জন্য তাদের সঙ্গে আছে, তাহলে সেটা প্রমাণের অন্যতম কৌশল হতে পারত ভোটে অংশগ্রহণ করে তা দেখিয়ে দেয়া। অন্তত এতে ভোটে প্রাপ্ত সমর্থন এর মাত্রা বুঝা যেত। অথচ বিএনপি সেই পথে হাঁটেনি। কিছুদিন আগেও রাজপথে বিএনপির মিছিলের যে শোডাউন দেখা গেছে এবং বলা হয়েছিল দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা এবং তাদের সঙ্গে সাধারণ জনগণ এই নির্বাচনকে মানে না, তাদের সেই উত্তাপ, উত্তেজনা মাঠে আর দেখা যাচ্ছে না। নেই বললেই চলে। ফলে এই শোডাউন নিয়ে সংশয় দেখা গেছে সাধারণ জনমনে। আবার বিএনপির ডাকা হরতাল, অবরোধ দলটির দুর্বলতাকেই দৃশ্যমান করেছে বলে কেউ কেউ মনে করে। দলটির সঙ্গে জনসমর্থন কতটা, সেই হিসাবও মেলাতে পারছে না সাধারণ মানুষ। যদিও নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি নিয়ে জনমনে বেশ অসন্তোষ রয়েছে জনমনে। কিন্তু বিএনপি তার রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও কৌশলগত দুর্বলতার কারণে সাধারণ জনগণের অসন্তোষকে নিজেদের শক্তিতে পরিণত করতে পারেনি বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছে। দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার যেভাবে নেতাকর্মীদের ধরপাকড় করছে, বাধা সৃষ্টি করছে, তাতে সরকার পতন ও নির্বাচন বয়কটের আন্দোলন শক্তিশালী করা সম্ভব হচ্ছে না। যুক্তিটাকে যদি মেনে নেয়া হয়, তাহলে তার সঙ্গে আরো একটা প্রশ্ন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সেটা হলো, বিএনপির সঙ্গে জনসমর্থন বলে কোনো কিছু আদতে আছে কি? দ্বাদশ নির্বাচনের প্রার্থী মানেই হলো, আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থী। স্বতন্ত্র প্রার্থী কখনোই দলের অন্তর্ভুক্ত হয় না। হতে পারে না। অর্থাৎ যিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে অংশগ্রহণ করেন, তাকে দল থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। তার সঙ্গে কোনো দলের পরিচয় থাকে না। তাকে নির্বাচনী লড়াই করতে হয় নিজের জন্য। ফলে আওয়ামী লীগ থেকে যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তারা আর আওয়ামী লীগের কেউ নন এবং তারা আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করবেন, সেই আশা করাও যুক্তিযুক্ত নয়। ক্ষমতার লড়াই রাজনৈতিক আদর্শ বা অতীতকে ব্যক্তির ভেতর বহাল রাখে বা রেখেছে বলে জানা নেই। সুতরাং এবারের নির্বাচন ঘিরে জনমনে বেশ কৌতূহল দেখা যাচ্ছে। আরো একটি বিষয়, সেটি হলো প্রার্থীদের নিয়ে যত আলোচনা ও সমালোচনা, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বড় জায়গাজুড়ে আছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। বিশেষ করে হলফনামায় প্রার্থীদের যে সম্পদ ও আয়ের বিবরণ দেয়া হয়েছে, তাতে অনেকেই বিস্মিত হয়েছে। একটি জরিপে দেখা গেছে, রাজনীতি করে দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করেছেন, এমন ব্যক্তিত্বের সংখ্যা এবার দ্বাদশ নির্বাচনে খুবই কম। বরং ব্যবসায়ী, আমলা ও অন্যান্য পেশার সংখ্যা বেড়েছে। যাদের সাধারণ মানুষ অন্যভাবে, অন্যরূপে চেনে, জানে। এই প্রবণতা প্রতি বছরই বাড়ছে। এতে যে বিষয়টি লক্ষণীয়, তা হলো, মাত্র ৫ বছরের মধ্যে কোনো কোনো সাংসদের আয় ও সম্পদের পরিমাণ বহুগুণে বেড়ে গেছে, যাচ্ছে। হলফনামায় প্রার্থীদের উল্লিখিত আয় ও সম্পদের হিসাব খতিয়ে দেখা হয় কিনা জানা নেই। তবে খতিয়ে দেখার সুপারিশ প্রতি বছরই থাকে, উত্থাপিত করা হয় বিভিন্ন সচেতন মহল থেকে।
অন্যান্য পেশা থেকে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা বাড়ছে। বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত আমলা, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণাধারদের। এমনকি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, খেলোয়াড়, কেউই পিছিয়ে থাকছে না। জীবনে কখনোই জনসংযোগ ঘটেনি, এমন ব্যক্তিত্বও রাজনীতিতে নাম লেখাতে আগ্রহী সাংসদ হওয়ার আকাক্সক্ষায়। কারণ অবশ্যই আছে, থাকে। রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করলে, ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন জবাব মিললেও একটা কমন বিষয় অধিকাংশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে, কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে, কিংবা দলটির গঠনতন্ত্র, সংবিধান মেনে রাজনীতি করার চাইতে ব্যক্তি আগ্রহটাই বেশি এখানে। ফলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়টির জন্ম হয় সহজে। দুর্নীতির প্রসার ঘটে। একটা কথা না বললেই নয়, গত সংসদ অধিবেশন প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন সব সাংসদকে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার জিরো টলারেন্স অবস্থান নিয়ে। দুঃখজনক হলেও সত্য, কোনো কোনো দুর্নীতিবাজ সাংসদ, নেতা প্রধানমন্ত্রীর এই কঠোর হুঁশিয়ার এবং অবস্থানকে সেই অর্থে অনুসরণ করেনি। ফলে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক দলের যে আদর্শ, তা অনুধাবন ও অনুসরণে দুর্নীতিবাজ সাংসদের যথেষ্ট গাফিলতি ও তোয়াক্কা না করার প্রবণতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। এতে দলের আদর্শের চাইতে ব্যক্তিস্বার্থই বারবার প্রতীয়মান হয়েছে। জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। রাজনীতি করলে বিত্তশালী, ক্ষমতাশালী হওয়া যায়, এমন ধারণার বাজার এখন তুঙ্গে। দল করলে ক্ষমতা আছে, টাকা আছে, না করলে নেই। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলে থাকা চাই। অধ্যাবসায়, সময়ানুবর্তিতা ও সততার বাজার বহু আগেই মন্দায় পরিণত হয়েছে। বুঝে, না বুঝে লম্বা লাইন দলে নাম লেখাতে সবাই ব্যস্ত। জনসংযোগ ছাড়াই ঘরে বসে জনপ্রতিনিধি হওয়ার খায়েশটা অনেকেরই। মাঠে যাওয়ার, জনসংযোগের অভিজ্ঞতা নেই অথচ জনপ্রতিনিধি হতে চান, প্রার্থীদের এমন প্রবণতা ভোট প্রদানে ভোটারদের নিরুৎসাহিত করতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করছে। আগে জনসংযোগ করে, জনগণের সমর্থন নিয়ে প্রার্থী হওয়ার, জনপ্রতিনিধি হওয়ার কথা রাজনীতিবিদরা ভাবতেন, এখন নিয়ম উল্টে গেছে। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য এখন রাজনীতির পোশাক লাগে না, পরিচয় লাগে না, এমনকি মাঠের অভিজ্ঞতাও লাগে না। ওপর থেকে পড়ে মাঠে গেলেই প্রার্থী হওয়া যায়। কিন্তু জনপ্রতিনিধি কি হওয়া যায়? সম্ভবত নয়। আর সেটাই স্পষ্ট হয় কম সংখ্যক ভোট প্রদানের বিষয় দেখে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, ভোট প্রদানে ভোটাররা খুব বেশি আগ্রহবোধ করেন না, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য ভালো লক্ষণ নয়। দ্বাদশ নির্বাচনে প্রার্থীদের যে তালিকা, তাতে অদূর ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো রাজনৈতিক দল আদর্শিক অর্থে সরকার গঠন করতে পারবে বলে মনে হয় না। অরাজনৈতিক ব্যক্তিরাই মুখ্য হয়ে উঠতে পারে।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়