পিবিআই কমকর্তার বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ

আগের সংবাদ

স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখা ঘোষণা

পরের সংবাদ

ভাগযোগ-অসহযোগ : তলে তলে বিয়োগ

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ২৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কবে, কখন সরকারকে সহযোগিতা করেছে বিএনপি- প্রশ্নটি এসেছে দলটি অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করায়। কিন্তু জবাব নেই। বিএনপির দিক থেকে জবাব দেয়ার লোক থাক বা না থাক, কেউ তাদের করেও না প্রশ্নটি। এরপরই তাদের জবাব দেয়া বা না দেয়া। হরতাল-অবরোধের দ্বৈরথের মাঝেই বিএনপি দিয়েছে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা। এই প্রজন্মের কাছে অসহযোগ আন্দোলন ইতিহাসের পাঠ-পঠনের বিষয়। সেখানে তারা মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের একাধিক চ্যাপ্টার পায়।
সেই পঠন আর হাল বাস্তবতার সঙ্গে তারা অসহযোগ আন্দোলনের নমুনা খুঁজে পায় না। বরং প্রশ্নবিদ্ধ হয়- এই বুঝি অসহযোগ আন্দোলন? অসহযোগ আন্দোলন নামের তামাশার বিপরীতে সুষ্ঠু নির্বাচনের মশকরা। ভাগাভাগি, বোঝাপড়া, ডামি, ছাড়, কনসেশন ইত্যাদির কাউন্ট-ডাউনে ঘনিয়ে আসছে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন। ভাগযোগ-অসহযোগের এ সার্কাসের আড়ালে যে বড় রকমের বিয়োগকাণ্ড ঘটে চলছে, সেদিকে খেয়াল করার ফুরসতও মিলছে না। সেই সময়ই বা কই?
শিক্ষার্থীসহ তরুণরা যে সমানে বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছে, সেই খবর অনেকটাই উহ্য বা বেখবরে। দিন দিন এ সংখ্যা কেবল বাড়বাড়ন্ত। রাজনীতি-অর্থনীতি মিলিয়ে নানা কারণে দেশের সামগ্রিক সামাজিক ব্যবস্থার জেরে কেউ ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষা নিলে তাকে বিসিএস ক্যাডার বা বড় বড় সরকারি চাকরিতে দেখতে চায়। ভাবা হয় না, চাইলে সবাই সরকারি চাকরি পায় না। পাওয়া সম্ভবও নয়। অন্যদিকে বেসরকারি সেক্টরে জব নিশ্চয়তা নেই। তাই উন্নত কোনো দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলে পরবর্তী প্রজন্ম সিকিউরড একটা লাইফ লিড করবে- এমনটাও ধারণা ভর করেছে অনেকের। কোনো না কোনোভাবে বিদেশে পাড়ি জমানোর ঘোর তাদের মাঝে। গেলে আর দেশে ফেরার গরজ আসে না তাদের অনেকেরই। বিদেশ পাড়ি জমানো শ্রমিকদের মোটামুটি হিসাব থাকলেও শিক্ষার্থী হিসেবে যাওয়াদের সঠিক সংখ্যা বের করা কঠিন।
ইউনেস্কোর ‘গেøাবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি-লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন ৪৯ হাজার ১৫১ শিক্ষার্থী। তারা বিশ্বের ৫৮টি দেশে পড়াশোনার জন্য গিয়েছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সংযুক্ত আরব আমিরাত গিয়েছেন ১১ হাজার ১৫৭ জন। যুক্তরাষ্ট্রে ৮ হাজার ৬৬৫ জন, মালয়েশিয়ায় ৬ হাজার ১৮০ জন, অস্ট্রেলিয়ায় ৫ হাজার ৬৪৭ জন, কানাডায় ৫ হাজার ১৩৬ জন, জার্মানিতে ৩ হাজার ৯৩০ জন, যুক্তরাজ্যে ৩ হাজার ১৯৪ জন, জাপানে ২ হাজার ৮০২ জন, ভারতে ২ হাজার ৭৫০ জন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১ হাজার ১৭৬ জন। ২০২১ সালে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৪৪ হাজার ২৪৪ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এদিকে ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান এখনো না পেলেও চলতি বছর বিদেশে যাওয়ার হার অনেক বেশি হবে বলে ধারণা। বিদেশে শিক্ষার্থী পাঠানো পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারণা চলতি বছর সংখ্যাটি সোয়া এক লাখের বেশি হতে পারে। করোনার কারণে দু’বছর বিদেশে শিক্ষার্থী নেওয়া বন্ধ ছিল। পরে এটা চালু হলে শিক্ষার্থীদের বিদেশ গমনের হারও বেড়েছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, দেশে চাকরির অনিশ্চয়তা, মানসম্মত শিক্ষার অভাব, গবেষকদের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়াসহ নানা কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এটা দোষের নয়। কিন্তু দেশের জন্য ক্ষতি অবশ্যই। শিক্ষার্থীর বাইরে মধ্যবয়সি অনেকের মাঝেও বিদেশমুখিতা।
বিদেশ পাড়ি জমানোর ঘটনার বেশির ভাগই ঘটে নীরবে বা ঘোষণা ছাড়া। যাওয়ার আগ পর্যন্ত পরিবারের বাইরে নিকটজনদেরও জানানো হয় না। তলে তলে এভাবে বিদেশ যাওয়ার পর মাঝেমধ্যে তাদের আগমন বা যাতায়াতও হয় নিঃশব্দে। তারা খবরে আসেন প্রবাসে কোনো বিপদে পড়লে। বিদেশ যেতে জমি বিক্রি, ঋণ করে টাকা জোগাড় তলে তলে ঘটালেও খবরের ফর্দে আসে বিদেশে বিপদে পড়লে, মরুতে কষ্টের শিকার হলে, ভূমধ্যসাগরে ডুবলে বা আটকা পড়লে। এ সুযোগে ইউরোপসহ বিভিন্ন স্বপ্নের দেশে পাঠানোর কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেয়ার বাজার এ কঠিন সময়েও বেশ জমজমাট। বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে ফেরত চাইতেও পারেন না তখন। বিদেশ যেতে পারলেও যে তাদের সবাই খুব ভালো থাকেন এমনও নয়। অঘটনে পড়ে মৃত্যু হলে লাশ আনার সময়ে বলা হয় বৈধ পারমিট নিয়ে যায়নি। কিন্তু জীবিতকালে তার ডলার যখন আসে তখন কেউ বলে না, সে বৈধভাবে যায়নি।
বিদেশপাগল এই সম্প্রদায়টি জানেও না বিশ্বজুড়ে অভিবাসনের সম্ভাবনা কমে আসছে। যথারীতি তারা পাগলপারা দেশ ছাড়তে। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডায় পালানোর দিন শেষ হয়ে আসায় সময় ও নিষ্ঠুর বাস্তবতার এ স্রোতে এবার চীনে গিয়ে সেখান থেকে হংকং, ম্যাকাও পালানো শুরু করেছে একদল বাংলাদেশি। চীনের ভিসা নিয়ে গুয়াংজু ও শেনজেন গিয়ে প্রায় ২০০ বাংলাদেশি সমুদ্র দিয়ে নিকটস্থ হংকং ও ম্যাকাওতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। অনেকে সফল হলেও কয়েকজন কোস্ট গার্ডের হাতে ধরা পড়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র, পাহাড় ডিংগিয়ে হংকং, ম্যাকাও ঢুকছে।
বর্তমানে চীনের শেনজেন, গোয়াংজুতে রাস্তায়, শপিংমলে, হোটেলে ব্যাপক তল্লাশি চালাচ্ছে। এই ঘটনার পর থেকে সব বাংলাদেশিকে বিমানবন্দর তো বটেই হোটেলে গিয়ে পর্যন্ত জেরা করছে চীনা পুলিশ। অনেককে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এমনকি বহু হোটেলে আগাম বুকিং থাকার পরও বাংলাদেশিদের নেয়া হচ্ছে না পুলিশি তৎপরতার কারণে। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডায় পালানো শেষ বলে এখন চীনে যেতে হবে? এটি তলে তলের কোনো খেলা না হলে রক্ষা। এ রকম সময়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে রোহিঙ্গাদের যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসন বাড়ানোর আশ্বাসে টোকা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
বলেছে, পাশাপাশি রোহিঙ্গা পুনর্বাসন করতে অন্য দেশগুলোকেও উৎসাহ দেবে তারা। এ রকম সময়ে কী দরকার পড়ল এমন খবর জানান দেয়ার? তাও আবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে। বিজ্ঞপ্তিটিতে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে, ১৩ থেকে ১৫ ডিসেম্বর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বৈশ্বিক শরণার্থী ফোরামের (জিআরএফ) আয়োজন করা হয়। শরণার্থীদের নিয়ে সবচেয়ে বড় এ সম্মেলনে ২৬টি বিষয়ে প্রতিশ্রæতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাতে উঠে এসেছে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টিও।
রোহিঙ্গাসহ, আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক নানা বিষয়ে এমনিতেই সময়টা খারাপ। তার ওপর ভূরাজনীতি ও বিশ্বায়নের জের। ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট স্বাক্ষরিত ইন্দো-সোভিয়েত শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তিটি সে সময়ে পাক-ভারত উপমহাদেশের রাজনীতি-কূটনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সামাজিকতার খোলনলচা পাল্টে দিয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পরে দুটো আত্মা এক হয়ে যায় অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারত বিশ্ব রাজনীতিতে একই সুরে কথা বলতে থাকে।
এটি ছিল স্নায়ুযুদ্ধের সময় ভারতের পূর্ববর্তী জোটনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে একটি উল্লেখযোগ্য বিচ্যুতি এবং ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রারম্ভ। ইন্দো-সোভিয়েত বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তিটি চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক বৃদ্ধির কারণে সম্পাদিত হয়। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৯ আগস্ট চীন-যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান অক্ষের বিরুদ্ধে কৌশলগত সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে ভারত সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে এই মৈত্রীচুক্তি সই করে। এ চুক্তি সই হওয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ এক নতুন মাত্রা পায়। আর পাকিস্তান চুক্তিটিকে আখ্যা দেয় ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় আগ্রাসনের ছাড়পত্র’ নামে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তির পর এটি প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের সফরের সময় ২০ বছরের ইন্দো-রাশিয়ান বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার চুক্তি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আশা আকাক্সক্ষার বিপরীতে গিয়ে পাকিস্তানের শাসকদের পক্ষ নিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমানে রাশিয়া) এবং ভারত অবস্থান নেয় বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের পক্ষে। বিশ্বায়নের এ পর্বে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের এই ক্রান্তিকালে শাসকগোষ্ঠীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। র‌্যাব এবং এর কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এসবই যুক্তরাষ্ট্র করছে বিশ্বব্যাপী তার আধিপত্য বিস্তারের টার্গেটে। যেমনটি একাত্তরে এ অঞ্চলে করেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন বন্ধু একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ্যে বিরোধিতাকারী চীন ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ সরকার গঠন করলে ৩১ আগস্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। নতুন প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত বিশ্বে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বিএনপিসহ কয়েকটি বিরোধী-দলের চলমান আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং অন্যান্য গণতন্ত্র সমর্থনকারী দেশগুলো অবস্থান নেয়ার কারণে ফলাফল কী হতে পারে- এমন জিজ্ঞাসার মাঝে তলে তলের টুকটাক ঘটনাও শঙ্কা জাগায়। যেমন ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়