ধরা পরে কানের দুল গিলে ফেলল ছিনতাইকারী

আগের সংবাদ

ইসিকে কঠোর হওয়ার তাগিদ

পরের সংবাদ

মার্কিনি আরব বসন্ত এবং আজকের বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের মনঃপুত না হলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ‘আরব বসন্তের মতো’ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে বলে সতর্ক করেছে রাশিয়া। গত ১৫ ডিসেম্বর রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এই মর্মে বিবৃতি দিয়েছেন। এ বিষয়ে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) ব্রিফিংয়ে একজন সাংবাদিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের কাছে তার মন্তব্য জানতে চান। জবাবে ম্যাথিউ মিলার বলেন, আমরা বাংলাদেশে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকে সমর্থন করি এবং এর চেয়ে বেশি বলার মতো আমার আর কোনো মন্তব্য নেই। পাশাপাশি ‘আরব বসন্ত’ নয়, ‘বাংলা বসন্তের’ জন্য এ দেশের মানুষ প্রস্তুত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। এসবের অর্থ হচ্ছে নির্বাচন প্রতিহত করার অভিলাষী দলের মধ্যে মার্কিনি অভিসন্ধির ব্যাপারে বেশ ‘জোশ’ লক্ষ করা যাচ্ছে। অর্থাৎ নির্বাচনে বাধা দেয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরে নির্বাচনবিরোধীরা মার্কিনি তৎপরতায় পুলকিত অনভুব করছে! তাহলে ব্যাপারটি এ রকম দাঁড়ায় যে, আরব বসন্ত বাংলাদেশে রপ্তানি করার লক্ষ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বহুমুখী ষড়যন্ত্র চলমান থাকা সম্পর্কে মারিয়া জাখারোভার বক্তব্যের সারবত্তা আছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ‘আরব বসন্ত’ কী? ‘আরব বসন্ত’ বলতে আরব অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে ২০১০ সালের শেষের দিকে শুরু হওয়া গণজাগরণকে বোঝায়। এতে আরব রাষ্ট্রগুলোর জনগণের বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ ও আন্দোলন সংগঠিত হয়। তাই ‘আরব বসন্ত’ বা ‘আর রবিউল আরাবি’ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়। আরব বসন্তের শুরু হয় ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিউনিশিয়ায়। এরপর তা মিসরে, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায়। আরব বিশ্বের এই গণঅভ্যুত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রগুলো অস্ত্র সরবরাহ করে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। এভাবে ‘আরব বসন্ত’-এর মাধ্যমে ওইসব দেশের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা স্থায়ীভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রেখেছে। আরব দেশগুলোর তুলনায় রাজনৈতিক উন্নয়নের দিক দিয়ে অধিকতর অগ্রসর বাংলাদেশে এ ধরনের মার্কিন ষড়যন্ত্রের নীলনকশা নিশ্চিতভাবেই মুখ থুবড়ে পড়বে।
বর্তমানে ‘আরব বসন্ত’ রপ্তানির মার্কিনি ষড়যন্ত্র আজকের বাংলাদেশে ব্যর্থ হতে বাধ্য। কেন ব্যর্থ হবে মার্কিন ষড়যন্ত্র? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য এবং বিষয়টি সম্পর্কে অধিকতর উপলব্ধি ও হৃদয়ঙ্গমের নিমিত্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু পাকিস্তান এবং আমেরিকার জন্য লজ্জাকর ও অপমানজনক দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা বিবেচনার্থে এখানে উল্লেখ করা সঙ্গত মনে করছি।
প্রথম ঘটনা ১৯৭১-এর। পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক সামরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সক্রিয় সমর্থন এবং সহযোগিতা সত্ত্বেও ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধরত বাঙালি মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে ‘ডড়ৎষফং নবংঃ ভরমযঃরহম ভড়ৎপব’ হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্বে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনো সেনাবাহিনীর এত বিশালসংখ্যক আত্মসমর্পণের ঘটনা আর ঘটেনি। আর এমন প্রকাশ্যে অস্ত্র ও আত্মসমর্পণের ঘটনা মানব ইতিহাসে আরেকটিও নেই। আমেরিকার মতো শক্তিশালী সমর্থক থাকার পরও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক ঘটনা বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান বাংলাদেশে ‘মার্কিন আরব বসন্ত’ বা মার্কিনিদের অন্যসব ষড়যন্ত্রের পরিণতি বিবেচনা করা যেতে পারে। অর্থাৎ কোনো ষড়যন্ত্রই বাংলাদেশের অগ্রগতি রুখতে পারবে না।
দ্বিতীয় ঘটনাটি বা দুর্ঘটনাটি ঘটে ছিল ১৯৮৮ সালে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর শেষ পর্যন্ত তার নিজের তৈরি ‘ধর্ম যোদ্ধাদের ধাওয়া’ খেয়ে ২০২১ সালে আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটি সাম্প্রতিককালের খবর। কিন্তু ১৯৮০-এর দিকে পাকিস্তানে মার্কিন প্রভাব-প্রতিপত্তির স্বর্ণযুগ চলেছে। ‘আরব বসন্ত’ শব্দবন্ধের ব্যবহার তখনো অবশ্য শুরু হয়নি। তবে আফগানিস্তানে সোভিয়েত উপস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আফগান মুজাহিদদের সশস্ত্র যোদ্ধা হিসেবে প্রস্তুত করার লক্ষ্যে সব ধরনের আয়োজন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর এসব মার্কিন আয়োজনের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন আমেরিকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু পাকিস্তানের ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক।
১৭ আগস্ট, ১৯৮৮ : সি-১৩০ হারকিউলিস হেলিকপ্টারে চড়ে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী সেনা ছাউনি ভাওয়ালপুর যাচ্ছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউল হক। সঙ্গে ছিলেন পাকিস্তানে তৎকালীন আমেরিকান রাষ্ট্রদূত আর্নল্ড রাফেল এবং সিনিয়র মার্কিন সামরিক অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হার্বার্ট এম ওয়াসমসহ মোট ৩০ জন। উদ্দেশ্য মরুভূমির পরীক্ষাস্থলে মার্কিন কোম্পানির তৈরি এম-১/এ যুদ্ধ ট্যাঙ্কের একটি প্রদর্শনী দেখা। এই ট্যাঙ্ক কেনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন পাকিস্তানকে চাপ দিচ্ছিল। ফেরার সময় উপহার হিসেবে ভাওয়ালপুরের বিখ্যাত আম উপঢৌকন দেয়া হয়েছিল হেলিকপ্টার যাত্রী প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক এবং অন্যান্য ভিভিআইপিকে। লকহিড কোম্পানির তৈরি এই হেলিকপ্টারটি ভাওয়ালপুর থেকে কয়েক মাইল দূরে, হঠাৎ সুতলজ নদীর কাছে মাটিতে আছড়ে পড়ে! ফলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং জিয়াউল হকসহ দুর্ঘটনাকবলিত হেলিকপ্টারটির সব আরোহী মারা যান। উড়ন্ত অবস্থায় উঁচু থেকে পড়ার কারণে আরোহী সবার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আমেরিকান সাংবাদিক জে এপস্টাইন ১৯৮৯ সালের ভ্যানিটি ফেয়ারের ইস্যুতে জেনারেল জিয়াউল হকের মৃত্যুর বিবরণটি এ রকম- ‘… গ্রামবাসী সি-১৩০ হেলিকপ্টারটি আকাশে ঊর্ধ্বমুখী হতে দেখেছে, যেন এটি একটি অদৃশ্য রোলার কোস্টারে রয়েছে। এর তৃতীয় লুপের পরে, এটি সরাসরি মরুভূমির দিকে নিমজ্জিত হয়, মাটিতে নিজেকে সমাহিত করে। তারপরে, এটি বিস্ফোরিত হয় এবং জ্বালানি পোড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আগুনের বল হয়ে যায়।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পাকিস্তান কোনো রাষ্ট্রই এই হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার কারণ এবং এর জন্য দায়ী কাউকেই সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারেনি। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পাকিস্তান। সেনাশাসক জিয়াউল হকের বন্ধু আমেরিকা হওয়া সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন অসহায় অবস্থার উদাহরণ ‘ভুল ওষুধ’ প্রয়োগের মার্কিনি ধারা আমাদের সামনে হাজির করে। তাই সেখান থেকে ২০২৩-এ এসে বাংলাদেশকে নিয়ে ‘মার্কিন আরব বসন্ত’ এবং অন্যান্য ষড়যন্ত্রের পরিণতি উপলব্ধি করা যেতে পারে। এটি সহজেই বোঝা যায় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের বন্ধু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক ও রাষ্ট্রদূত আর্নল্ড রাফেলকে বাঁচাতে পারেনি, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রই বাংলাদেশে ‘আরব বসন্ত’ সৃষ্টি করতে পারবে না।
উপরের দুটি ঘটনা থেকে আরো একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, মার্কিনিদের বন্ধুত্বের অবলম্বনে বিএনপি-জামায়াত জোট কর্তৃক দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভণ্ডুল করার প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। যেমন মার্কিনিদের বন্ধুত্ব ১৯৭১ সালে বাঙালি মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে ‘বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা’ ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণ ঠেকাতে পারেনি। যেমন জিয়াউল হক ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত রাফেলকে বহনকারী সি-১৩০ হারকিউলিস হেলিকপ্টারে নাশকতামূলক দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি!
তবে মার্কিন ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক থাকা দরকার। গেল ১৫ ডিসেম্বর ৮ দফা দাবি কার্যকর করতে আমেরিকার আমদানিকারকদের সংগঠন অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনকে (এএএফএ) একটি চিঠি দিয়েছে কংগ্রেসের আট সদস্য। যেখানে বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন ২৩ হাজার টাকা করতে দেশটির ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে চেপে ধরার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের ভেতর অবস্থিত কারখানার শ্রমিকদের বেতন ওয়াশিংটনের চাওয়া অনুযায়ী বৃদ্ধি করতে ও এএএফএকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে ওই চিঠিতে। শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর নামে গত ১৬ নভেম্বর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার খড়গ নিয়ে হাজির হয় বিশ্ব অর্থনীতির মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র। যারা শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে নিজেরাই মানে না আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব নির্দেশনা!
এমন সব হুমকি-ধামকি, আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই এবার বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রাণ তৈরি পোশাকশিল্পকে বেকায়দায় ফেলতে নতুন ছক কষেছে মার্কিন কংগ্রেস। সরকার কর্তৃক পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ৫৬ শতাংশ বাড়ানোর পরে ও এমন ধরনের ‘মার্কিনি তৎপরতার বিরুদ্ধে’ বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিকদের নেতৃবৃন্দ ইতোমধ্যেই তাদের বক্তব্য দিয়েছেন। শ্রমিক নেতাদের অবস্থান বেশ পরিষ্কার। তারা বলছেন, বাংলাদেশের শ্রমিকরা ভালো থাকুক কখনই তা চায় না যুক্তরাষ্ট্র। বরং ক্ষতির পাল্লা ভারি করতেই একটার পর একটা কৌশল সাজিয়েছে ওয়াশিংটন। মার্কিন কংগ্রেসের এখতিয়ারবহির্ভূত এমন নাক গলানো যার বড় প্রমাণ। এক লাফে ৫৬ শতাংশের বেশি বেতন বাড়ানোর পরও মার্কিন কংগ্রেসের এমন নকশা আঁকাকে বাংলাদেশ ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন উদ্যোক্তারা। এসব নানামুখী তৎপরতা, বয়ান এবং আলোচনার মধ্যে দেশের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারে লিপ্ত রয়েছেন বিভিন্ন দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। লক্ষ্য একটাই- সব ষড়যন্ত্রের বাধা পেরিয়ে ৭ জানুয়ারি ভোট দেয়া।

প্রফেসর ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা; সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়