গণজাগরণের সাংস্কৃতিক উৎসব : রবীন্দ্র-নজরুলের সুরে মঞ্চ মাতালেন শিল্পীরা

আগের সংবাদ

শিল্পায়ন-কর্মসংস্থানের রোডম্যাপ : স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট ইশতেহার > ২৭ ডিসেম্বর ঘোষণা করবেন শেখ হাসিনা

পরের সংবাদ

স্বতন্ত্রের চাপে নৌকার প্রার্থীরা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য : চা-বাগান অধ্যুষিত হবিগঞ্জ-৪ আসনে স্বাধীনতার পর ৩টি নির্বাচন ছাড়া প্রতিটি নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী নৌকা মার্কা নিয়ে জয়ী হয়েছেন। আর জয়ের ক্ষেত্রে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করে চা শ্রমিকদের ভোট। স্বাধীনতার পর থেকেই তারা নৌকায় ভোট দিয়ে আসছেন। এ আসনে গত দুবার নির্বাচিত হয়ে এবারো নৌকা পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী। নির্বাচনের মাঠ অনেকটা অনুকূলেই ছিল তার জন্য। কিন্তু এবার নৌকার বিজয়ের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক যুবলীগ নেতা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত ব্যারিস্টার সাইদুল হক সুমন। ফলে ওই আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে মনে করছেন ভোটাররা। হেভিওয়েট এ দুই প্রার্থী প্রতীক পাওয়ার পর সরব রয়েছেন ভোটের মাঠে।
চট্টগ্রাম-১১ আসনে নৌকার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে মাঠে রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক সুমন। আওয়ামী লীগের এই নেতা ভোটের মাঠে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন নৌকার প্রার্থী আব্দুল লতিফকে। স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সমর্থনের পাল্লাও ভারী রয়েছে সুমনের দিকে। কেটলি প্রতীক পাওয়া প্রার্থী সুমন শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ফরিদপুর-৪ আসনে নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্যাহ। কিন্তু ওই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সন চৌধুরী গতবারের মতো এবারো নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হবেন বলে এরই মধ্যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশের এই তিন অঞ্চলের তিনটি আসনের চিত্রই এমন নয়; প্রায় ১৩০টি আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে চাপে ফেলেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। অথচ গুনে গুনে আর দিন-পনেরো বাকি। ভোটের প্রচার শেষ হবে। কিন্তু তার আগেই স্বতন্ত্রের কাছে যেভাবে চাপে পড়েছে নৌকা তাতে ভোট শেষে ফলাফল নিয়ে এখনই কেউ কোনো আগাম বার্তা দিতে চাচ্ছেন না। তাদের মতে, সুষ্ঠু ভোট হলে বহু আসনে নৌকার প্রার্থীদের হাসি উড়ে যেতে পারে। পাশাপাশি তফসিল ঘোষণার দিন থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। আধিপত্য ও ক্ষমতা দেখানোর এ সংঘাত এখন ভোটে জেতা না জেতার সংঘাতে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, হানাহানি ও মারামারির ঘটনা ঘটছে অহরহ।
এসব বিষয় টেনে এনে গত বুধবার সিলেটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী জনসভায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও দলের মনোনীত প্রার্থীদের উদ্দেশে বলেন, আপনি যদি এলাকায় এমপি থাকতে নিজের জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেন তখন সেখানে স্বতন্ত্র ঢুকে গেলে আমরা কী করব? কাজেই নৌকার ইজ্জত নৌকার প্রার্থীদের রাখতে হবে।
এবার নির্বাচনের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অন্তত ১৫ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে লড়াই করে বিজয়ী হতে হবে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও মন্ত্রিসভায় ২৩ মন্ত্রী, ১৮ প্রতিমন্ত্রী ও তিন উপমন্ত্রী রয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজন বাদে সবাই দ্বাদশ জাতীয়

সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। অন্য মন্ত্রীদের আসনে একাধিক প্রার্থী থাকলেও সেগুলোতে প্রতিদ্ব›িদ্বতা কম হবে। তাদের বিপরীতে যারা স্বতন্ত্র হিসেবে মাঠে নেমেছেন তাদের কেউ সাবেক সংসদ সদস্য, কেউ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। অনেকে আবার দলের স্থানীয় পর্যায়ের পদধারী নেতা। এসব আসনে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিজ দলের পদধারী শক্ত ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে লড়তে হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী অনড়। তিনি স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহীদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেন না। আর প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থানের কারণে অনেক আওয়ামী লীগ প্রার্থী, এমনকি বেশ কিছু ভিআইপি প্রার্থীর ঘুম হারাম। তারা এলাকায় না গিয়ে ঢাকায় তদবিরে ব্যস্ত। তারা চাইছেন প্রকাশ্যে না হলেও যেন কৌশলে স্বতন্ত্রদের বসিয়ে দেয়া হয়। যে যার মতো করে এই তদবির করছেন বলে জানা গেছে। আর ১৪ দলীয় জোটের যে সাতজনের আসন নিয়ে সমঝোতা হয়েছে, তারা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ পেয়েও ভয়ে আছেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে জেলা রিটানিং কর্মকর্তারা অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করেছিলেন; তারা অনেকেই আবার আপিল মামলা জিতে ফিরে এসে জোরেশোরে প্রচারণা শুরু করেছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বেশ কিছু প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে ভিআইপি প্রার্থীও আছেন। সব মিলিয়ে বিএনপি ছাড়া একপক্ষীয় নির্বাচনেও ব্যাপক টেনশনে আছেন নৌকার অনেক প্রার্থী। নির্বাচনি এলাকায়ও এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সঙ্গে বিদ্রোহী, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থকদের সংঘাত-সংঘর্ষ বাড়ছে। এরই মধ্যে সংঘর্ষে পিরোজপুরে একজন নিহত হয়েছেন। আর মনোয়নপত্র দাখিলের পর প্রচারণার এখন পর্যন্ত স্বতন্ত্র এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ জায়গায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। যেসব এলাকায় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন, সেসব স্থানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যেই বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধাপক ড. গোবিন্দ চক্রবর্তী ভোরের কাগজকে বলেন, এবারের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের সঙ্গে লড়াই করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এর ফলে নিজেদের মধ্যে দ্ব›দ্ব এবং মারামারির একটি শঙ্কা থেকেই যায়। এটা যাতে না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে। কারণ দ্ব›দ্ব বা মারামারির চেয়ে অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনটাই আসল।
এদিকে জাতীয় পার্টি ৪০টি আসন চাইলেও তাদের সঙ্গে ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগের সমঝোতা হয়েছে। কিন্তু এই ২৬ আসন থেকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেও রয়ে গেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এই ২৬ আসনের বহু আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা লাঙ্গলকে চাপে ফেলেছেন। এরকম পরিস্থিতিতে হবিগঞ্জ-১ আসনে (বাহুবল-নবীগঞ্জ) হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ কর্মিসভার ডাক দিয়েছে। আজ শুক্রবার সেখানে কর্মিসভা সম্পর্কে বলা হয়েছে, এই আসনে নৌকার প্রার্থীকে প্রত্যাহার করে লাঙ্গলের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আওয়ামী লীগের কর্মীরা যাতে লাঙ্গল প্রতীকের পক্ষে কাজ করেন সেজন্য এই কর্মিসভা। প্রসঙ্গত, এই আসনে শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটে লড়ছেন আওয়ামী লীগের সাবেক মহিলা সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী।
আওয়ামী লীগের গত সাত দিনের নির্বাচনী সভা এবং প্রথমসারির বেশ কয়েকজন নেতার বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিদ্ব›দ্বী যে কোনো প্রার্থীই চ্যালেঞ্জিং। সেক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও চ্যালেঞ্জিং। বিএনপি যদি নির্বাচন করত- তাহলে তাদের প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে হতো। তাহলে এখন কেন করা হবে না? তবে বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় প্রধানত স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী।
নির্বাচনী চিত্র বিশ্লেষণে আরো জানা গেছে, কমপক্ষে ১৩০টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিপক্ষে দলের এক বা একাধিক শক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন। এর মধ্যে কমপক্ষে ৮০টি আসনে দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। অনেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য তাদের কাছে ধরাশায়ী হতে পারেন। ওই নেতারা জানান, দলের শীর্ষ পর্যায়ে যে হিসাব আছে তাতে তারা মনে করেন- বিএনপি ছাড়া এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ নির্বাচন চান। চান উল্লেখযোগ্য ভোটারের উপাস্থিতি। আর স্বতন্ত্র যারা জিতবেন তারা আধিকাংশই আওয়ামী লীগের। ফলে ওই আসনগুলো আওয়ামী লীগেরই থাকবে। শেখ হাসিনা তাই জানিয়ে দিয়েছেন, মনোনয়ন দিয়েছি এখন নিজের যোগ্যতায় জিতে আসুন।
সার্বিক পরিস্থিকি বিশ্লেষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধাপক ড. শান্তনু মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল নির্বাচনে না আসায় স্বভাবতই এর পরিবেশ কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়েছে। তবে এ-ও সত্যি, দেশে নির্বাচনী ট্রেন চলতে শুরু করেছে। যারা এই ট্রেনে উঠেছেন তাদের নিয়েই ট্রেনটি গন্তব্যে যাবে বলে যাত্রা শুরু করেছে। তিনি বলেন, এবারের নির্বাচনটা এখন পর্যন্ত অভিনব। আগে হয়তোবা সারাদেশে দু-একজন শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী দেখা যেত। এবার অনেক। ডজন ডজন। যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন ফেয়ার হয়, সহিংস না হয় আর জাতীয় পার্টি আরো শক্তিমত্তা দেখাতে পারে তাহলে সব মিলিয়ে নতুন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে তিনি বলেন, দল থেকেই বলা হয়েছে- দলীয় প্রার্থীর বাইরে তারা স্বতন্ত্র হয়ে নির্বাচনে লড়তে পারবেন। এখন দেখা যাচ্ছে নির্বাচনে স্বতন্ত্ররা বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছেন। কোনো কোনো জায়গায় সংঘর্ষ পর্যন্ত ঘটেছে। তার মতে, এখানেই নির্বাচন কমিশনকে তার ক্ষমতা দেখাতে হবে। কমিশন যদি কারো পক্ষে না গিয়ে সুষ্ঠু ভোটের জন্য তার ক্ষমতা দেখাতে পারে তাহলে এই সংঘর্ষগুলো থেমে যাবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়