ডেঙ্গুতে রোগী ও মৃত্যু দুইই কমেছে

আগের সংবাদ

রেল সুরক্ষায় জিরো টলারেন্স : র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি, আরএনবি, আনসার সমন্বয়ে টাক্সফোর্স > বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা

পরের সংবাদ

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে কিছু কথা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ১৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে বর্বর পাকিস্তানিদের পরিকল্পিত গণহত্যার অংশ হিসেবে পূর্বে চিন্তিত বুদ্ধিজীবীদের হত্যার সূচনা হয়। ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের শহীদদের মধ্যে ছিলেন- অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, আতাউর রহমান খান খাদিম, আবদুল মুক্তাদির, এ এন এম মনিরুজ্জামান, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ফজলুর রহমান খান, শরাফত আলী এবং ল্যাবরেটরি স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল মোহাম্মদ সাদেক। গুলির আঘাতে জোর্তিময় গুহ ঠাকুরতা এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে মৃত্যুবরণ করেন। ড. ইন্নাস আলী ও তার সন্তান ফিরোজ আলী গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে যান।
এ পর্বে নিহত প্রায় শতভাগই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ দেশের গণতান্ত্রিক ও সামাজিক আন্দোলনে কিংবা ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলনে মদদ দিয়েছিলেন। একটা আক্রোশ চরিতার্থ কিংবা বাঙালিদের অবদমিত রাখার প্রয়াস হিসেবে এই হত্যাকাণ্ড করা হয়। সাম্প্রদায়িকতা একটা বড় উপাদান ছিল। হিন্দু শিক্ষকদের সংখ্যাধিক্য তার প্রমাণ বহন করে। মার্চ মাস থেকে শুরু করে দেশের হিতৈষী ও বিবেক বলে চিহ্নিত শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তারদের হত্যা চলতে থাকে। ভারতে হিজরতের মাধ্যমে অনেকে রক্ষা পায়। দেশান্তরী হতে না পারলেও অপরাপরগণ দেশের অভ্যন্তরে থেকে মুক্তিযুদ্ধটাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করছিলেন। গোপন লেখালেখি দিয়ে কিংবা বৈষয়িক সহায়তা তারা দিতে থাকেন। যোদ্ধাদের চিকিৎসা, খাদ্য ও আশ্রয়ের সংস্থান, গুরুত্বপূর্ণ খবর সরবরাহ, জনমত চাঙা রাখার কাজেও তারা প্রকাশ্যে কিংবা নিবৃত্তে কাজ করে যাচ্ছিলেন। অনেকে কর্মস্থলে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থেকে গ্রামে-গঞ্জে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা বয়ান করে যাচ্ছিলেন।
বিষয়গুলো পাকিস্তানি ঘাতক ও তাদের স্থানীয় সাঙ্গাত ও দালালদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি বলে তাদের মৃদু চাপ, ভয়-ভীতি থেকে শুরু করে মাঝে মাঝে কারাগারে কিংবা সেনা ক্যাম্পে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে সীমাবদ্ধ থাকলেও যতই যুদ্ধের প্রচণ্ডতা বাড়তে থাকে ততই স্থানীয় দালালদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে ও দিকনির্দেশনায় বুদ্ধিজীবী হত্যাটা স্থায়ী এজেন্ডা হিসেবে গৃহীত হয়। স্থানীয় দালালরা বিশেষত দক্ষিণপন্থি দলগুলো বিশেষত জামায়াত ও তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ রাও ফরমান আলীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় স্থানীয় বিহারি, রাজাকার, শান্তি বাহিনী, আলবদর বাহিনী। শেষোক্তটির নেতা ছিলেন মতিয়ূর রহমান নিজামী আর তার প্রয়াস অপারেশন ইনচার্জ ছিলেন মীর কাশেম আলী, চৌধুরী মইন উদ্দিন, আশরাফুজ্জামান খান, জহিরুল হক, আবু আহমেদ, আবু সুফিয়ান প্রমুখ। তারা বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি, তাদের ঠিকানা, গতিবিধি এবং কর্মধারা লক্ষ্য করতে থাকে এবং প্রতিদিন তা এসব রাও ফরমান আলীর কাছে প্রেরিত হয়। তাদের ডাটা ব্যাংক বাড়তে থাকে।
পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরুর পর অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বরের পর থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল যে তাদের স্বাদের পাকিস্তান ম্রিয়মাণ। তখন তারা মরণ কামড় দিতে থাকে। তারা আরো অনুভব করে যে স্বাধীন বাংলাদেশের আক্ষরিক অভ্যুদ্বয় শুধু সময়ের ব্যাপার। তাদের উদ্দেশ্য ছিল অভ্যুদ্বয় নিশ্চিত বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও অগ্রযাত্রা প্রতিহত করা। তারা এমন সব মানুষদের হত্যা করে যাদের অধিকাংশ বাংলার শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও আবহমান বাংলার জীবনাবরের শুধু ভক্তই ছিলেন না, ছিলেন তার নব রূপায়ন প্রত্যাশী। তাদের চিন্তা চেতনায় বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-ভাবনা স্থান নিয়েছিল। তাদের জীবন দর্শন ছিল অসাম্প্রদায়িকতা তথা বাঙালির চির লালিত মানবিকতা। পাকিস্তানের এই সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ ১৪ ডিসেম্বর তারিখে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে ২ শতকের বেশি অধ্যাপক, সাংবাদিক, লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তারকে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগ এলাকায় হত্যা করে কিংবা অন্যত্র হত্যা করে এসব এলাকায় ফেলে যায়। সে কারণে বাংলাদেশ সরকার এই দিনটিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে নামকরণ করেছে। আমরা প্রতি বছর দিবসটিকে স্মরণ করি, তবে যে আন্তরিকতা ও হৃদয়াবেগ দিয়ে তা করা হতো, এখন তা করা হয় কিনা সন্দেহ। সরকারি পর্যায়ে দিনটির চাকচিক্য দর্শনীয় হলেও সাধারণ্যে তার আবেদন অনেকটা হারিয়ে গেছে।
১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর এমনকি ডিসেম্বর ছাড়িয়ে জানুয়ারি মাসে যেসব বুদ্ধিজীবীকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে কিংবা কর্মস্থল থেকে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তাদের সংখ্যা অনেক। ১৯৭২ সালের তথ্যে দেখা যায় তাদের সংখ্যাটা ছিল হাজারের নিচে। তার একটা পরিসংখ্যান নিম্নরূপ :
১৯৭২ সালের পরিসংখ্যানে জানা যায় নিহত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শিক্ষাবিদ ৯৯১, সাংবাদিক ১৩, চিকিৎসক ৪৯, আইনজীবী ৪২ ও অন্যান্য মিলিয়ে সংখ্যাটা ১ হাজার ৯৫, তবে পরবর্তী পরিসংখ্যানে তাদের সংখ্যাটা ১ হাজার ১১১ জন বলে জানা গেলেও প্রকৃত সংখ্যাটি যে আরো অনেক তা বোধগম্য।
প্রাপ্ত তথ্যে আরো দেখা যায় বিশিষ্টজনদের মধ্যে আছেন- ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সিরাজ উদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, আলতাফ মাহমুদ, গোলাম মোস্তফা, আয়েশা বেদোরা চৌধুরী, সেলিনা পারভীন, মেহেরুন্নেসা, খোন্দকার আবু তালেব, মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন, নিজাম উদ্দিন আহমদ, রনদা প্রসাদ সাহা, রাখাল চন্দ্র দাস, সুখরঞ্জন সমাদ্দার, যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, শহীদ সাবের, শামসুদ্দিন আহমদ, বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায়, ওবায়দুর রহমান প্রমুখ। লক্ষ করলে দেখবেন তাদের মধ্যে একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা বেশি। তাদের কেউ কেউ সেই ১৯৪৭ সালেই পাকিস্তানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। তারা ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই আর হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। তারা কেউ কেউ আবার দিক ও দর্শন পরিবর্তন করে বাঁচতে পারেননি। তবে তাদের কেউ কেউ যে একমাত্র নিরীহ প্রকৃতির ছিলেন তাও জানা যায়। উদাহরণ স্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরাফত আলীর কথা বলা যায়। তিনি ছিলেন নরম-সরম মানুষ, নির্বিবাদী, শান্তশিষ্ট, এক অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
৪ মার্চ ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২৯ শিক্ষক ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন; যাদের মধ্যে শরাফত আলী ছিলেন না। এই সব বিবৃতিদাতার মধ্যে পরবর্তীতে শহীদ হয়েছেন- আনোয়ার পাশা, গিয়াস উদ্দিন আহম্মদ, ড. মোহাম্মদ আবুল খায়ের, ফয়জুল মহী, মুনীর চৌধুরী ও অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য বিবৃতিদাতা নয়, অথচ শহীদ হয়েছেন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সন্তোষ ভট্টাচার্য ও সিরাজুল হক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ মোর্তুজা।
’৭১-এর মার্চের ২৫ তারিখে শরাফত আলী শহীদ হলেও সবাই ধরে নিয়েছিলেন যে আমি নিহত হয়েছি। তারা হিসাবে ভুল করেছিল। শরাফত আলী আর আমার বাড়ি কাছাকাছি ছিল। আর সেকালে এত কাছাকাছি দুজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকা অচিন্তনীয় ব্যাপার ছিল। সেনাবাহিনীর আক্রোশ আমার প্রতি প্রবল ছিল। আমি ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগ রাজনীতি ও বিএলএফের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। শিক্ষক অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সপক্ষে ৩ মার্চ বেলা ১১টায় স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করে তা শিক্ষক সমিতি কর্তৃক পাস করিয়ে ছিলাম। শুনেছি, টিক্কা খান ক্র্যাকডাউনের যৌক্তিকতা প্রমাণে বলেছিলেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন স্বাধীনতার প্রস্তাব নেয় তখন ক্র্যাকডাউন ছাড়া কি উপায়ন্তর থাকে?
আমাদের আফসোস বেশ কিছু নিরীহ বুদ্ধিজীবীও হত্যার সম্মুখীন হয়েছেন। আরো আফসোস শহীদদের কিছু পরিবার যথার্থভাবে মূল্যায়িত হয়নি। বড় আফসোস হচ্ছে, ঘাতকদের একজন-দুজন ছাড়া আর সবাই পার পেয়ে গেছে। প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর স্মরণ করি বটে, কিন্তু যে জীবনাচারের উন্মেষ ঘটিয়ে এসব মানুষ আত্মাহুতি দিলেন, সেসব মানুষের স্বপ্ন কি স্বপ্নই থেকে যাবে?

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ; উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়