ডেঙ্গুতে রোগী ও মৃত্যু দুইই কমেছে

আগের সংবাদ

রেল সুরক্ষায় জিরো টলারেন্স : র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি, আরএনবি, আনসার সমন্বয়ে টাক্সফোর্স > বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা

পরের সংবাদ

এক অশ্রু মহাজলের কাব্য

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ১৪, ২০২৩ , ১২:৪৩ পূর্বাহ্ণ

আজ ১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিন ছিল এক রক্তমাখা বিষাদঘন দিন। পরাজয় নিশ্চিত জেনে বেপরোয়া হয়ে উঠে পাক হানাদার বাহিনী এবং তার দোসর রাজাকার আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। বিজয়ের উষালগ্নে বাংলার সোনার সন্তান আমাদের চির গৌরবের ধন বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। হত্যার পরিকল্পনার ছক কষে তারা চিঠি পাঠাতে থাকে। যমদূত বাহিনীর নামে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ থাকত : Due to your malicious ma chinations to fulfil the dream of ‘Akhand Hindusthan’, thou sands of innocent people have been butchered by you the agents of ‘Bharat Mata’, with the help of Indian armed infil. trators. You cannot conceal your seditious misdeeds, the penalty of which is death and death alone, correct your ways or else you will be eaten up by dogs and uvltures. Mind, you are under constant watch. -Jamdut Bahini
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে প্রায় ৩৬ জনকে এই ধরনের মৃত্যু পরোয়ানার হুমকি দিয়ে চিঠি দিয়েছিল। চারদিকে যুদ্ধ চলছে, তার উপরে ঢাকা শহরে ছিল কারফিউ। ফলে চিঠি পেয়ে সবাই কেউ কেউ আরো শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। দুঃসময়ে কাউকে বিশ্বাস করা কঠিন। আবার অনেকেই চিঠি পেলেও তাদের লক্ষ্য থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। নীরবে আপন মনে কাজ করে গেছেন। কিন্তু ঘাতকের দল কাউকে রেহাই দেয়নি। বাসা থেকে শিক্ষকদের ধরে নিয়ে গেছে। কেড়ে নিয়ে গেছে পরিবার পরিজন অর্থাৎ ভাইয়ের, বোনের, মায়ের, সন্তানের আলিঙ্গন থেকে। ছিনিয়ে নিয়েছে স্ত্রীর বাহুবন্ধন থেকে।
পরিবারের সদস্যদের সামনে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য তার স্বজনরা কোনোদিনই ভুলবে না। ভোলারও কথা নয়। একটা সাদা কাদা মাখানো মাইক্রেবাস নিয়ে শহীদ ডা. ফজলে রাব্বীর বাসা ঘিরে রাজাকার, আলবদর, পাকিস্তানি আর্মি তুলে নিয়ে যায়। শহীদ ডা. ফজলে রাব্বিকে ধরে নিয়ে যাবার স্মৃতি চারণে তার স্ত্রী ডা. জাহানারা রাব্বি লিখেছেন, “ইতোমধ্যে ডা. রাব্বি দারোয়ান ইদ্রিসকে ডেকে তালা বন্ধ সদর দরজা ও সিঁড়ির দরজা খুলে দিতে বলেছিলেন। এক সময় দেখলাম তিনি ওদের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করেছেন। চারদিক থেকে ৫-৭ জন সশস্ত্র সৈন্য তাকে ঘিরে আছে। তিনি নামতে শুরু করলেন সিঁড়ির দরজা পেরিয়ে। আমি দৌড়ে গিয়ে বাধা দিতে চেষ্টা করলাম। ‘হল্ট’ বলে দু’জন এগিয়ে এস আমার বুকে বন্দুকের নল চেপে ধরল- আমি স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে গেলাম। আমি দেখলাম পেছন থেকে তিনি মাথা উঁচু করে হেঁটে গিয়ে গাড়িতে উঠলেন। গাড়িটা আস্তে আস্তে চলতে শুরু করল।” একইভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অনেক ডাক্তার, অধ্যাপক, শিক্ষক, প্রকৌশলী, সাংবাদিকদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সাহিত্যিক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে যখন পরিবার পরিজনের সামনে থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখন তিনি ছিলেন অভুক্ত। দুপুরের খাবারের আয়োজন চলছিল ভাই লুৎফুল হায়দার চৌধুরীর বাসায়। ঠিক এই সময় তাকে আলবদররা কাঁদামাখা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। রফিকুল ইসলাম এ ঘটনার বিবরণে লিখেছেন, ‘…অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তখন মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলেন কিন্তু সে সুযোগ আর তাকে দেয়া হয়নি। শুধু এক গøাস পানি খেয়ে, লুৎফুল হায়দারকে বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি চলে যান, যাবার সময় শেষ কথা বলে যান, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি, আমি ফিরে আসব’। পাবনার চিকিৎসক ছিলেন অমলেন্দু দাক্ষী। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে বাসায় খাবার টেবিল থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের ২৫ তারিখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মীর আবদুল কাইয়ুমকে তার রাজশাহী শহরের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন ঘড়ির কাঁটায় সময় রাত আনুমানিক নয়টা। অধ্যাপক কাইয়ুমকে একজন জানালেন তাকে বাইরের একজন আর্মি অফিসার ডাকছে। অধ্যাপক কাইয়ুম তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি আর বাসায় ফিরে আসেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশিদুল হাসান এবং আনোয়ার পাশা একসঙ্গে চা খাচ্ছিলেন, এই অবস্থায় তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ডা. মর্তুজাকে তার ফুলার রোডের বাসা থেকে মেয়ের ওড়না দিয়ে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরেই জামা কাপড় পরার সুযোগ দেয়া হয়নি দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে। লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরিহিত সাংবাদিক সিরাজুদ্দীনকে তার চামেলীবাগের বাসা থেকে গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়। এগুলো দুয়েকটা খণ্ডচিত্র মাত্র।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তার সহযোগী দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাসই অর্থাৎ ২৫ মার্চ থেকেই হত্যাযজ্ঞ শুরু করে এবং তা অব্যাহত থাকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। কিন্তু নভেম্বর মাস থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মাত্রা বাড়তে থাকে এবং ১৪ ডিসেম্বর সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটে। ঢাকা থেকে শুরু করে একেবারে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেধাবী সন্তানদের তালিকা ধরে ধরে হত্যাকাণ্ড চলতে থাকে। সমগ্র বাংলাদেশের হাজারো বধ্যভূমিতে কান পাতলে অজস্র শহীদের কথা শোনা যাবে। যা এখনো অব্যক্তই রয়ে গেছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যেসব বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো মৃত্যুর আগে এতটাই নির্যাতন করা হয়েছিল, অমানুষিক যন্ত্রণা দেয়া হয়েছিল, তা খুবই লোমহর্ষক এবং কষ্টকর। টর্চার সেল তৈরি করেছিল অনেক প্রতিষ্ঠানে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষককে তার প্রতিষ্ঠানের টর্চার সেলেই নির্যাতন করা হয়েছে। মৃত্যুর আগে অনেকেই পানি চেয়েও পেয়েছিল বুটের লাথি। কাউকে পরদিন সকালে বাসায় ফেরত পাঠানো হবে বলে নিয়ে যাওয়া হলেও তাদের জীবনে আর কাল সকাল আসেনি। মাত্র একদিন পরেই ছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। শত্রæমুক্ত বাংলাদেশ। কিন্তু ১৯৭১ সালের সূর্য লাল আকাশ তাদের জন্য ছিল না। প্রিয় স্বদেশভূমির এই লাল সূর্য আর তারা কোনোদিন দেখবে না!
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জনের পর ঢাকা শহরের বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবীদের গলিত লাশ পাওয়া গেছে শিয়ালবাড়ী আর রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে। বাংলাদেশের মানুষ স্বচক্ষে দেখেছে কী বীভৎস সেই দৃশ্য! কারো চোখ তুলে ফেলা হয়েছে, কারো হাতের আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়েছে, কারো মাথা থেকে মগজ বের করা হয়েছে। এভাবে একের পর এক হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় সারি সারি পড়েছিল বুদ্ধিজীবীদের লাশ বধ্যভূমিতে।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অনেক। বাঙালির স্বাধিকার ও মুক্তির সংগ্রামে কম বেশি সবাই সম্পৃক্ত ছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা যেভাবে দেশের রাজনীতির লক্ষ্য স্থির করেন। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরাও সেই পথে হেঁটেছেন। ব্রিটিশ আমল থেকেই বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের প্রতিটি সংগ্রামে তারা রাজনৈতিক নেতাদের পথ দেখিয়েছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের গণঅভুত্থান, কিংবা স্বাধিকারের প্রশ্নে অটল অবিচল থাকা, বা নির্বাচনের মেনিফেস্টোতে মতামত যুক্ত করা এসবের প্রতিটি ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণ ছিল। এমনকি পাকিস্তান শাসনামলে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে অনেক শিক্ষক জেল খেটেছেন, আত্মাহুতি দিয়েছেন। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহার পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা সমগ্র পূর্ব বাংলায় দাবানলের মতো ছড়িয়েছে। আন্দোলন জোরদার হয়েছে। আইয়ুব খানের পতন পর্যন্ত ঘটিয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুজিবনগর সরকার গঠন, আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরা, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা, জনসংযোগ তৈরি করা ইত্যাদি বিষয়ে বুদ্ধিজীবীরা অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে। ফলে পরাজয় সন্নিকটে জেনে, পাক-বাহিনী এবং তার দোসররা বুদ্ধিজীবী নিধনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং শিক্ষক, সাংবাদিক এবং বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষদের ঘর থেকে ধরে নিয়ে আসে এবং একজনের পর একজনকে হত্যা করে এবং তা বেশিরভাগই সংগঠিত হয় এই ১৪ ডিসেম্বরে। এই হত্যাযজ্ঞ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল মূলত জাতি হিসেবে আমাদের মেধাহীন, পঙ্গু করে দেয়া।
শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের বিস্মৃত হয়ে কোনো দেশ বড় হতে পারে না। কখনো পারবেও না। আমাদের উচিত প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ দেশের সব জেলা-উপজেলায় সব শহীদের স্মৃতি বা স্মারকগুলো নিয়ে সংগ্রহশালা গড়ে তোলা। আমাদের পাঠ্যসূচিতে তাদের আত্মত্যাগের কাহিনিগুলো সন্নিবেশিত করা। যাতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যেগুলোর মাধ্যমে আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ঐশ্বর্য ও বেগবত্তাকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করতে পারবে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে শহীদ সব বুদ্ধিজীবীর স্মৃতির প্রতি রইল আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।

ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়