এসএসসি পরীক্ষার ভুয়া রুটিন ফেসবুকে

আগের সংবাদ

‘খণ্ডিত জাপা’-আ.লীগ জোট না করার অনুরোধ রওশনের : গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, অবৈধভাবে নেতৃত্ব দখল করেছে কাদের

পরের সংবাদ

সচেতন-অবচেতন মনের কারসাজি

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রায় ৮০০ কোটি। এই বিপুল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ বা করপোরেট ব্যক্তি বিভিন্ন প্রকার কৌশল অবলম্বন করে থাকে। বহুকাল ধরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ চলে আসছে, বর্তমানে অবচেতন মনকেও নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
মানুষ মূলত স্নায়ু এবং শরীর- এই দুভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। স্নায়ু দ্বারা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সবাই অবহিত হলেও শরীর কর্তৃক (অবচেতন মন) নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বেশির ভাগ অজ্ঞ। যখন মানুষের সচেতন মন সক্রিয় থাকে তখন নিয়ন্ত্রণ থাকে স্নায়ুর হাতে আর যখন অবচেতন মন সক্রিয় থাকে তখন নিয়ন্ত্রণ থাকে শরীরের হাতে, দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে চিন্তাশক্তি কাজ করতে পারে না। যাদের কাছে ক্ষমতা একমাত্র ঈশ্বর তারা নিজেদের স্বার্থে সাধারণ মানুষের সচেতন অংশকে অকার্যকর করে রাখে। একটা মেশিনকে যেমন দীর্ঘদিন অযতেœ ফেলে রাখলে মরিচা ধরে যায়, তেমনি সচেতন অংশকে ব্যবহার না করলেও সচেতনতার শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। এ সম্পর্কে এলিট শ্রেণি বেশ ভালোভাবেই অবহিত আছেন। তাই জন ডি রকফেলার এবং আমেরিকান টাইকুনরা এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন করেছেন, যাতে বুদ্ধিজীবী বা চিন্তাশীল ব্যক্তি তৈরি না হয়ে শুধু শিক্ষিত কর্মচারী তৈরি হতে পারে। যেসব উপদানের মাধ্যমে সচেতনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো শিক্ষাব্যবস্থা।
রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শাসক শ্রেণিকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়। এই ব্যবস্থা দৃশ্যমান বলে জনগণের স্বার্থ পরিপন্থি নিয়মকানুন হলে আন্দোলন এবং প্রতিবাদের ভয় থাকে, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণ অদৃশ্য বলে শাসকের জবাবদিহি করার ভয় থাকে না। মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণকে ইংরেজিতে সাইকোলজিক্যাল ম্যানিপুলেশন বলা হয়। সাইকোলজিক্যাল ম্যানিপুলেশনের জনক হলো এডওয়ার্ড বার্নেস। তিনি মূলত তার চাচা ফ্রয়েডের সূত্রগুলোকে বাস্তবে কাজে লাগিয়েছেন।
একটা বিষয় মনে রাখতে হবে- ব্যাবিলন, মেসোপটেমিয়ার সময়কাল থেকে একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠী সব সময় গুপ্ত জ্ঞানচর্চায় নিবেদিত ছিল। তারা ক্ষমতা অর্জন করতে চেয়েছে। যেহেতু জ্ঞান ছাড়া ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব নয়, তাই তারা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে উন্নত হয়েছে। ক্ষমতা শুধু অর্জন করলেই চলে না, বরং তাকে ধরে রাখার ব্যবস্থাও করতে হয়। যদি এলিট শ্রেণি সচেতন অংশকে নিষ্ক্রিয় করে না রাখত, তবে শ্রেণি-বৈষম্য ধরা পড়ত। খেয়াল করলে দেখবেন, অনেক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে শ্রেণি-বৈষম্য থেকে সৃষ্টি হওয়া প্রতিবাদ থেকে। তাই সাধারণ জনগণ সচেতন না হয়ে সাধারণ জীবনযাপন করলে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা সহজ হয়। এ কারণে এলিট শ্রেণি অবচেতন মনকে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ফায়দা লুটে। যেহেতু বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ, তাই সচেতনতাকে সক্রিয় করে রাখা কঠিন বিষয় নয়। শিক্ষাব্যবস্থা, মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সংস্কৃতির মাধ্যমে মানুষের সচেতনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই পুরো বিষয়টা বুঝতে হলে জানতে হবে সচেতন এবং অবচেতন মন কী জিনিস, এরা কীভাবে কাজ করে এবং অবচেতন মনকে কীভাবে প্রোগ্রাম করা হয়। তাহলেই এলিটি শ্রেণি বা রাষ্ট্র কীভাবে অবচেতন মনকে নিয়ন্ত্রণ করে সেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে।
দুই.
মানুষের শরীর অখণ্ড বস্তু নয় বরং ৩০ ট্রিলিয়ন সেলের সমন্বয়ে গঠিত বিশাল এক কমিউনিটি। মানুষের মনও অখণ্ড নয়। বস্তুত সচেতন, অবচেতন এই দুই অংশের সমন্বয়ে মনের যাবতীয় কার্যাবলি সম্পাদিত হয়। এদের আলাদা আলাদা কাজ আছে। ইংরেজিতে সচেতন মনকে কনশাস মাইন্ড এবং অবচেতন মনকে সাব-কনশাস মাইন্ড বলা হয়। মানুষের অবচেতন অংশের পরিমাণ হলো ৯৫ শতাংশ আর বাকি ৫ শতাংশ হলো সচেতন অংশ। এ থেকে খুব সহজেই বোধগম্য হয়, মানব মনের বিশাল অংশজুড়ে অবচেতন মন বিস্তৃত। সচেতন মন ক্ষুদ্র হলেও এ অংশ দিয়েই অবচেতন মনের কর্মসূচি নির্ধারণ করতে হয়।
সচেতন এবং অবচেতন মন নিয়ে জানার পূর্বে আমাদের বুঝতে হবে, সচেতনতা কী জিনিস? উধারফ ঈযধষসবৎং (একজন অস্ট্রেলিয়ান দার্শনিক এবং সংজ্ঞানাত্মক বিজ্ঞান-কগনেটিভ সাইন্টিস্ট) বলেন, সচেতনতা কিছু স্তর পর্যন্ত ফান্ডামেন্টাল বা মৌলিক। এখানে মৌলিক বলতে আদি উপাদান যেমন স্পেস, ম্যাটার, সময় ইত্যাদির মতো পদার্থকে বোঝায়। তিনি আরো বলেন, সচেতনতা সর্বব্যাপী। প্যানসাইকিজমে (চধহঢ়ংুপযরংস) মনকে একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরা হয়েছে, যা মহাবিশ্বের সর্বত্র বিদ্যমান। ডেভিড সালমারের মতবাদকে অনুসরণ করে বলা যায়, প্রতিটি মানুষকে যে সচেতনতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে তা মৌলিক। ধর্মে একে রুহ বলা হয়েছে। এই রুহের কাজ হলো মানুষকে চৈতন্য দেয়া। কোয়ান্টাম মেকানিক্স (পরমাণু এবং অতিপারমাণবিক কণার আচরণ বর্ণনা করে) অনুযায়ী, প্রতিটি বস্তুর মধ্যে চেতনা আছে। ফোটন বা অ্যাটমের মধ্যেও চেতনা বিদ্যমান। তবে মানুষের মধ্যে যে সচেতনতা তা কেবল স্নায়ুর মতো জটিল অর্গানিজমে সম্ভব। এ প্রসঙ্গে ডেভিড সালমার বলেন, যখন জটিলতা (কমপ্লেক্সিটি) যথাযথ মাত্রায় উপস্থিত থাকবে, তখনি এমন ধরনের সচেতনতা সম্ভব। এই চেতনতার দীর্ঘ স্তর আছে। মন এবং নফসকে এই স্তরগুলো অতিক্রমের মধ্য দিয়ে উন্নত হতে হয়।
এতক্ষণ আমরা জীবনের মৌলিকত্ব নিয়ে জানলাম। এখন জানব সচেতন মন বলতে কী বোঝানো হয়। সচেতন মন হলো সৃজনশীল অংশ। এই অংশ মনের সবচেয়ে ওপরে অবস্থান করে। সচেতনতা ব্যক্তিগত এবং বিষয়গত বলে একমাত্র ব্যক্তি একে অনুভব করতে পারে। অস্তিত্ব প্রমাণের একমাত্র উপায় হলো সচেতন হওয়া। যে ব্যক্তি সচেতন হয়ে উঠতে পারে তার ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। ডেকার্টের একটা বিখ্যাত দর্শন আছে, ‘আই থিংক দেয়ারফর আই অ্যাম’। এর অর্থ হলো ‘আমি চিন্তা করি তাই আমি আছি’। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, যদি কোনো মানুষ চিন্তা করতে না পারে তবে কি তার অস্তিত্ব সংকটে পড়বে? বিষয়টা তেমনি। মানুষ যদি চিন্তার সচেতনতা এবং যুক্তি দিয়ে নিজের অস্তিত্বের পরম অর্থ উপলব্ধি করতে না পারে তবে সেই জীবন যথার্থ নয়। এই যে পুঁজিবাদ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে অথচ মানুষ তা বুঝতে অক্ষম, এর কারণ চিন্তাহীনতা। এ প্রসঙ্গে বায়োলজিস্ট ব্রুস লিপটন বলেছেন, ৩০ বছর আগেই মানুষ তার চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এ গেল সচেতনতার আলাপ। এখন মূল বিষয় অবচেতন মন নিয়ে আলোকপাত করব।
সচেতন মনের পরের স্তরের নাম অবচেতন মন। এই মন জাগ্রত চেতনার বাইরে অবস্থান করে এবং একে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ বা অনুভব করা যায় না। ধরুন, আপনার বাসায় একটা নতুন কম্পিউটার আনা হলো। এই যন্ত্রের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এটা একা একা কাজ করতে পারবে না। এ জন্য প্রথমে পাওয়ার দিতে হবে, কম্পিউটার চালু করে প্রোগ্রাম সেট করতে হবে, তারপর খুলে যাবে অপার সম্ভাবনার দুয়ার। কম্পিউটারের সফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যার যেমন একত্রে কাজ করে, মানুষের মনও তেমনি সচেতন এবং অবচেতন অংশের সমন্বয়ে কাজ করে। একজন পাইলটকে যেমন পূর্ব থেকে অটো পাইলটের সব কাজকর্ম নির্ধারণ করে দিতে হয়, মানুষকেও তেমনি সচেতন মন দ্বারা অবচেতন মনের প্রোগ্রাম নির্ধারণ করতে হয়। একবার প্রোগ্রাম সেট হয়ে গেলে অবচেতন মন অনেকটা অটো পাইলটের মতো কাজ করতে পারে। মূলত অবচেতন মন হলো প্রতিদিনের অভ্যাস এবং চিন্তা-চেতনার ফলে গড়ে ওঠা বৃহৎ অংশ। অতীত কাজকর্মের ভিত্তিতে অবচেতন মনে কাজের একটা প্যাটার্ন তৈরি হয়। সে অনুযায়ী শরীর বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রকম আচরণ করে অর্থাৎ আমরা তাৎক্ষণিকভাবে মানুষের মধ্যে যে আচার-আচরণ দেখতে পাই তা মূলত অতীত অভ্যাসের একটা রূপ।
শিশু জন্মের প্রথম ৭ বছর সময়কে প্রোগ্রামিং পিরিয়ড বলা হয়। এ সময় সচেতন মনের উঁচু স্তর কাজ করতে পারে না। এখানে কম্পন একটু নিচু (খড়বিৎ ারনৎধঃরড়হ) থাকে বলে কনশাসনেসও তুলনামূলকভাবে নিচু হয়। আমরা যে হিপনোটিজম বা সম্মোহনের কথা শুনে থাকি, তা এ স্তরেই সংগঠিত হয়ে থাকে। সাধারণত মানুষ সম্মোহনের মাধ্যমে শেখে। সম্মোহন বা হিপনোথেরাপির সময় যে পেন্ডুলাম ব্যবহার করে বলা হয়- তুমি ক্লান্ত, এর কারণ মানুষ যখন ক্লান্ত থাকে তখন স্নায়ুর ভাইব্রেশন কমে যায়।
আধো ঘুমে থাকা সময়কে থেটা আর পুরোপুরি ঘুমিয়ে যাওয়ার স্তরকে বলা হয় ডেল্টা। থেটা স্তরে কল্পনা এবং বাস্তবতা এক হয়ে যায়। এ কারণে খেলার সময় শিশুদের কাপে চা না থাকলেও তারা অভিনয় করে চা খেয়েছে এবং সেটার স্বাদ ভালো ছিল। তারা ঝাড়ুকে ঘোড়া বানায়। ঝাড়ুকে তারা ঝাড়ু হিসেবে দেখে না বরং ঘোড়া হিসেবেই দেখে। এ স্তরে বাচ্চারা আশপাশের মানুষজনের আচার-আচরণ দেখে দেখে শেখে এবং সে অনুযায়ী পরবর্তীকালের আচরণ তৈরি হয়। বস্তুত প্রকৃতি মানুষকে থেটার স্তর দিয়েছে যাতে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রোগ্রাম নির্ধারণ করা যায়। যেহেতু শিশুরা অবোধ তাই এ সময় মা-বাবাকেই সতর্ক থাকতে হয়, যাতে তাদের মনে নেতিবাচক কোনোকিছুর প্রভাব না পড়ে। যদি একটা শিশুকে যথাযথভাবে প্রোগ্রাম করা যায় তবে সে সচেতন এবং সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। সাত বছর পর শিশু আস্তে-ধীরে সচেতন হতে শুরু করে। তাই ৪০০ বছর ধরে জেসুইটসরা তাদের অনুসরণকারীদের বলে আসছেন, আমাকে ৭ বছরের একটা শিশু দাও, আমি তোমাদের একজন দক্ষ মানুষ তৈরি করে দেখিয়ে দেব।

রোমেনা আফরোজ : কবি ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়