ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যু কমেছে

আগের সংবাদ

নতুন উত্তাপ ‘১০ ডিসেম্বর’ > মানববন্ধন করবে বিএনপি, ঘরোয়া কর্মসূচি আ.লীগের > অনুমতি ছাড়া করলে ব্যবস্থা : ডিএমপি

পরের সংবাদ

ঘরের আঙিনাকেই করেছে বিদেশ

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চেষ্টাও করি না, আর ভুলেও যাই না। জ¦লজ¦ল করে মনে থাকে, আবার কখনোবা নতুন করে মনে পড়ে যায় নতুন ঘটনা। নাচের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মৃদঙ্গ বা পাখোয়াজ বা তবলার দ্রুত বোলের সঙ্গে ঘুঙুরের তীব্র ঝনৎকার একটি শান্ত বিন্দুতে মিশে যেত নাচের সূচনায়। বাঁশির সুরে বেজে উঠত রবীন্দ্রনাথের কোনো গান, টেক্সটের সঙ্গে শুরু হতো নাচ। শিল্পীর ঈষৎ উত্তোলিত হাতের ভঙ্গিতে দেখা দিত রবীন্দ্রনাথের আঁকা নারীমূর্তির আভাস। রচিত হয়ে যেত রবীন্দ্রনাথের রেখাশিল্পের শরীরে নৃত্যশিল্পের এক সম্ভাব্য প্রতিমা। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে সেই ১৯২৬ সালে প্রথম একটি নাচ তৈরি হয়েছিল। প্রতিমাদেবী ‘পূজারিণী’ কবিতাকে নির্ভর করে একটি মূকাভিনয় করাবেন জেনে রবীন্দ্রনাথ লিখে ফেললেন একটি নাটক- যার অভিনয়ের অন্তিম মুহূর্তটি মিশে যাচ্ছে একটি নাচে। বাঙালির ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে সেটিই কিন্তু প্রথম নাচ। মণিপুর থেকে আসা নৃত্যশিক্ষক নবকুমার সিংহের শেখানো কিছু ভঙ্গি আর প্রতিমা ঠাকুরের অভিনয়-নির্দেশ নিয়ে নেচেছিলেন গৌরী বসু। সেই থেকে শুরু। থেমে থাকেনি আর বাঙালির নৃত্যপ্রীতি। এরপর একে একে সৃষ্টি হয়েছে নানা সৃজনমূলক নৃত্য নির্মাণ ও নিরীক্ষার ধারা। এরই ধারায় ১৯৬১ সালে অমলাশংকর ও উদয়শংকর তাদের নিজস্ব শৈলীতে তৈরি করলেন ‘সামান্য ক্ষতি’র নৃত্য। সেই প্রযোজনায় পণ্ডিত রবিশংকর ও ওস্তাদ আলী আকবর খান নানা ভারতীয় ধ্রæপদি ও লোকসংগীতের যন্ত্র ব্যবহার করে এক অন্যতম আবহ নির্মাণ করলেন। রবীন্দ্রনৃত্য থেকে নৃত্য তার জায়গা করে নিল বাংলায়। আমাদের জীবনভর বিশেষ করে শৈশব আর যৌবনে জীবনের অর্থ খুঁজে পেতাম নৃত্যের আসরে।
‘স্বাধীনতা তুমি রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান/স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা…’ কাজী সব্যসাচী, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপল দত্তের কণ্ঠে কবিতা শুনতে শুনতে এক দিন পেয়ে গেলাম শামসুর রাহমানের কবিতা। মন-প্রাণ উজার করে দিল শামসুর রাহমানের সেই কবিতা। রেকর্ড প্লেয়ারের গান, কবিতা সেকি ভুলে যাওয়া যায়! ১৮৮৭ সালে এমিল বার্লিনার গ্রামোফোন আবিষ্কার করেন। সেই গ্রামোফোন কোম্পানির প্রথম রেকর্ডিং ইঞ্জিনিয়ার এফডব্লিউ গেসবার্গ ১৯০২ সালে ভারতবর্ষের প্রথম ভারতীয় শিল্পী গওহর জানের রেকর্ড তৈরি করতে সাহায্য করেন। সাত ও দশ ইঞ্চি ব্যাসের একটি রেকর্ডে গওহর জানের গানগুলো রাখা হয়। ভারতে গ্রামোফোন খ্যাতির প্রধান কারণ ছিল গওহর জানের রেকর্ডের জনপ্রিয়তা। এরপর হেমেন্দ্রমোহন ‘হিজ মাস্টার’স ভয়েস থেকে যন্ত্রপাতি ভাড়া করে স্থানীয় প্রখ্যাতদের কণ্ঠস্বর রেকর্ড করতেন। কালক্রমে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে গ্রামোফোন ও রেকর্ড বাঙালি পরিবারের একটি মর্যাদার বিষয়ে পরিণত হয়। ইতিহাসের পাতাটুকু নয়, বরং মনে পড়ে সেই কণ্ঠের জাদু কবিতায়-গানে। কোথায় হারিয়ে গেল সেসব? তুমি কি কেবলই স্মৃতি/মঞ্চে মঞ্চে কেবলই কি ছবি? কাজী সব্যসাচীর ভরাট কণ্ঠে ‘এখনো নজরুল’ কবিতায় ‘তোমার বুকের মধ্যে নাকি হাত রাখেন ঈশ্বর/মুখের ওপর উপচে পড়ে আলোর তরঙ্গ।’ সাত ইঞ্চি ব্যাসার্ধের ছোট্ট রেকর্ডগুলো শুনে কত অনুভব জাগত হৃদয়ে! ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে ‘আমার সকল চাওয়া বিফল হলো’, দেবব্রত বিশ্বাসের গলায় ‘সে যে বাহির হলো আমি জানি’- এসব গান কী করে ভুলে যাই? রেকর্ডে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মান্না দে, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়, বেগম আখতারের গান শুনে কেটেছে আমাদের শৈশব-কৈশোর-যৌবন। সুচিত্রা মিত্রের ‘কৃষ্ণকলি আমি তারে বলি’, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ও যে মানে না মানা’ গানগুলো যে গভীর মায়ার আবেশ ছড়াত, তার রেশ কাটেনি আজো। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কিংবা লতা মঙ্গেশকরের গান যখন রেকর্ডে বাজত, সে গান আর তাদের থাকত না- শ্রোতারই হয়ে যেত একান্তভাবে। প্রশ্ন তো জাগবেই- যখন দেখি, কবে যেন হারিয়ে গেছে ওসব জীবন থেকে! রেকর্ডের পর ক্যাসেট এলো, ক্যাসেটের পর সিডি, তারপর ডিভিডি, এমপিথ্রি প্লেয়ার। এখন এগুলো ইতিহাস। ল্যাপটপে আজ নেই ডিভিডি ড্রাইভও। এখন পেনড্রাইভের যুগ, অ্যাপে গান শোনার যুগ, স্পটিফাই, ইউটিউব আরো কত কী! আমাদের চোখের সামনেই হলো এত এত পরিবর্তন। কিন্তু প্রাণের মাঝে রেকর্ডে এখনো বাজে যেসব গান, উচ্চারিত হয় যেসব কবিতা- সেসব যাবে কোথায়?
পরীক্ষার খাতায় যখন ভাবসম্প্রসারণ লিখতে দিত ‘প্রতিকারহীন, শক্তের অপরাধে/বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’- তখন রবিঠাকুরের ওপর খুব রাগ হতো। কেন যে এমন কঠিন কঠিন কবিতা উনি লিখতে গেলেন। যখন কথাটা প্রথম শুনেছিলাম, খুব অবাক হয়েছিলাম। সবসময় শুনে আসছিলাম- রবীন্দ্রনাথ জমিদার বংশের দুলাল। কিন্তু পরে জেনেছিলাম, বৈভব নিয়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে জন্মালেও প্রায় সারা জীবনই রবীন্দ্রনাথকে আর্থিক সংকটে ভুগতে হয়েছে। কবির পরম বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে লেখা বেশ কিছু চিঠিতে প্রকাশ পেয়েছিল কবির আর্থিক সংকটের অনেক অজানা কথা। জীবন সায়াহ্নে এসেও এই বিশ্বকবি আর্থিক সংকট থেকে মুক্তি পাননি। প্রথম জীবনে নিজের খরচে বই প্রকাশ, বই কেনা, বাড়ি তৈরি, কন্যাদের বিবাহ, পারিবারিক ব্যবসার সংকট নিরসনসহ নানা কারণে তাকে ঋণ করতে হয়েছিল। দেশ-বিদেশের দানশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে বিশ্ব ভারতীর প্রয়োজনে অনুদান পাওয়ার পরও তাকে ঋণ নিতে হয়েছিল। এর বাইরে তো জমিদারির মাসোহারা ছিলই। কল্পলোকে বিচরণ করা এই বিশ্বকবি জীবনের কঠিন বাস্তবের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তেই লড়াই করে গিয়েছেন। কিন্তু তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে মারা যাননি; ঋণমুক্ত হয়েই যেতে পেরেছিলেন। আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছে চিরঋণীই হয়ে থাকলাম। আমরা ঋণী তার কবিতার কাছে, তার লেখার কাছে, তার মানবতাবাদের কাছে। আজো তার কবিতা-লেখা-গান বাঙালির প্রাণের কথা বলে, একাত্মতার কথা বলে, সংকট নিরসনের ছবি তোলে।
আজ এই স্বাধীন দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তে নানা জাতির, নানা ধর্মের মানুষের কণ্ঠে শুধু বিচ্ছেদের সুর, বিরোধের ঘৃণা। বিচ্ছিন্নতার সংকট ছাড়াও বিভেদের রাজনীতি সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। কবিতা নয়, গান নয়, নৃত্য নয়- এখন শুধু ধর্মীয় বর্ম দিয়ে সবকিছু আড়াল করার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ কিংবা ভারতের লোকসংস্কৃতিতে বিচ্ছেদ-বিরোধ-বিভেদের এমন সর্বগ্রাসী সমস্যা এত প্রকটভাবে ধরা দিতে আগে কখনো দেখিনি। ইতিহাস বলে- বহু যুগ ধরে ভারতবর্ষের সমাজজীবনে নানা জাতি-ভাষা-ধর্ম এসে মিশেছে। এ দেশের মাটিতে যেমন ছিল আদিবাসীরা, তেমনি পরবর্তীতে নানা সময়ে বাইরে থেকে এসেছে অনেকে। বাইরে থেকে আসা মানুষগুলো এখানেই থেকেছে-মরেছে, আবার নতুন প্রজন্ম জন্মেছে। এভাবেই ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের একসময়ের ভারতবর্ষ পৃথিবীতে উজ্জ্বল হয়ে থেকেছে তার বহুত্ববাদের সংমিশ্রণের কারণে। রবীন্দ্রনাথ তার ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় তাই লিখেছিলেন- ‘কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা/ দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা/হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন/শক-হুন-দল পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন।’ ভারতবর্ষ এবং পরের ভারত এবং বাংলাদেশের আদি সংস্কৃতিতে তাই দেখা গেছে ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের তান’। সেই কবে ১৯৩৩ সালে মানব ইতিহাসের প্রধান সমস্যা সম্পর্কে কবি বলেছিলেন- ‘মানবসমাজের সর্বপ্রধান তত্ত্ব মানুষের ঐক্য। সভ্যতার অর্থই হচ্ছে একত্র হবার অনুশীলন।’
কিন্তু আজ আমাদের সেই পরিচিত সমাজে ঐক্য নেই- আছে শুধু ভৌগোলিক আকার, ধর্মের ঠিকানা। তাই ঘরের আঙিনাকেই রেখেছে বিদেশ করে। জনমানসে সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বাসহীনতার পাহাড়। উগ্র জাতীয়তাবাদের ধাক্কায় হারিয়ে গেছে আমার শৈশব-যৌবনের সেসব নৃত্য, কবিতা, গান। হারিয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের অমর বাণী- আমরা মানুষ। আমরা যদি এক না হই, তবে সে লজ্জা, সে অধর্ম। আমাদের মনুষ্যত্বে ধিক! আজ আমরা বিভেদের বারুদের গন্ধে নৃত্যের ছন্দ বুঝি না, গানের কলি অনুভব করি না, কবিতার ছন্দে ছন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠি না। শুধু খুঁজি- ওরা আর কেউ নয়, ওরা আমাদেরই শত্রæ। এমনটা হয়ে গেছে বলেই আজ বাঁশিও হয়েছে সংগীতহারা। তাই তো দেখি, বাংলায় সবকিছু ছাপিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও বিদ্বেষের ইন্ধন বেড়ে যাচ্ছে। যে কোনো ইস্যুতে হিন্দু বনাম মুসলমানের একটি বিভেদ ও পারস্পরিক অবিশ্বাসের পরিবেশ নির্মাণ করা হচ্ছে। এর কারণটি আপাতভাবে গোষ্ঠীস্বার্থ হলেও এর মূলে আরো একটি বড় কারণ বিদ্যমান। এটি হলো রাজনৈতিক কারণ। অবিভক্ত বাঙালি হয়ে উঠতে পারে বিপজ্জনক ও শক্তিশালী। এ ভয়টি আজকের নয়। সবসময়ই বাঙালির মেধা ও ঐক্যকে ভয় পেয়েছে অন্যরা। সেই ১৯০৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের হোম সেক্রেটারি টু ইন্ডিয়া স্যার হার্বাট হোপ রিশলে ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রথম বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব করতে গিয়ে বলেছিলেন- ‘ঐক্যবদ্ধ বাংলা হলো শক্তি। বিভাজিত হলে বাংলাকে বিভিন্ন দিকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়া যাবে। সেই কারণেই আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত- বাংলাকে ভেঙে দেয়া। তাহলেই আমাদের শাসনের পক্ষে বিপজ্জনক সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে দেয়া যাবে।’ এই মনোভাব আজো অনেকের মধ্যেই বিদ্যমান। বাংলা ও বাঙালিকে ভেঙে দেয়ার প্রচেষ্টা আজো চলছে। আর আমরা না বুঝেই বিভাজনের ফাঁদে পা দিচ্ছি আমাদের ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের আড়ালে।

সুধীর সাহা : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়