২০১৩ সালের নাশকতা : ২ মামলায় বিএনপির ২০ নেতাকর্মীর দণ্ড

আগের সংবাদ

কত আসন ছাড়বে আ.লীগ : সর্বোচ্চ ৮০টি আসনে ছাড় > ৩০ আসন পাবে ১৪ দল > চূড়ান্ত সমঝোতা শেষমুহূর্তে

পরের সংবাদ

আহমদুল কবির : সাংবাদিকতার সাহসী ব্যক্তিত্ব

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সংবাদপত্র জগতে, সেই পঞ্চাশের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে বৈরী পরিবেশে, সাংবাদিকতায় যারা সাহসের পরিচয় দিয়ে বাঙালির আত্মপরিচয় জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন, সফলও হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে আহমদুল কবির ছিলেন মধ্যমণি। তিনি তখন বাংলাদেশের আদর্শবাদী দৈনিক সংবাদপত্র ‘সংবাদ’-এর কর্ণধার ছিলেন। নিজের অর্থে দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশ করে কার্যকরভাবে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো খুবই সাহসের ব্যাপার ছিল। সেটি আহমদুল কবির করে দেখিয়েছেন, সব ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে, আরো কয়েকজন সাহসী সাংবাদিককে নিয়ে। তাদের মধ্যে ছিলেন জহুর হোসেন চৌধুরী, খায়রুল কবির, সৈয়দ নূরুদ্দিন প্রমুখ। পরে আরো কয়েকজন সে দলে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু মূল লোক ছিলেন আহমদুল কবির। তিনি গাঁটের পয়সা খরচ করে সাংবাদিকতায় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এর ফলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাংবাদিকতার আপসহীন ব্যক্তিত্ব। এবং এই সাহসী চেতনা তিনি বাংলাদেশ আমলেও প্রজ্বলিত রেখেছিলেন।
এই বাংলাদেশ ভূখণ্ডে, সেই পাকিস্তানি আমলে পঞ্চাশের দশক থেকে সংবাদপত্র জগতে তিনি ছিলেন একাধারে প্রকাশক-সম্পাদক, ২০০৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তিনি তার মেধা ও অর্থ- দুটোই সংবাদপত্রে বিনিয়োগ করেছিলেন। আর এসব করেছিলেন তখন, যখন প্রায় ধ্রæব সত্যের মতো জানা ছিল যে, সংবাদপত্র প্রকাশ করে অর্থ উপার্জন করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। এ সত্য জেনেই করেছিলেন। কাজেই তাকেই তো অকুতোভয় মানুষ বলা যায়। প্রকৃত অর্থে তিনি তা-ই ছিলেন।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি আহমদুল কবির রাজনীতিও করেছেন। দুক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন পরিপূরক ও পারঙ্গম ব্যক্তিত্ব। দুই মাধ্যমেই তার অবস্থান ছিল নিবেদিতপ্রাণ, বস্তুনিষ্ঠ ও আদর্শবাদী। তার সাংবাদিকতার আদর্শ ছিল সব শ্রেণি-পেশার সাধারণ মানুষের জন্য সত্য-বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশন এবং রাজনৈতিক আদর্শ ছিল দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের নিরলস কাজ করে যাওয়া। তিনি বিশ্বাস করতেন আমাদের সাংবাদিকতা এবং রাজনীতি হতে হবে জনবান্ধব এবং জনকল্যাণমুখী। এটা তিনি শুধু বিশ্বাসই করতেন না, তা পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের প্রচেষ্টাও চালিয়েছেন এবং সফল হয়েছেন। তার এসব কর্মকাণ্ডের ফসল হচ্ছে দৈনিক সংবাদ এবং সাম্যবাদী আদর্শের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া। দুই মাধ্যমেই তিনি সপ্রাণ সক্রিয় ছিলেন আজীবন, সেই ছাত্রত্বের সময় থেকে জীবনের পড়ন্ত বেলায়ও। আহমদুল কবির সাংবাদিকতায় অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং বস্তুনিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণের ক্ষেত্রে ছিলেন আপসহীন। একইভাবে তিনি রাজনীতিতে ছিলেন উদার গণতান্ত্রিক এবং সাম্যবাদী ধারায় দেশ ও মানুষের উন্নয়ন চিন্তার অগ্রণী মানুষ। এ ক্ষেত্রেও তিনি বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। আহমদুল কবিরের জীবনকর্ম, সাংবাদিকতা, রাজনীতি- এসব নিয়ে আলোচনা-বিশ্লেষণ-পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় তিনি সংবাদপত্র পাঠক এবং রাজনীতি সচেতন মানুষকে শুধু দিয়েই গেছেন। কী পেয়েছেন সেদিকে দৃষ্টি দেননি কখনো। কারণ সাংবাদিকতা এবং রাজনীতি করে তিনি কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা বা আগ্রহ নিজের মধ্যে স্থান দেননি। এর একটি কারণ হয়তো উল্লেখ করা যায়, তা হলো, তিনি প্রকৃত অর্থে ছিলেন বনেদি জমিদার পরিবারের সন্তান। আভিজাত্য ছিল তার সহজাত। কিন্তু এই আভিজাত্যকে তিনি ছুড়ে ফেলে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন দেশপ্রেম ও জাতি গঠনমূলক সাংবাদিকতা এবং সাম্যবাদী আদর্শের রাজনীতিতে। এটা তার সময়ের বিবেচনায় ছিল খুবই সাহসী পদক্ষেপ। মানুষের স্বভাবজাত হচ্ছে পারিবারিক সম্পদ ও আভিজাত্য বাড়িয়ে সমকালীন দেশ ও সমাজের কেউকেটা হয়ে ওঠার মানসিকতা। কিন্তু আহমদুল কবির হয়েছিলেন তার বিপরীত ধারা ও চরিত্রের মানুষ। তাকে দেখে, তার সঙ্গে কথা বলে কেউ কখনো বুঝতেই পারতেন না তিনি পারিবারিকভাবে ছিলেন জমিদার বংশের সদস্য। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তিনি আজীবন রক্ষা করে চলেছেন। এ জন্য তিনি সব ক্ষেত্রেই মানুষের সাধুবাদ পেয়েছেন, মৃত্যুর পরও মানুষ তাকে মনে রেখেছে তার এসব চারিত্রিক গুণাবলির জন্য। সাংবাদিকতায় তার অবদান নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। তবে যেটুকু না বললেই নয়, তা হলো তিনি সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতায়, সেই পঞ্চাশের দশকে, নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন, ভিন্ন রূপ দিয়েছিলেন দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশের আদর্শে। এসব তিনি করেছিলেন তার মালিকানায় প্রকাশিত দৈনিক সংবাদে। সেই সময়ে, পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক বছরের মধ্যে দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো পাকিস্তানের স্বাধীনতা পূর্বকালের মতোই কলকাতার স্থানীয় সংবাদপত্রের ভাবধারা অনুসরণ করে অর্থাৎ কলকাতায় যেভাবে সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো, তেমন রূপ নিয়েই পূর্ব পাকিস্তানে সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো। আহমদুল কবির সে ধারা থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ নতুন মাত্রায় দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন। সংবাদপত্রকে সাধারণ মানুষের পাঠের আওতায় আনতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তখনকার দিনে সংবাদপত্র প্রকৃত অর্থে ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের পাঠ্য। অর্ধশিক্ষিত নিম্নবিত্তের মানুষ সংবাদপত্র পাঠের গণ্ডিতে ছিলেন খুবই কম।
আহমদুল কবির সম্পর্কে কিছু বলতে হলে আগে দৈনিক সংবাদ সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার। আমরা পেছন ফিরে দেখতে পাই যে, দৈনিক সংবাদ ১৯৫১ সালের ১৭ মে ব্যবসায়ী আলহাজ গিয়াসউদ্দিন আহমদের মালিকানায় এবং খায়রুল কবিরের সম্পাদনায় পুরান ঢাকার ২৬৩ বংশাল থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এক বছর পথ চলার পর ১৯৫২ সালে তখনকার ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ পত্রিকাটি কিনে নেয়। এরপর দৈনিক সংবাদ হয়ে পড়ে মুসলিম লীগের দলীয় মুখপত্র। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ প্রার্থীরা পরাজিত হন। ফলে মুসলিম লীগকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। এরপর দৈনিক সংবাদের প্রকাশনা অব্যাহত রাখা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
আহমদুল কবির ১৯৫৪ সালে দৈনিক সংবাদ প্রকাশনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি তখনকার মালিকদের কাছ থেকে দৈনিক সংবাদের মালিকানা কিনে নিয়েছিলেন। তখন তিনি ছিলেন একজন তরুণ ব্যবসায়ী ও সাম্যবাদী আদর্শের রাজনীতিক। তার আগে তিনি ছাত্ররাজনীতি করে হাত পাকিয়েছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের নেতৃত্বও দিয়েছেন, ছাত্র সংসদে নির্বাচন করে জয়লাভ করেছিলেন। এ জন্য তার রক্তে নেতৃত্ব দেয়া এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের আবহ ছিল। এসব তিনি তার জীবনে যা কিছু করেছেন তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। দৈনিক সংবাদের মালিকানা নিয়েই সংবাদের নীতি আদর্শ পাল্টে দিয়ে সংবাদকে নতুন রূপ দেন। শুরুতে সংবাদ ছিল সাম্প্রদায়িক আদর্শের সংবাদপত্র। পরে দৈনিক সংবাদ হয়ে ওঠে গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং অসাম্প্রদায়িক আদর্শের একটি সংবাদপত্র। এরপরই সংবাদ দৈনিক পত্রিকা হিসেবে পাঠকের মন জয় করে নিতে সক্ষম হয়। আর এটা হয়েছিল আহমদুল কবিরের বস্তুনিষ্ঠ এবং সৃজনশীল আদর্শের কারণে। আহমদুল কবিরের হাতে আসার পর, দৈনিক সংবাদ প্রকাশের প্রাথমিক দিনগুলোতেই পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক শাসন শোষণ ও বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এবং আপসহীন অবস্থান গ্রহণ করেছিল, যে ধারা আহমদুল কবির জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধরে রেখেছিলেন।
আহমদুল কবির তার চেতনা অনুযায়ী সংবাদপত্র পাঠককেই সবচেয়ে প্রথম এবং সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতেন। তিনি মনে করতেন সংবাদপত্র শুধু পাঠককে খবর পাঠের গণ্ডিতে রাখলেই চলবে না, তার পাঠক রুচি ও আধুনিক মনমানসিকতা গঠনেও অবদান রাখার সুযোগ আছে। সমাজের উপকারী উপাদান প্রকাশের মাধ্যমে সংবাদপত্র মানুষের মধ্যে মেধার স্ফুরণ ঘটাতেও অবদান রাখতে পারে। এমন মানসিকতা থেকেই তিনি দৈনিক সংবাদে ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ খবর প্রকাশের পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ের মৌসুমি তথ্যও প্রকাশের নতুন ধারা প্রবর্তন করেছিলেন। শিশুদের জন্য, কৃষকের জন্য, নারীদের জন্য, শ্রমিকদের জন্য, কবি সাহিত্যিকদের জন্য আলাদা বিভাগ তিনি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। এটা সেই সময়ের সংবাদপত্রে খুব একটা দেখা যেত না। তখন পত্রিকা ছিল শুধু খবরের সমাহার। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের কালো হাত সংবাদকেও স্পর্শ করে। ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর পুড়িয়ে দেয়া হয় বংশালে দৈনিক সংবাদ কার্যালয়। তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় জেলে। সংবাদ কার্যালয় ধ্বংস করে দিলেও বাংলাদেশের অবস্থা স্বাভাবিক- এমনটা বোঝানোর জন্য দৈনিক সংবাদ পুনঃপ্রকাশের জন্য পাকিস্তানিরা প্রবল চাপ দিতে থাকে। কিন্তু আহমদুল কবির পাকিস্তানের কোনো চাপের কাছেই নতি স্বীকার করেননি। জীবন যেতে পারে কিন্তু সংবাদ প্রকাশ করব না- এমন সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তিনি। ফলে নানা প্রলোভন ও হুমকির মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘সংবাদ’ আর প্রকাশিত হয়নি।
আহমদুল কবির ছিলেন অত্যন্ত সৃষ্টিশীল মানুষ। বাংলাদেশে সাংবাদিক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টা ছিল তুলনাহীন সৃজনশীল এবং পারঙ্গম। এ ক্ষেত্রে তিনি সংবাদকে গড়ে তোলেন, শুধু একটি পত্রিকা নয়, একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে সাংবাদিকতা এবং ব্যবস্থাপনার আধুনিক ধারা তিনিই প্রথম প্রবর্তন করেন। পরবর্তীতে অন্য সংবাদপত্র তা অনুসরণ করে, আরো অনেক কিছু যোগ করে সংবাদপত্র প্রকাশের ধারণাকে আরো সমৃদ্ধ করেছেন। তবে বাংলাদেশে আজ সংবাদপত্র যে চেহারায় আবির্ভূত, বলা যায় তার প্রথম প্রচলন, দৈনিক সংবাদের মাধ্যমে এবং আহমদুল কবিরের হাত ধরেই সংবাদ আধুনিক ধারা এগিয়ে গিয়েছিল। যার ফল বাংলাদেশে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতা পেশার বিস্তার এবং কাক্সিক্ষত মান অর্জন। পঞ্চাশের দশকে শুরু হলেও তা কালে কালে রাজনীতি ও ইতিহাসের বাঁক পেরিয়ে আরো বেশি সমৃদ্ধ ও পরিণত অবস্থান পেয়েছে।

সালাম জুবায়ের : কলাম লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়