ডিবিতে অভিনেত্রী তিশার অভিযোগ : লুবাবার অভিযোগকারী আটক

আগের সংবাদ

সমঝোতা হলে পুনঃতফসিল : সুযোগ আছে সংবিধানে > আপত্তি নেই আওয়ামী লীগের > সিদ্ধান্ত নিতে হবে ১০ দিনের মধ্যেই

পরের সংবাদ

ঠকা-ঠেকার চিকন সুতায় বিএনপি

প্রকাশিত: নভেম্বর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

নয়াপল্টন আর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, এক-দেড় কিলোর এ দূরত্বের চিত্র হাজার কিলোর চেয়েও বেশি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫০ হাজার টাকা দরের ফরম তোলার উৎসব ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ কার্যালয়ে। উৎসব-উচ্ছ¡াসের লেজ-মাথা আশপাশের এলাকায়ও। এক অন্যরকম পরিস্থিতি ওইসব এলাকায়। চিত্রের করুণ ভিন্নতা নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়সহ আশপাশে। দলটির অফিস তালাবদ্ধ। আশপাশও খাঁ-খাঁ।
মাত্র কিছুদিন আগেও নয়াপল্টন ছিল দলটির নেতাকর্মীতে মুখর। আবাসিক প্রতিনিধির মতো সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কার্যালয়ে অবস্থান করে সাংগঠনিক বিভিন্ন কাজ করতেন। দলের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনও করতেন তিনি। সারাদেশ থেকে নেতাকর্মীরাও আসতেন। সেখানে এখন তালাবদ্ধ, নির্জন। গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয় খোলা থাকলেও সেখানে নেতাকর্মীরা যান না।
আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত নামের দল বাংলাদেশে থাকবে না, তখন দেশ সত্যিকারে শান্তিপূর্ণ হবে- এমন একটি উচ্চাশা রয়েছে ক্ষমতাসীন দলে। আশাবাদটি ব্যক্তের পরদিনই জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের আদেশ বহালের ঘোষণা এসেছে। এতে কারো কারো ধারণা, উপরোক্ত দুদলের একটি জামায়াতকে ‘নাই’-এর খাতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মোটকথা জামায়াত ঠেকে গেছে। রাজনীতিতে ফিটনেস সনদ ছাড়া জামায়াতের রুট পারমিট থাকবে কিনা- সামনে এখন সেই প্রশ্ন। অন্যদিকে সনদ-রুট পারমিট দুটি থাকার পর বিএনপি ঠেকে আছে আরো আগ থেকেই। তারা ঠেকার মধ্যেই থাকবে, না সামনে ঠেকানোর কোনো নতুন আয়োজনে নামবে- এ জিজ্ঞাসার জবাব নেই। দলের প্রধান থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ের নেতারাও অদেখা, মাঠছাড়া। যদিও সমঝোতা হলে ভোট পেছানোর ইঙ্গিত আছে নির্বাচন কমিশনের। হলেও তাতে চিত্র কতটা বদলাবে?
বিএনপি এ সরকারের অধীনে নির্বাচন করে দেখেছে। নির্বাচন না করেও দেখেছে। কোনোটাতেই সাফল্য পায়নি। তাহলে আর ‘কী’ করার আছে? বাস্তবতা বলছে, তাদের ওই ‘কী’ করার অবস্থাও নেই। নির্বাচন করা, না করার মাঝ বরাবর কাজ হচ্ছে নির্বাচন ঠেকিয়ে দেয়া। সেই সামর্থ্যও দৃশ্যত বিএনপির নেই। তাহলে ঠেকে যাওয়া থেকে উতরে উঠে প্রতিপক্ষকে ঠেকানোর সাধ্য হবে কীভাবে? নির্বাচনের উছিলায় অন্তত মাঠে ওঠার সুযোগও এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।
নির্বাচনের পরিবেশ নেই- কয়েকটি রাজনৈতিক দলের এমন অভিযোগ পাত্তা দিচ্ছে না ইসি। এক কমিশনার বলেই দিয়েছেন, ‘চিরকাল সরকারি দল এবং বিরোধী দল পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। এটা ১৯৭০ সাল থেকে দেখে আসছি।’ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কথা আরো কড়া-চড়া। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এক শতাংশ ভোট পড়লেও সেই নির্বাচন আইনত বৈধ। ভোটের লেজিটিমিসি বিষয় নয়। কথা একদম পরিষ্কার। গোটা পরিবেশ সরকারের অনুকূলে। নানান নামের জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ইত্যাদি দল সরকারের আনুকূল্যের আশায় দৌড়ছুটে ব্যস্ত। বিশেষ করে আলোচিত জাতীয় পার্টির স্যাংশনের ভয় কেটে গেছে। এ সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচনে গেলে মার্কিন স্যাংশন আসতে পারে বলে ভয়ের কথা জানিয়ে নির্বাচন যাওয়া-না যাওয়া নিয়ে কিছু কথা বলেছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তার ভাবি রওশন এরশাদ দেরি না করে জানিয়ে দিয়েছেন, তার অধীনেই নির্বাচনে যাবে জাতীয় পার্টি। অল্প সময়ের মধ্যে তাদের কার আগে কে যাবেন, সেই প্রতিযোগিতা নির্বাচনকে একটু জমিয়ে দেয়। বাংলাদেশের কয়েকটি নির্বাচনেই দেখা গেছে, জাতীয় পার্টি ছাড়া ভোটরঙ্গ বা সার্কাস জমে না। এবারো সেই পালে তা দিয়েছে জাতীয় পার্টি। কিন্তু রাজপথের শক্তিশালী বিরোধী দল বিএনপির এখন পর্যন্ত হাল বা পাল কোনোটাই নেই।
নির্বাচন মানেই ভোট নয়। ভোট নির্বাচনের একটা অংশ মাত্র। এর আগে প্রাক-নির্বাচন, নির্বাচনী তফসিল, মনোনয়ন, প্রচার, ভোট, ভোট গণনা শেষে ফলাফল। বিএনপি এ সাইকেলেই নেই। নির্বাচন কমিশন বিএনপিকে আমন্ত্রণ করেছে, চিঠি দিয়েছে, উন্মুক্ত আমন্ত্রণও ছিল। কিন্তু তারা তাতে সাড়া দেয়নি। এবারের তফসিলটা একটু বেশি ‘টাইট’। সময় কম। সন্দেহের প্রাচীর ও বিরোধ এত উঁচু, যা ডিঙিয়ে একটা বোঝাপড়ার জোও দেখা যাচ্ছে না। সরকার এ ব্যাপারে একদম নারাজ। যুক্তরাষ্ট্রকেই ‘টাইম শেষ’ জানিয়ে দিতেও সময় নেয়নি। এর পরিণাম কী হতে পারে, পরবর্তীতে কে ফাঁসবে, কে ফাঁসাবে- এসব প্রশ্নের বাঁকে সত্য হচ্ছে, বিএনপি ঠেকে গেছে। প্রতিপক্ষকে ঠেকাতে হলে তাকে আগে উতরাতে হবে। মাঠে আসতে হবে। মাঠে তারা নেই। নিজেরা ফিল আউট হয়েছে। সরকারও করেছে। পার্টি অফিস থেকেও নেই। ঘরে থাকার অবস্থাও নেই। মাত্র ক’দিন আগে সরকার পালাবার পথ পাবে না হুঙ্কার দেয়া নেতাদের এ অবস্থা করে সরকারও তার হিম্মত দেখিয়েছে। এর যোগফলে হয়তো ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো বা এর চেয়েও প্রশ্নবিদ্ধ আরেকটি নির্বাচনের বোঝা সরকারকে নিতে হবে। নির্বাচন কমিশনও কলঙ্কিত হবে। এতেও কি বিএনপির জন্য কোনো সুবিধা হবে? বিএনপিকে সুবিধা পাইয়ে দেয়ার দায়িত্ব সরকারও নেবে না। বরং সরকারের তা-ই কাম্য। নির্বাচন কমিশনও এর বাইরে যাবে না, সেই মহৎ কাজের ফেরিওয়ালা নয় তারা। এটাই বাস্তবতা।
এরপরও কেউ সেটা না বুঝলে, তর্কের ঝুড়ি খুললে যার যার বিষয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল এমন সময়ে তফসিল ঘোষণা করলেন, যখন বিরোধী দল সরকারের পদত্যাগের দাবিতে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ উল্লাস করে তফসিলকে স্বাগত জানালেও বিরোধী দল প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়েছে, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তারা মাঠ দখলে রাখবে। মেসেজ তো পরিষ্কার। তফসিল ঘোষণার আগে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর চিঠি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বেশ আলোচনা হয়েছিল এবং সংলাপের বিষয়ে ক্ষীণ আশাবাদ জেগেছিল। জাতীয় পার্টি প্রকাশ্যে এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। বিএনপিও ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছিল বিষয়টি। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের চিঠি পাওয়ার পর বললেন, তফসিল ঘোষণার পর আর সংলাপের সুযোগ নেই। এর ভেতরেও কোনো খেলা আছে কিনা? ঘুরছে প্রশ্নটি। একেবারেই শেষ পর্যায়ে কেন চিঠিটি দিলেন ডোনাল্ড লু? এ প্রশ্ন অগ্রাহ্য করা যায় না। চাইলে চিঠিটি কি মাস খানেক বা অন্তত ১৫ দিন আগেও দিতে পারতেন না? তা না করে সরকারকে কি বিকল্প চিন্তার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হলো না? যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কি সম্পর্ককে সাংঘর্ষিক করে ফেলা হলো না? এর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে চারটি তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের অধীনে। তিনটি সেনাশাসনের মধ্যে। চারটি হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে। ওই সময় কিন্তু সংসদ বহাল ছিল না। সংসদ ভেঙে যাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে আরেক সংসদ নির্বাচনের বিধান ছিল ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার আগপর্যন্ত। ওই সংশোধনীতে বলা হলো সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এখানে মাঠ সমতল না থাকার গুরুতর প্রশ্নটি এসে যায়।
২০১৮-এর নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দল অংশ নিলেও জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়নি। অনেক জরিপ ও গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, ২০০৮ সালের পর যারা ভোটার হয়েছেন, সেই তরুণ প্রজন্মের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ভোট দিতে পারেননি। এই নির্বাচনের কোনো কোনো কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। আবার বিরোধী দলের অনেক প্রার্থী অনেক কেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছেন। এই কদাকার চর্চার মধ্যেই ঘুরবে বাংলাদেশ? তা ’৭৩-এর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচন থেকেই। কারচুপি না করলেও ব্যালট বাক্স ঢাকায় এনে খন্দকার মোশতাক আহমেদকে না জেতালেও, সত্তরে প্রাদেশিক পরিষদে জয়ী তরুণ ন্যাপ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ অনেককে না হারালেও তখন আওয়ামী লীগই বিপুল আসনে সরকার গঠন করত। ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর আরেক নির্বাচনী কানামাছি খেলা। সেনাশাসকদের ইচ্ছাপূরণের ভোট তামাশা। এসব নির্বাচনে সদ্য গঠিত দলকে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী করা হয়েছে সামরিক শাসনকে বৈধতা দিতে। একটা আশা জেগেছিল নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গণতান্ত্রিক শক্তির বিজয়ের পর একানব্বই সালে। ধারণা জন্মেছিল বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন উঠবে না। তিন জোটের রূপরেখার আকাক্সক্ষা ফলবে। কিন্তু ক্ষমতায় এসে বিএনপি-আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হতে অনিয়ম-কারচুপিতেই ভরসা গাড়ল। আর বিরোধী দল দাবি আদায়ের মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে হরতাল-অবরোধকে বেছে নেয়। দুপক্ষের এই বিরামহীন যুদ্ধে আজকের এই পরিস্থিতি। রাজনীতির বাইরের বা দেশের বাইরের কারো কাছে এর ফয়সালা থাকা উচিতও নয়। এরপরও সেখানে ফয়সালা তালাশের মোহ। ঠকানো, ঠেকানোর অভিযাত্রায় কেউ উপরে উপরে। কেউ তলে তলে।
তলের খবর কত অতলে এবং বিপজ্জনক হতে পারে, সেই বেদনার ইতিহাস সইছে বাংলাদেশ। তলে-উপরে এখনো ঘটনার ঘনঘটা। রাজমেহমান লেগেই আছে বাংলাদেশে। এক গ্রুপ যেতে না যেতেই আরেক গ্রুপ। তারা সবার কাছে বা সবার জন্য আসেন না। আসেন সিলেকটিভ কাজে, সিলেকটিভদের জন্য। দেশের সব মানুষ আওয়ামী লীগ বা বিএনপি করে না। বিএনপি রাজপথে পারেনি। শরীরে-অশরীরে মার খেয়ে চলছে সরকার পক্ষের কাছে। আর সরকার তার কর্মী-সমর্থকদের বাইরে সবাইকে প্রতিপক্ষ বিএনপির কর্মী বানিয়ে তাদের দেখে নিতে চাইছে। দলের কর্মী-সমর্থকদেরও সেভাবে অভ্যস্ত করে তুলেছে সরকার এবং আওয়ামী লীগ। তাই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কী ভাবে, চীন কী চায়, ভারত কী করবে- কাঙালের মতো এসব তালাশ করতে হচ্ছে বাঙালদের।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়