তফসিল বাতিলের দাবি স্বতন্ত্র প্রার্থী ঐক্য পরিষদের

আগের সংবাদ

জামায়াতের ভবিষ্যৎ কী? নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল খারিজ

পরের সংবাদ

নির্বাচনের তফসিল : অভিনন্দন, প্রত্যাখ্যান বাস্তবায়ন এবং অতঃপর…

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গত ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা তফসিল ঘোষণাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। অপরদিকে দেশের প্রথম সামরিক শাসক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ঘোষিত তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। শাসনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষের এই তরজার মধ্যে নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতা-নেত্রীরা এবং তাদের সমর্থকদের তৎপরতা লক্ষণীয়ভাবে উষ্ণতা ছড়াতে শুরু করেছে। গ্রাম ও মফস্বল শহরের চায়ের দোকানগুলো ‘কে কে প্রার্থী হচ্ছেন, দল থেকে কাকে মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে’ এসব প্রশ্ন সমন্বিত আলাপচারিতায় যথারীতি সরগরম হয়ে উঠছে! এ ক্ষেত্রে শুধু আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রী এবং সমর্থকরাই নন, জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপিসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া কয়েকটি দলের নেতা-নেত্রী, কর্মী ও সমর্থকরাও আছেন। বাহ্যত অসাংবিধানিক ও অনির্বাচিত এবং বিতর্কিত এক ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবির কথা বললেও বিএনপির সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং তার স্ত্রী প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার অধীনে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে আইন অনুযায়ী নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা না করতে পারার জন্যই দলটি তফসিল প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়েছে বলে পর্যবেক্ষক মহল বিশ্বাস করে। যদিও বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বর্জন করবে কি না, তা এখনো ঘোষণা করেনি! পর্যবেক্ষক মহল এখানেই রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে! তবে কি বিএনপি শেষ মুহূর্তে এসে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া শুরু করতে পারে? প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনাও সম্প্রতি কথা প্রসঙ্গে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। তা না হলে অতঃপর কী?
এই প্রশ্নের উত্তরে প্রসঙ্গক্রমে ১৯৭০-এর নির্বাচন বর্জনকারী সে সময়ের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপের রাজনৈতিক ভাগ্যের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, এ কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে নির্বাচন বর্জনের কারণে মওলানা ভাসানীর দলের রাজনৈতিক পরিণতি উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর এবং বিশেষত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মওলানা ভাসানী অনেক প্রশ্নবোধক কর্মকাণ্ডের জন্ম দিয়েছেন। এসব কারণে তার সম্পর্কে রাজনৈতিক সমালোচনা সত্ত্বেও তার প্রতি সব মহলের শ্রদ্ধার বিষয়টি স্মরণ করে বলা যায় ১৯৭০-এর নির্বাচন বর্জনের ফলে ক্রমান্বয়ে তার দল অপ্রাসঙ্গিক হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তার দলের পরিণতি মুসলিম লীগের মতো হয়েছে।
বিশ্লেষকদের অনুসন্ধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তা হলো ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিএনপি-জামায়াত কর্তৃক মানুষ খুন করে, পেট্রোল বোমার অগ্নিসন্ত্রাস করে প্রতিহত করার ব্যর্থ চেষ্টা করাটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল এমনটাই বিএনপির অনেক নেতাকর্মী মনে করছেন। ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের দুই বছরের মাথায় ২০১৬ সালে এসে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে মনে করছেন, বিএনপির ওই নির্বাচন বর্জন করা ঠিক হয়নি। নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি এখন যে দুর্দশায় পড়েছে, পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না। ২০১৬-এর পৌরসভা নির্বাচন সে উপলব্ধিকে আরো শক্ত ভিত্তি দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতারা ব্যক্তিগত আলাপে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এমন উপলব্ধির কথা বলেছেন। কিন্তু প্রকাশ্যে তারা মন্তব্য করতে রাজি নন। কারণ দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনে অংশ না নেয়ার বিষয়ে অনড় ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এই অবস্থায় নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে কথা বলার ঝুঁকি নেননি কেউ। কারণ তাতে ‘সরকারের দালাল’ আখ্যা পাওয়ারও আশঙ্কা ছিল।
বিএনপির নেতারা সে সময় বলতেন, ২০১৬-এর পৌরসভা নির্বাচনে প্রত্যাশিত ফল তারা (বিএনপি) পায়নি। কিন্তু এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই বছর পর দলের নেতাকর্মীরা আত্মগোপন অবস্থা থেকে মাঠে ফেরার সুযোগ পেয়েছিলেন। তারা প্রায় এক মাস ধরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পেরেছিলেন। এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে দীর্ঘদিনের লুকিয়ে থাকার মনোভাব কাটিয়ে তখন আস্থার ভাব তৈরি হয়েছিল। এ পরিস্থিতিকে গত দুই বছরের মধ্যে বড় রাজনৈতিক সাফল্য বলে মনে করতেন দলীয় নেতাদের কেউ কেউ। দলটির গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা একজন নেতা তখন সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও তারা মনে করছেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে না যাওয়া বিএনপির ভুল ছিল। তার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন হলো, বিএনপি যদি নির্বাচনে যেত, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি ভিন্ন হতো।
মওলানা ভাসানী কর্তৃক ১৯৭০-এর নির্বাচন বর্জনের কারণ হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের ফলে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি তথা মানবিক বিপর্যয় উল্লেখ করা হয়েছিল। তারপরও মওলানার দল প্রায় বিলুপ্তির খপ্পর থেকে রক্ষা পায়নি। কিন্তু ২০১৪-তে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল জামায়াত সঙ্গ, বিএনপির লন্ডনস্থ নেতার ‘রাজনীতি না করার মুচলেকা’, জঙ্গি সংযুক্ততা, এবং দুর্নীতির মামলার পাশাপাশি খালেদা জিয়ার দাম্ভিকতার কারণে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিএনপি নেতার মতে, ২০১৪-এর নির্বাচনে হারিয়ে দেয়া হলেও কিছু আসন বিএনপির থাকত। অন্তত প্রধান বিরোধী দল থাকত বিএনপি। এতে রাজপথের পাশাপাশি সংসদসহ বিভিন্ন জায়গায় কথা বলার সুযোগ থাকত। কূটনীতিকদের প্রশ্নের মুখেও পড়তে হতো না। তবে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান সে সময় (২০১৬) সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আমরা গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের জন্য সংগ্রাম করছি। আমার মনে হয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই সংগ্রামটা নির্বাচনে অংশ নিয়েও হতে পারত।’
বিএনপির চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টার মূল্যায়ন হচ্ছে, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিএনপির বদনাম আছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে দেশে-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ করা গেছে, এটাই এখন বিএনপির বড় পাওয়া। যদিও তারা অনেকে ধরে নিয়েছিলেন, চাপে রাখা গেলে ১৯৯৬-তে বিএনপির মতো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি করবে আওয়ামী লীগ সরকারও। সে জন্য দলটি জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতা মেনে নিয়েছিল।
যদিও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন এবং ক্ষমতার পট-পরিবর্তনের আশায় মাঠে শক্তি প্রয়োগের কৌশলে ঠিক কী ভুল ছিল, তা নিয়ে বিএনপিতে যেমন অস্পষ্টতা আছে, তেমনি ২০-দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যেও এ নিয়ে মতভিন্নতা আছে। তবে জোটের প্রধান অসন্তুষ্ট হতে পারেন- এই আশঙ্কায় গণমাধ্যমে উদ্ধৃত হতে রাজি হন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জোটের একটি শরিক দলের চেয়ারম্যান সে সময় (২০১৬) সংবাদ মাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘তার মতে ওই সময় বিএনপি পরপর তিনটি ভুল করেছে। এক. ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে খালেদা জিয়ার দেখা না করা। দুই. প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সাড়া না দেয়া। তিন. তারানকোর মধ্যস্থতায় আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পর নির্বাচনে না যাওয়া।’ রাজনীতিতে ভুলের পরিণতি থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো পথ খোলা থাকে না। ভুলের পরিণতিতে অপ্রাসঙ্গিক হতে হতে একসময় অনিবার্য বিলুপ্তি দলটিকে গ্রাস করবে! পাশাপাশি এটিও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করা দরকার যে বিএনপি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সরকারবিরোধী দলের অভাব নেই। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি এবং আরো অনেকের অংশগ্রহণ তাই প্রমাণ করে। পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিম বঙ্গে কংগ্রেসের দুর্বলতার কারণে ‘তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান’-এর মতো বাংলাদেশেও বিএনপির রাজনৈতিক ভুলের ফলে তাদের স্থলে ‘তৃণমূল বিএনপি’ শক্তিশালী হওয়ার সঠিক পথে হাঁটছে। এমন পরিস্থিতিতে জনগণ এখন নির্বাচনমুখী। তারা গত ১৫ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জয়যাত্রার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার লক্ষ্যে ভোট দেয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে। এই বিশ্লেষণের শেষে উপসংহারের প্রশ্ন হচ্ছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তফসিল প্রত্যাখ্যানকারী রাজনৈতিক দলের পরিণতিও কী ন্যাপ বা মুসলিম লীগের মতো হতে যাচ্ছে? সময়ই এর উত্তর দেবে। ততদিন আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। সে অবধি নির্বাচন কমিশন দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে আর নির্বাচনকালীন নির্বাচিত বর্তমান সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে সজাগ ও কার্যকর সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, এটাই আমজনতা বিশেষত ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণের একান্ত চাওয়া।

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়