সংসদ নির্বাচনের কোনো প্রস্তুতি নেই বিএনপির : রেলপথমন্ত্রী

আগের সংবাদ

জোট নাকি মহাজোট? একক ও জোটগত ভোটের প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের > জাতীয় পার্টির সিদ্ধান্ত স্পষ্ট নয়

পরের সংবাদ

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থ সচিব

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে অস্থায়ী সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং অর্থ সচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান। ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ শপথ নেয়া স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। থ্রি নট থ্রি-তে কথিত ‘দুর্নীতির দায়ে’ চাকরিহারা মতিউল ইসলাম কালবিলম্ব না করে ব্যক্তিমালিকানা খাতে বড় চাকরিতে ঢুকে পড়েন। সদ্য দায়িত্ব নেয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তাকে ১২ জানুয়ারি ডেকে পাঠান এবং তাকে অর্থ সচিব নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে তার আগে কখনো সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। এটাও স্পষ্ট হয়ে উঠে- তাকে যে অর্থ সচিব নিয়োগ করবেন এ নিয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কোনো আলোচনা হয়নি। মন্ত্রী যদি সহযোগিতা না করেন, পুরোপুরি বিশ্বাস না রাখেন, তাহলে কোনো সচিবেরই সাফল্য লাভের সুযোগ নেই।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কোনো অর্থ নেই। রাজকোষ শূন্য, বৈদেশিক রিজার্ভ শূন্য (ভারত সরকার বোম্বের রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়াতে বাংলাদেশ সরকারের নামে ৫ মিলিয়ন ডলার জমা রেখেছে, এটা বিবেচনায় না নিলে রিজার্ভ শূন্য) পূর্ব পাকিস্তান থেকে রপ্তানি করা পণ্যের আয় পাকিস্তান আগেই তুলে নিয়েছে। ভোগ্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি অবিলম্বে শুরু করা না গেলে তীব্র অভাব দেখা দেবে, শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। মতিউল ইসলাম লিখেছেন, এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে সরকার পরিচালনার ব্যয়, নতুন বিভাগ ও মন্ত্রণালয় খোলা হচ্ছে, বিদেশে মিশন খোলা হচ্ছে। এসব সংকট মোকাবিলা করতে হবে- কিন্তু সবার আগে দরকার অর্থমন্ত্রী ও অর্থ সচিবের সাক্ষাৎ।
দায়িত্ব গ্রহণের আগে ১৭ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রীর হেয়ার রোডের বাসায় সাক্ষাৎ করতে গেলেন। তিনি সিঁড়ি দিয়ে নামতেই সচিব নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন কতগুলো জরুরি আর্থিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তার দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। আলোচনা শুরু করতে যাবেন এমন সময় ক্রন্দনরত এক নারী অর্থমন্ত্রীকে বললেন, মুক্তিবাহিনী ভুলক্রমে কোলাবরেটর মনে করে তার স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছে। তাজউদ্দীন স্পষ্টই বিচলিত হয়ে পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেলকে ফোন করলেন এবং হতভাগা ভিকটিমকে দ্রুত উদ্ধার করতে বললেন। এ অবস্থায় আলাপ করার সুযোগ নেই মেনে নিয়ে অর্থ সচিব ফিরে গেলেন। ঠিক করলেন মন্ত্রী যখন অফিসে বসতে পারবেন তখনই সিদ্ধান্ত নেবেন।
বঙ্গবন্ধু যখন লায়লপুর জেলে বিচার প্রহসনের মুখে তাজউদ্দীন তার নামে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ তাজউদ্দীন প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বেলায় রাজনীতি দূরে সরিয়ে রেখেছেন, চাকরিজীবীদের তাদের বিধান অনুযায়ী কাজ করার পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দিয়েছেন- অন্তত অর্থ সচিব তা পেয়েছেন।
বিশ্বব্যাংক প্রধান ঢাকা এলে তাজউদ্দীন তাকে উপেক্ষা করেছেন, হার্ডলাইনার ভূমিকা পালন করেছেন বাজারে এমন ঢের রটনা রয়েছে। কিন্তু তার অর্থ সচিব তা খারিজ করে দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন- উন্নয়ন সহায়তা চাওয়ার প্রশ্নে তাজউদ্দীন কখনো হার্ডলাইনার ছিলেন না, যদিও কেউ কেউ সে রকম বর্ণনা করেছেন। ‘১৯৭২-এর জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাংক প্রধান রবার্ট ম্যাকনামারার অর্ধদিবসের ঝটিকা সফরের আগে অর্থমন্ত্রী আমাকে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদ লাভের আবেদন প্রক্রিয়াকরণ করতে বললেন। এটা বেশ দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়া- বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদের জন্য আবেদনের আগে আইএমএফ সদস্যপদ পাওয়া বাধ্যতামূলক। তিনি এ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং বারবার অগ্রগতি জানতে চেয়েছেন।’
শেষ পর্যন্ত ১৯৭২-এর জুলাই মাসে বাংলাদেশের উভয় সদস্যপদ প্রাপ্তি ঘটল। প্রধানমন্ত্রী তাকেই বাংলাদেশ থেকে আইএমএফের গভর্নর নিয়োগ করলেন এবং যথাসময়ে ১৯৭২-এর সেপ্টেম্বরে তিনি ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভায় যোগ দিলেন। লন্ডনের মার্লবরো হাউসে কমনওয়েলথ অর্থমন্ত্রীদের বৈঠকেও তিনি যোগ দেন, অর্থ সচিবও উভয় বৈঠকে সফরসঙ্গী ছিলেন। বিশ্বব্যাংকের অর্থ সহায়তা সম্পর্কে তাজউদ্দীনের ধারণা নিয়ে বিশ্বব্যাংক প্রধান রবার্ট ম্যাকনামারার মনেও খটকা ছিল; কিন্তু তার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তাজউদ্দীনের খোলামেলা ও প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি যে ম্যাকনামারাকে বিস্মিত করেছে তার চেহারাতেই প্রতিভাত হয়েছে।
তিনি লিখেছেন, ১৯৭২-এর সেপ্টেম্বরে আমরা যখন ওয়াশিংটনে গেলাম আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তখন ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, একই বছর জানুয়ারিতে তা ছিল শূন্য। বিশ্ব অর্থনৈতিক বাজারে যখন ডলারের রাজত্ব সংরক্ষিত তহবিলের পরিমাণটা বেশ স্বস্তিদায়ক ‘প্রিন্সলি সাম’। আইএমএফ তখন ‘এক্সপোর্ট শর্টফল অ্যাডজাস্টমেন্ট ক্রেডিট’ নব্য অভ্যুদয় প্রাপ্ত দেশকে নিয়মিত প্রদানের যে প্রস্তাব দেয় আমরা তার ভালোমন্দ নিয়ে যখন বিতর্ক করছিলাম তাজউদ্দীন দ্রুত সেই বিতর্কের যবনিকা টেনে আইএমএফ ঋণ গ্রহণের সম্মতি দিলেন, কারণ এটা কোনো ধরনের শর্তযুক্ত ঋণ নয়। রপ্তানির আয়ের ঘাটতি পূরণে আইএমএফ এই ঋণ সহায়তা অনেক দেশকেই দিয়ে আসছে।
অর্থমন্ত্রী ও অর্থ সচিব কাজ শুরু করলেন। কয়েক দিনের মধ্যেই নতুন সংকট দেখা দিল। সংস্থাপন বিভাগের পরামর্শে প্রধানমন্ত্রী জ্যেষ্ঠ ৩০ জন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করলেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা ১৯৭১-এর ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস পদক ও পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। কারণ তাদের কোলাবরেটর বা পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে যোগসাজশকারী সাব্যস্ত করা হয়েছে। বিষয়টি অবহিত করতে অর্থ সচিব যখন তার মন্ত্রীর কাছে গেলেন, বুঝতে পারলেন তিনি বিষয়টি ভালোভাবেই অবহিত এবং আদেশ প্রত্যাহারের অনুরোধ নিয়ে তিনি গত রাতেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এটা তখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অতি উৎসাহী মুজিবনগর ফেরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ভুল বুঝিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে আদেশটি করিয়েছেন। পুরস্কার প্রদানের প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী হয়তো অবহিত ছিলেন না বলেই লেখক মনে করেন। এসব পদক ও পুরস্কার প্রদানের সুপারিশ একাত্তরের ২৫ মার্চের আগেই চূড়ান্ত হয়ে থাকার কথা। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করলেন তবে তাৎক্ষণিকভাবে আদেশটি বাতিল না করে ডক্টর কামাল হোসেনের নেতৃত্বে এক সদস্যের একটি কমিটি কেইসভিত্তিক পর্যালোচনা করে সুপারিশ প্রেরণের নির্দেশ দিলেন। ডক্টর কামাল তখন আইনমন্ত্রী। এক সদস্যের কমিটি প্রত্যেকের ব্যাপারেই সুপারিশ করেছে যেন তাদের পূর্বপদে স্থলাভিষিক্ত করা হয়। যারা তাদের চাকরিচ্যুতির উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাদের উদ্দেশ্য ছিল উপরের দিকে পদশূন্য করে নিজেদের পদোন্নতি ত্বরান্বিত করা।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে সরকারের জন্য একটি বিব্রতকর বিষয় হয়ে দাঁড়াল ভারতে মুদ্রিত বাংলাদেশি এক টাকার নোট। মতিউল ইসলামের রচনা থেকে এই ‘বিব্রতকর’ প্রচারণা বা বাস্তবতার একটি বিবরণীর অনুবাদ উপস্থাপন করছি :
মুজিবনগর সরকার ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার আগেই ভারতের নাসিক সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে এক টাকার নোট মুদ্রণের আদেশ দিয়ে আসে। এই টাকা পাকিস্তানি এক টাকার নোট প্রতিস্থাপন করবে। (নাসিক মহারাষ্ট্রের একটি শহর, সিকউরিটি প্রিন্টিং প্রেসটি ১৯২৫ সালে স্থাপিত হয় এবং সে বছরই প্রথম নোট মুদ্রণ করা হয়।) নোট সরবরাহের পর বাজারে নোট চালু হওয়ার পরপরই একটি অশুভ প্রচারণা শুরু হয়ে যায়- বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কুক্ষিগত করতে ভারতীয় নীতি অনুযায়ী নাসিক প্রিন্টিং প্রেস আদেশকৃত পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি নোট বাজারে ছেড়েছে। একটি সংবাদপত্র এমনকি এই প্রতিপাদ্য প্রমাণের জন্য পাশাপাশি দুটি এক টাকার নোট ছেপে দেয়- দুটোরই একই নম্বর। তাতে এটা প্রমাণিত হওয়া সম্ভব যে, বাজারে এমন আরো বহু ডুপ্লিকেট নোট চালু হয়ে গেছে। আমরা দুজনই এ নিয়ে অবিচলিত থাকি- আমরা মনে করি একটি নোট দুবার মুদ্রিত হয়ে থাকতে পারে; কিন্তু তা প্রমাণ করে না যে বহু ডুপ্লিকেট নোট অর্থ বাজারে চালু আছে।
দুর্ভাগ্যবশত এই প্রচারণা থামেনি বরং এতটাই তুঙ্গে পৌঁছে, তখন একটি লম্বা সময় নিয়ে এই এক টাকার নোট প্রত্যাহারের ঘোষণা এবং ব্যাংকে এই নোট জমা দিয়ে ইংল্যান্ডে মুদ্রিত নোট গ্রহণের সুযোগ করে দেয়া হলো। এতে কেউ কেউ সন্তুষ্ট হলেন, কিন্তু সবাই নন। নতুন করে সমালোচনা শুরু হলো, তখনই সব এক টাকার নোট নিষ্ক্রিয় করার ঘোষণা দেয়া উচিত ছিল বরং সময় ও সুযোগ দেয়াতে ভারতীয় প্রেস বাজারে অতিরিক্ত নোট সরবরাহ করবে।
এক পর্যায়ে অর্থমন্ত্রী প্রকাশ্য বিবৃতি দিতে বাধ্য হলেন : যে সংখ্যক নোট মুদ্রণ ও সরবরাহের আদেশ ভারতীয় সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসকে দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হওয়া এক টাকার নোট যদি তার চেয়ে বেশি হয় তাহলে তিনি পদত্যাগ করবেন। তারিখ পেরিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক যখন নোট গণনা করল দেখল একটি বাড়তি টাকাও জমা পড়েনি। বরং ৪০ লাখেরও অধিক এক টাকার নোট কম জমা পড়েছে। অর্থাৎ অর্থমন্ত্রীর অবস্থান যে সঠিক ছিল তা প্রমাণিত হয়েছে।
বাংলাদেশে ফেরার পর অর্থমন্ত্রী যেদিন সচিবালয়ে গেলেন তাকে অভ্যর্থনা জানালেন এডিশনাল চিফ সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম (পরবর্তী সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর)। চিফ সেক্রেটারি পশ্চিম পাকিস্তানের ‘ফাইন জেন্টেলম্যান’ মুজাফফর হোসেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে তখন যুদ্ধবন্দি (তারই স্ত্রী লায়লা হোসেন সে সময়ে লন্ডনে অবস্থান করছিলেন, ১৮ ডিসেম্বর হিথ্রো বিমানবন্দরে পাকিস্তানগামী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে দেখা করেছিলেন।) তাজউদ্দীন সমবেত কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ভাষণ দেন- তিনি তাদের দেশপ্রেম ও বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেননি, চাকরি অব্যাহত কেন রেখেছেন সে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেননি, কোনো শাস্তির ভয়ভীতি দেখাননি- স্বাধীন দেশের জন্য মন দিয়ে কাজ করতে বলেছেন। মতিউল ইসলাম দায়িত্ব গ্রহণের দুদিন পর সুইজারল্যান্ডের বহুজাতিক কোম্পানি সিবা-গেইগির প্রতিনিধি জাতিসংঘ রিলিফ অপারেশন প্রধান মিস্টার উমব্রিখটকে নিয়ে দেখা করতে এলেন। তিনিও সুইস নাগরিক। অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তারা একটি সংবেদনশীল বিষয় উপস্থাপন করলেন। সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তান কীটনাশক সরবরাহের জন্য যে ঋণ গ্রহণ করেছে তা কে পরিশোধ করবে? এ নিয়ে অর্থমন্ত্রী ও অর্থ সচিব আলাপ করলেন এবং দ্রুত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে একটি পলিসি স্টেটমেন্ট জারি করলেন : পূর্ব পাকিস্তানের কল্যাণের জন্য পাকিস্তান সরকার যেসব ঋণ চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল বাংলাদেশ তার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। সন্তুষ্ট হয়ে সিবা-গেইগি প্রতিনিধি দল চলে গেল। এই নীতিমালাই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কার্যকর করা হলো- পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত সব প্রকল্পের দায়ভার সরকার গ্রহণ করল। বিশ্ব সংস্থা ও বৈশ্বিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এটা ছিল রাষ্ট্রসুলভ ও আশ্বস্তকর প্রতিশ্রæতি। অর্থমন্ত্রীই মতিউল ইসলামকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নে সফরসঙ্গী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভারতের সঙ্গে আলোচনার সময় তিনি যেন প্রধানমন্ত্রীকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে সে পরামর্শও তার।
কাজের স্মৃতির সবটাই যে সুখকর এমন নয়। হাজার টাকায় যখন সর্বোচ্চ বেতন নির্ধারিত হলো অর্থ সচিব আদেশ জারি করলেন বাকি টাকার সেভিং সার্টিফিকেট ইস্যু করা হবে। কিন্তু বিষয়টি অর্থমন্ত্রী পছন্দ করলেন না, নাম উল্লেখ না করলেও তিনি বললেন, আমলারা মুক্তি সংগ্রামের চেতনা নস্যাৎ করে দিচ্ছে। বস্তুত সেভিং সার্টিফিকেট ইস্যু করার সিদ্ধান্তটি মুজিবনগরে এক মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে বর্তমান অর্থমন্ত্রী তখনকার প্রধানমন্ত্রী নিজেই অনুমোদন করেছিলেন। অর্থ সচিব তখন সে অনুমোদনের নথি দেখালে তিনি বললেন, পরিস্থিতি এখন ভিন্ন, আত্মত্যাগ করতে হবে। সচিবের জারি করা আদেশটি বাতিল করতে হয়।
সে সময় সরকারের পরিকল্পনা ছিল তখন বাংলাদেশের বাজারে প্রচলিত পাকিস্তানি মুদ্রা আকস্মিকভাবে বাজেয়াপ্ত না করে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে প্রত্যাহার করে নেয়া। অর্থ সচিব তখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের এক পর্যায়ে লেনিনগ্রাদে। এ সময় অর্থমন্ত্রী ফোন করে তাকে জানান পাকিস্তান নিজেদের একটি নোট বাতিল করে দিয়েছে, যা বাংলাদেশে চালু অবস্থায় আছে। এটা অবিলম্বে বাতিল করার আদেশ জারি করা দরকার। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে স্টেট ডিনার পাশ কাটিয়ে হোটেল কক্ষে এসে দেশে প্রেসিডেন্টকে সাইফার মেসেজে বার্তাটি পাঠিয়ে দিলেন।
১৯৭২-এ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কলকাতা সফরের দ্বিতীয় দিন। বর্ণনাটি তার লেখা থেকে অনুসৃত : কলকাতায় আমাদের দ্বিপক্ষীয় আলোচনার দ্বিতীয় দিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গভর্নমেন্ট হাউসের বাঙ্কোয়েট হলে ভোজনের আমন্ত্রণ জানালেন। আমি অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর স্যুটে প্রবেশ করলাম, তাকে নিয়ে বাঙ্কোয়েট হলে যাব, কিন্তু সেখানে দেখলাম উত্তেজনা- কী ঘটেছে? প্রধানমন্ত্রীর নতুনতম মুজিব কোটের গলার কলার ঠিকভাবে সেট হচ্ছে না। খোলা গলায় তো আর তিনি বাঙ্কোয়েটে যেতে পারেন না। আমি পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে অন্য সবাইকে তার রুম থেকে বের করে তার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, সারসের মতো গলা যত সম্ভব উঁচু করুন। একই সঙ্গে আমি কলারের দুই প্রান্ত চেপে কাছাকাছি আনছিলাম। হঠাৎ ক্লিক শব্দ হলো, গলা লেগে গেছে ঠিকভাবে। তারপর আমরা যখন বাঙ্কোয়েট হলে প্রবেশ করলাম, আমাদের জাতীয় সংগীত বাজতে শুরু করল।
সাবেক অর্থমন্ত্রীর (২৮ অক্টোবর ১৯৭৪ ছিল অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার শেষ দিন) সঙ্গে সাবেক অর্থ সচিব মতিউল ইসলামের শেষ দেখা ৭ জুলাই ১৯৭৫। তিনি বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক হিসেবে ওয়াশিংটনে কর্মরত; ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি সাবেক অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন তার সাত মসজিদ রোডের বাসায়।
১৯৭৭-এর আগস্টে বিশ্বব্যাংক অধ্যায় শেষ করে ঢাকায় ফিরলেন। সরকারি চাকরির ইতি টানলেন, রহমান রহমান হক-এ যোগদানের মাধ্যমে মতিউল ইসলাম শুরু করলেন জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়