প্রতারণার মামলা : জামিন পেলেন দুই বছরের সাজাপ্রাপ্ত হেলেনা জাহাঙ্গীর

আগের সংবাদ

আওয়ামী লীগে মনোনয়ন যুদ্ধ : দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু আজ, কার্যক্রমের সূচনা করবেন শেখ হাসিনা

পরের সংবাদ

সমঝোতার সম্ভাবনা কী শেষ! বিশ্লেষকদের মতে, সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি > উদ্যোগ নিতে হবে দেশের ভেতর

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৭, ২০২৩ , ২:১৫ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি : ভোটের আবহের মধ্যেই হরতাল, অবরোধ সহিংসতার রাজনীতিতে উত্তপ্ত দেশ। এর মধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করে দিলেও বিএনপি ও সমমনারা তফসিল প্রত্যাখান করে নির্বাচন প্রতিহত করার হুমকি দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সরকার ও বিরোধীপক্ষের মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনা কী শেষ হয়ে গেল? নাকি আলোচনার মাধ্যমে মতবিরোধ নিরসনের কোনো সুযোগ এখনো আছে? নির্বাচন ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, তফসিল হয়ে গেলেও সমঝোতার সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তাদের মতে, অতীতেও তফসিল ঘোষণার পর এ ধরনের সমঝোতার নজির রয়েছে। রাজনৈতিক দল কিংবা নাগরিক সমাজের উদ্যোগে এই সমঝোতা হতে পারে। তবে বাইরের কোনো রাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় নয়।
নির্বাচন কমিশন গত বুধবার দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। তফসিলকে স্বাগত জানিয়ে তাৎক্ষণিক আনন্দ মিছিল করে ক্ষমতাসীনরা। অন্যদিকে তফসিলকে প্রত্যাখ্যান করে হরতাল ডাকে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। তফসিল ঘোষণার পরও সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলো সহিংস আন্দোলন চালাচ্ছে। একই দাবিতে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি ও সমমনারা। ব্যাপক সহিংসতার মধ্যে সেই নির্বাচনে জিতে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি গণফোরামের ড. কামাল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে ভোটে অংশ নেয়। ভোটে ভরাডুবি ঘটে বিএনপির। এরপর কারচুপির অভিযোগ তোলে তারা। সংসদের মেয়াদের শেষ দিকে এসে বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করেন। এবারো ২০১৪ সালের মতো একই দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপি। ফিরে এসেছে সংঘাতের পরিবেশ। যানবাহনে অগ্নিসংযোগ আর নাশকতার ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে। এ অবস্থায় আলোচনায় উঠে এসেছে রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়টি। বিশ্লেষকদের মতে, রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। তফসিল ঘোষণার পরও সমঝোতার পথ খোলা রয়েছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো বসে ঐকমত্যে পৌঁছে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে। এদিকে ১৯৯০ পরবর্তী বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সংকটে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে চার দফা আলোচনা বা সংলাপ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯৪ সালে কমনওয়েলথ এবং ২০১৩ সালে জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিনিধি দুদলের মধ্যে আলোচনার মধ্যস্থতা করেছিল। কিন্তু এসব সংলাপে কার্যত সমাধান আসেনি। তবে ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদের পতনের আগে মূলত আন্তর্জাতিক চাপেই সান্ধ্য আইন তুলে নিতে হয়েছিল এরশাদকে। এরপর আর পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি এরশাদ। ১৯৯৬ সালের খালেদা জিয়া সরকারের পদত্যাগের পর ওই বছরের ১২ জুনের নির্বাচনের প্রেক্ষাপটেও বিদেশিদের নেপথ্য ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়।
সংলাপ নয়, নির্বাচনের দুয়ার খোলা : আগামী নির্বাচন নিয়ে চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ বা সমঝোতার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলেছে এর কোনো প্রয়োজনীয়তাই তারা বোধ করছেন না। নির্বাচনী ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। সংলাপের সময় কোথায়? তবে নির্বাচনের দুয়ার সব রাজনৈতিক দলের জন্য খোলা। বিএনপি তাদের এক দফা দাবি ছেড়ে যদি নির্বাচনে আসে তবে স্বাগত জানাবে আওয়ামী লীগ- এমন মন্তব্য আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের। রাজনৈতিক দলগুলোকে শর্তহীন সংলাপের জন্য মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর চিঠি এবং সিইসির রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপের আহ্বানের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংলাপের সময় এখন আর অবশিষ্ট নেই। গতকাল (বুধবার) এটা আমি বলেছি। মিস্টার লুয়ের চিঠি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমি আলাপ করেছি। সেই চিঠির জবাব দু-একদিনের মধ্যে দেব। এটা একটা সৌজন্যবোধ, শিষ্টাচারের বিষয়। তিনি একটা চিঠি দিয়েছেন, সেটার জবাব আমরা অবশ্যই দেব। এটা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির মধ্যেও পড়ে। সেতুমন্ত্রী বলেন, আমরা সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করতে চাই। একা নির্বাচন করতে চাই না, সবাইকে নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চাই। সব দলকে নির্বাচনে আসার আহ্বান জানাই। যারা নির্বাচনে আসতে চায় তাদের জন্য

নির্বাচনের দরজা খোলা আছে। বিএনপি যদি মন পরিবর্তন করে নির্বাচনে আসে তাহলে স্বাগত জানাই।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির দুই নেতা ঘোষণা দিয়েছেন- তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন, তাদের সঙ্গে আরো শতাধিক প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। সুতরাং এগুলো (জ্বালাও-পোড়াও) করে বিএনপির কোনো লাভ হবে না।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, দেশ এখন সংলাপে নয়, নির্বাচনী ট্রেনে। তফসিল ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে নির্বাচনের আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। সংলাপ করার এখন সময় কোথায়?
সংলাপ প্রসঙ্গে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, তথ্য ও স¤প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আমরা সংলাপের বিরুদ্ধে নই; কিন্তু কোনো সন্ত্রাসীর সঙ্গে সংলাপ হতে পারে না। বিএনপি তো সংলাপ নাকচ করে দিয়েছে। বিএনপি বলেছে, এখন সংলাপের কোনো পরিবেশ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে বা প্ররোচনায় ক্যাপিটল হিলে হামলা হওয়ার পর সেই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন-সরকার আলোচনায় বসেছে? বরং তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বিচার হচ্ছে। আমাদের দেশেও যারা গাড়ি পোড়াচ্ছে, তাদের সঙ্গে কি আলোচনা হতে পারে? আলোচনা হতে পারে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে, সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে নয়।
হরতাল-অবরোধেই বন্দি বিএনপির কর্মসূচি : তফসিল ঘোষণার পর গতকাল বৃহস্পতিবার ৪৮ ঘণ্টা হরতালের ডাক দিয়েছে বিএনপি। বিএনপির আন্দোলনসঙ্গী গণতন্ত্র মঞ্চও একই দাবিতে হরতালের ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপি নেতারা বলছেন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি আওয়ামী লীগ মেনে নিলেই কেবল একটি সমঝোতার পথ উন্মুক্ত হতে পারে। বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো জানিয়েছে, নতুবা তারা আরো কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান ভোরের কাগজকে বলেন, অর্থবহ সংলাপ করতে অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ জরুরি। তবে সংলাপ শুধু সংলাপের জন্য নয়। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এর একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। আর তা বাস্তবে অর্জন করতে হলে অনুকূল পরিবেশ এবং পারস্পরিক আস্থা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে আজ এই দুটি বিষয়ই সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির পঞ্চম দফার অবরোধ শেষ হবে শুক্রবার ভোর ৬টায়। এর মধ্যে রবিবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, এই সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে এক দফা এবং গতকাল (বুধবার) নির্বাচন কমিশন যে একতরফা তফসিল ঘোষণা করেছে, তার প্রতিবাদে হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করছি।
সমঝোতার উদ্যোক্তা দেশের ভেতরেরই হতে হবে : বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করছে। অন্যদিকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজমান না থাকলে জনগণ ভোটে উৎসাহ পাবে না। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল ভোরের কাগজকে বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটের মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। দুপক্ষের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার উদ্যোগ দরকার- তা যে কোনো ফরমেটেই হোক। নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতার বিষয় রয়েছে। এছাড়া দেশের মানুষের ভোট দেয়ার জন্যও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দরকার। রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেশের মানুষের ওপর প্রভাব পড়ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। এই অবস্থায় সমঝোতা দরকার। তিনি বলেন, উদ্যোগ যে কেউ নিতে পারে। সরকারি দল, বিরোধী দল, রাজপথের বিরোধী দল কিংবা নাগরিক সমাজ- যে কেউ সমঝোতার উদ্যোগ নিতে পারে। তবে এই উদ্যোগ দেশের ভেতরেই হতে হবে। দেশের বাইরে থেকে নয়। বিদেশিরা সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে কিন্তু সংলাপ কিংবা সমাঝোতার উদ্যোগ দেশের ভেতর থেকেই হতে হবে।
প্রসঙ্গত, সংবিধান অনুযায়ী ১ নভেম্বর থেকেই শুরু হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের ক্ষণগণনা। ভোটের প্রস্তুতিতে আগেই রোডম্যাপ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সেই অনুসারে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ, ব্যালট বাদে ভোটের বাকি সরঞ্জাম জেলায় জেলায় পৌঁছে দেয়াসহ সব কাজ সেরেছে নির্ধারিত সময়েই। রেওয়াজ অনুযায়ী ৯ নভেম্বর বঙ্গভবনে ভোটের সবশেষ প্রস্তুতি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেছে কমিশন। আগামী ৭ জানুয়ারি ভোটের তারিখ ঘোষণা করে তফসিল দিয়েছে ইসি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়