বাস মালিক সমিতি বিএনপির অবরোধ মানবে না

আগের সংবাদ

দিনক্ষণ ঘোষণার অপেক্ষা : নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে কালই, ভোট জানুয়ারির প্রথমার্ধে

পরের সংবাদ

ইইউর সামনে শ্রমিকের কমিক

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রুটিন তথা সিডিউল সফর হলেও দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের একটা বাজে সময়ে ঢাকা সফরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলটি। তারা ১২ নভেম্বর আসবে বলেই কি দিন কয়েক আগ থেকে সাজানো হয়েছিল ন্যূনতম মজুরি নিয়ে গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলনের সøটটি? এ ছাড়া দেশের রাজনীতির ময়দানও বেশ উত্তাল। রাজনীতি এবং শ্রম খাতে নানা ঘটনা চলমান ঘটমান। শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, শ্রম আইন, শিশুসহ অন্যায্য শ্রম নিরসন, শ্রমিকবিরোধী পদক্ষেপ, শ্রম ইউনিয়নবিরোধী তৎপরতা, শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গতভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ, ন্যূনতম মজুরি, বাধ্যতামূলক শ্রম বন্ধের মতো কত বিষয় তো রয়েছেই। আলামতসহ নানা কারণে এসেছে প্রশ্নটি। কেউ খোলাসা না করলেও নমুনা দৃষ্টে জবাব প্রায় পরিষ্কার। দেশের শ্রম খাতের অগ্রগতি পর্যালোচনায় ইইউ প্রতিনিধি দলের সফরটি পূর্বনির্ধারিত। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পাওলা প্যাম্পালোনি।
ঢাকা পৌঁছেই শুরু হয়েছে তাদের কর্মব্যস্ততা। তাদের অনেক কাজ এখানে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের শ্রম অধিকার সুরক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনি ও প্রশাসনিক সংস্কারের ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে শ্রম খাতের উন্নয়নে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বা এনআইপি গৃহীত হয়। ২০২৬ সালের মধ্যে এটি বাস্তবায়নে আইএলও এবং অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদাররা সহযোগিতা করছে। এসব বিষয় তারা দেখবেন স্বাভাবিকভাবেই। কাকতালীয় হোক আর পরিস্থিতি বুঝে হোক, ইইউ প্রতিনিধিদের সফরের বেশ আগে থেকে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে মাঠ গরম শুরু করে শ্রমিকরা। সরকার এর মধ্যে বেশ কিছু ‘কিন্তু’ দেখছে। শ্রমিকদের নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই একটি মহল পোশাক খাতে অসন্তোষ সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে- এমন বার্তা ছিল সরকারের কাছে। সেই আলোকে তৈরি পোশাক খাত অধ্যুষিত অঞ্চল নারায়ণগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া, চট্টগ্রাম ও টঙ্গী এলাকায় অবস্থিত পোশাক কারখানাগুলো নজরদারির আওতায় রয়েছে। এর মাঝে বেতন বাড়ানোর পরও ভাঙচুর, নাশকতা ও সহিংসতা চলতে থাকে।
আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় সহিংস ঘটনা ঘটেছে। অনেক গার্মেন্টসে শ্রমিকরা কাজে ফিরলেও কিছু লোক তাদের কাজে বাধা দেয়। রাস্তা অবরোধ করে। কারখানার ভেতর ঢুকে ভাঙচুরও করেছে বেশ কিছু কারখানায়। এরা আসলে শ্রমিক নয়। শ্রমিকের কমিক করা এই লোকদের পেশাদার শ্রমিকরা চেনেন না। তারা বেশ শক্ত-সামর্থ্যবান। তাদের কারো কারো চলাফেরা নামিদামি গাড়িতে। এক সময় পোশাকশিল্পসহ শ্রমিক সেক্টরে প্রভাব ছিল বাম ঘরানার লোকদের। তা অনেকটা কমে গেছে। বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াতের শ্রমিক সেক্টরও দুর্বল। এ অবস্থায় শ্রমিক নামধারী এ চক্রটির কোত্থেকে আগমন, তা এখনো রহস্যাবৃত। তাদের টাকার উৎসই বা কোথায়?
শ্রমিক নামধারী এ চক্রটি আপাতত কিঞ্চিৎ সফল। শ্রমিক মরেছে। আহত হয়েছে অনেকে। তাদের উৎপাতে আশুলিয়া-সাভার-গাজীপুরে শত শত গার্মেন্টস বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন মালিকরা। দেশের বড় অর্থনৈতিক খাত গার্মেন্টস ব্যবসা থেকে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের গার্মেন্টসশিল্প ধ্বংসে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে শ্রমিক নেতাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। বিভিন্ন দেশের কাছে এ শিল্পকে তুলে দিতে একটি স্বার্থান্বেষী মহল দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র করছে।
ন্যূনতম মজুরি আরো বাড়ানোর চলমান শ্রমিক অসন্তোষকে সরকার শুরু থেকেই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। র‌্যাব-পুলিশের সঙ্গে বিজিবি নামানো হয়েছে। চলেছে ধরপাকড়। গার্মেন্টস মালিকরাও বেশি সময় নষ্ট করেননি। জিম্মি না হয়ে দ্রুত কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছেন তারা। কারখানায় প্রবেশ করে কাজ না করা, কারখানায় ভাঙচুরসহ কয়েকটি কারণ দেখিয়ে শ্রম আইনের ২০০৬-এর ১৩ (১) ধারা মোতাবেক কারখানা অনির্দিষ্টকাল বন্ধ ঘোষণা করে মূল ফটকে নোটিস টানিয়ে দিয়েছেন। এরপর থেকে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত। শ্রমিক নামধারী বিশেষ কিছু মুখকে দেখা যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেও সুবিধা পাচ্ছে না। তবে এটি মোটেই চূড়ান্ত ফয়সালা নয়। এর পূর্বাপরে কিছু কথা রয়েছে। একজন অদক্ষ পোশাককর্মীর ন্যূনতম মাসিক মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়েছে, যা ১১৩.৬ ডলারের সমতুল্য। এর সঙ্গে ওভারটাইম ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা যোগ করে একজন অদক্ষ শ্রমিক গড়ে প্রায় ১৯ হাজার টাকা বাসায় নিতে পারবেন।
এর বিপরীতে শ্রমিকদেরও কথা আছে। বিশেষ করে দক্ষ শ্রমিকদের। বেতন-মজুরি-ভাতায় তাদের অবস্থান বদলায়নি। কিন্তু এ নিয়ে আলোচনায় না গিয়ে আন্দোলনের নামে অরাজকতা এবং সেখানে মহলবিশেষের অনুপ্রবেশ কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় খাত রেডিমেড গার্মেন্টস-আরএমজি ব্যবসা অন্য কারো হাতে চলে যাক মালিক-শ্রমিক-সরকার কেউই তা চাইবে না। ফ্যাক্টরি ভাঙচুর, রাস্তা অবরোধ করে মানুষের যাতায়াত বন্ধ করা গণতান্ত্রিক অধিকার হতে পারে না। একইভাবে শ্রমিকদের ওপর পুলিশের গুলি চালানোও গণতান্ত্রিক অ্যাকশন নয়। পোশাকশ্রমিকদের জন্য যে মজুরি বাড়ানো হয়েছে, তা নিয়েই তাদের কাজ করার আহ্বানের মধ্যে সরকারের মনমর্জি পরিষ্কার। সময়মতো তিনি শ্রমিকদের বিষয়টি দেখবেন বলেও কথা দিয়েছেন। এও বলেছেন, তারা কারো প্ররোচনায় রাস্তায় নামলে, যারা নামিয়েছে তারাই তাদের (শ্রমিকদের) লাশ ফেলবে। এরাই এমন অবস্থা সৃষ্টি করবে যে, তারা (শ্রমিকরা) চাকরি হারাবে, কাজ হারাবে, গ্রামে গিয়ে পড়ে থাকতে হবে। মোটকথা, বলার আর কিছু বাকি রাখেননি প্রধানমন্ত্রী।
কথার পিঠে কিছু কথা কিন্তু থেকে যায়। অভাব-ক্ষুধা নৈতিকতা মানে না। নিত্যপণ্যের দামসহ বাজার পরিস্থিতিতে শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ-বিরক্ত। তা লুকানো-চাপানোর মতো নয়। আন্দোলনকারী শ্রমিকরা সবাই কোনো রাজনৈতিক দলে জড়িত নয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের লোকদের চোখে শ্রমিকরা বিএনপিসহ বিরোধী দলের। এমন সরলীকরণ দুঃখজনক। নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে শ্রমিক কেন নিম্ন ও মধ্যমানের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষই ক্ষেপবে। গণমাধ্যমে সংবাদ হবে, বিশ্লেষণ হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রলও হবে। হচ্ছেও। সরকারকে তা সহ্য করতে হবে। তা না করে মানুষের মাথাপিছু আয় ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির অঙ্ক শোনা বড় কষ্টের। তিন বেলা লিপস্টিক লাগানো, দুবেলা স্যান্ডেল বদলানোর কিচ্ছা অভাবী মানুষের কলিজায় ঘা দেয়। কিছু কথাও চলে আসে সামনে। ওঠে প্রশ্ন। প্রশ্ন কি আসবে না- আয় বেড়েছে কতজনের? ক্রয়ক্ষমতা তিন গুণ বেড়েছে কাদের? যে চার কোটি মানুষ ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্টান্ডার্ডে বাজার করে তাদের মধ্যে কোনো গার্মেন্টস শ্রমিক কি আছে? দেশের মানুষ বেহেস্তে আছে দাবি করা মন্ত্রী মহোদয়, তার সহকর্মী বা স্বজনদের জন্য তা প্রযোজ্য হতেও পারে। তাদের জন্য বেহেস্তের একটা বাংলাদেশ ব্রাঞ্চ থাকলেইবা আপত্তি করার সাহস কার? দেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য তৈরি পোশাক কারখানায় একজন শ্রমিক ১৬ বছর কাজ করার পরও সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতনে কি ওই বেহেস্তের দর্শক হওয়ার মুরোদও রাখে?
আমাদের আয়-আয়ু, ব্যয়-বায়ুর অঙ্ক বের করার কাহিনি কেবল গার্মেন্টস শ্রমিক নয়, আরো অনেকেরই অজানা। এক বছরে দেশজ উৎপাদন থেকে যে আয় হয়, তার সঙ্গে রেমিট্যান্স যোগ করে জাতীয় আয় বের করা হয়। সেই জাতীয় আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে গড় মাথাপিছু আয় বের করা হয়। অবৈধ পথে বিপুল টাকা-পয়সা কামিয়ে বিদেশে পাচারকারী আর মাথাপিছু সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতন পাওয়া পোশাকশ্রমিকের মাথাপিছু আয় গড়ের অঙ্কে সুন্দর করে মিলে যায়। বা মিলিয়ে দেয়া হয়। গড়ের অঙ্কে তার মাথার পেছনেও বিশাল আয়। যে শ্রমিক ঢাকা শহরে চাকরি করে সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতন পান, তার ঘর ভাড়া কত? বাজার খরচ কত? বাড়িতে বাবা-মা বা পরিবারের জন্য কত টাকা পাঠাতে হয়, সেই অঙ্ক খোঁজার ব্যবস্থা নেই মাথাপিছু আয় নির্ণয়ে। অর্থাৎ বাস্তবে মাথা যার ব্যথাও তার। তবে মাথা যার যার, মাথাপিছু আয় সবার।
সেই ক্ষেত্রে যে পোশাকের গায়ে চড়ে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা স্টিকার ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে ঘুরে বেড়ায় এবং বাংলাদেশের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে- সেই মেইড ইন বাংলাদেশের কারিগরদের প্রতি বিশেষ একটি ভাবনার দাবি রাখে। এই বেতনে এক কেজি চাল, এক কেজি আলু, একটু তেল-নুন-পেঁয়াজ কিনতে তাদের কী অবস্থা হচ্ছে, তা আমলে নেয়া জরুরি। নইলে কেবল এ শ্রেণি নয়, অন্যান্য কর্মস্থলেও শ্রমিকের কমিক করা মহলের সুযোগ আরো বাড়তেও পারে। স্বল্প আয়ের প্রতিটি মানুষের জীবনগাড়ির গতি এখন প্রায় একই। সবার দীর্ঘশ্বাসের রং অভিন্ন। চোখের জল সবারই নোনা। বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতার মাঝেও রাষ্ট্রের এখানে করার কিছু না কিছু থাকে।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়