ডেঙ্গু পরিস্থিতি : ছুটির দিনে রোগী ও মৃত্যু দুইই কম

আগের সংবাদ

কদর বেড়েছে বোমাবাজদের : ২০১৪-১৫ সালের স্টাইলে আগুন-বোমা, পুরনো সন্ত্রাসীরা সক্রিয়, মাঠে নতুন বোমাবাজ

পরের সংবাদ

ওরা কি জন্মেছে মৃত্যুর জন্য?

প্রকাশিত: নভেম্বর ৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইসরায়েল-হামাস সংঘর্ষে কার্যত মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে গাজা। সেখানে মৃতের সংখ্যা ৯ হাজার ছাড়িয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে প্রচুর শিশুও। গাজায় ইসরায়েলের অব্যাহত বোমাবর্ষণে প্রতিনিয়তই শিশুমৃত্যু বাড়ছে। গত ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকে সেখানে নিহত শিশুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৫০০ জনে; যা ২০১৯ সালের পর থেকে বিশ্বজুড়ে বার্ষিক সংঘাতে নিহত শিশুদের মোট সংখ্যার চেয়ে বেশি। টার্গেট করা শিশুগুলো ছিল নিরস্ত্র এবং তারা ইসরায়েল রাষ্ট্র বা এর নাগরিকদের জন্য কোনো ধরনের হুমকিও তৈরি করছিল না। তাহলে কেন এভাবে নির্বিচারে শিশু হত্যা করছে। সমগ্র পৃথিবী এবারের বর্বরতা-নিষ্ঠুরতাকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করছে, যা সম্ভবত কখনো এমনভাবে দৃশ্যমান হয়নি। মুক্তবিশ্ব কোথায়? নির্যাতিত মানুষের ওপর গণহত্যা চলছে। দেখার কেউ নেই।
সর্বাত্মক অবরোধে গাজায় পানি নেই, জ¦ালানি নেই, ওষুধ নেই। শিশুখাদ্য তো বটেই, সামগ্রিকভাবেই খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে গাজায়। লোকজন ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিয়েই প্রাণ বাঁচাতে এলাকা ছাড়ছে। পথে তাদের ওপর হামলা হচ্ছে। ইসরায়েলের নিষ্ঠুরতা কেউ দেখতে চাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় সমর্থক, পৃষ্ঠপোষক। একই নীতি ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ার। আরব বিশ্বের নীতিনির্ধারণে আমেরিকাই শেষ কথা। ইরান ছাড়া অন্য প্রায় সবাই ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনে ব্যস্ত। এ সংকট ১০০ বছরের পুরনো। সংকট নিরসনে কয়েকবার নেয়া হয়েছে শান্তি উদ্যোগ। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বরং দ্ব›দ্ব বাড়ছে। মীমাংসা হচ্ছে না। নতুন নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে। সংঘাত নেপথ্যের একদিকে ইসরায়েলের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, অন্যদিকে ফিলিস্তিনের মানুষের নিজ বাসভূমে নিরাপদে বসবাসের স্বপ্ন। ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিরা বেশকিছু ইস্যুতে মোটেই একমত হতে পারছে না। এর মধ্যে আছে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ব্যাপারে কী হবে; পশ্চিম তীরে যেসব ইহুদি বসতি স্থাপন করা হয়েছে সেগুলো থাকবে, নাকি সরিয়ে নেয়া হবে। জেরুজালেম নগরী কি উভয়ের মধ্যে ভাগাভাগি হবে? আর সবচেয়ে জটিল ইস্যু হচ্ছে- ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্ন। গত ২৫ বছর ধরেই শান্তি আলোচনা চলছে থেমে থেমে। ফিলিস্তিনের মুক্তি কিংবা স্বাধীনতার ব্যাপারে ২২ সদস্যবিশিষ্ট আরব লিগও তেমন কোনো অর্থবহ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, এই সংঘাত শেষ হবে কীভাবে? কল্পনাতীত অস্থিরতা চলবে আর কতদিন? আর কত মানুষ প্রাণ হারাবে বুলেট-বোমার আঘাতে? এমন সব জিজ্ঞাসা মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই।
গাজা উপত্যকা ১৪ বছরে চারবার ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্য হয়েছে- ২০০৯, ২০১২, ২০১৪ ও ২০২১ সালে। ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলি সশস্ত্র বাহিনী গাজায় ৭ হাজার ৭৫৯ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৪১ শিশু এবং ৫৭২ জন নারী। গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার জবাবে দুই দিন পর থেকে ইসরায়েল গাজায় হামলা চালানো শুরু করে। হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ দেইফ এক বিবৃতি দেন। সেখানে তিনি জানান, গত ৭ অক্টোবর সকালে ইসরায়েলে পাঁচ হাজার রকেট বর্ষণের মাধ্যমে ‘অপারেশন আল-আকসা স্ট্রম’ শুরু হয়েছে। এ সময় ইসরায়েল গাজা থেকে অনুপ্রবেশের কথা স্বীকার করে। এই হামলা সম্পর্কে হামাসের উপপ্রধান সালেহ আল-আরোরি বলেছেন, তাদের এ লড়াইয়ের উদ্দেশ্য স্বাধীনতা অর্জন। কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরাকে তিনি বলেছেন, ‘এটা কোনো (চোরাগোপ্তা) অপারেশন নয়। আমরা সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছি। আমরা লড়াই চালিয়ে যেতে এবং লড়াইয়ের পরিধি বাড়াতে চাই। আমাদের প্রধান লক্ষ্য একটা- আমাদের স্বাধীনতা এবং আমাদের পবিত্র স্থানগুলোর স্বাধীনতা।’ তিনি বলেন, বিজয়, মুক্তি ও স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত হামাস লড়াই চালিয়ে যাবে। হামাসের আকস্মিক হামলার পর জনগণের উদ্দেশে দেয়া বিবৃতিতে হামাসকে ‘নজিরবিহীন মূল্য’ও চুকাতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন নেতানিয়াহু। তিনি বলেন, ইসরায়েলের জনগণ, আমরা যুদ্ধের মধ্যে রয়েছি (উই আর অ্যাট ওয়ার)। ঐতিহাসিকদের মতে, ১৯৫৩ সালের পর এই প্রথম এত বড় মাত্রার যুদ্ধ শুরু হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের আল-আকসা অঞ্চলে। এই ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েলের মধ্যে চলমান যুদ্ধে যে কয়টি বড় ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করা হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে অমানবিক হলো শিশু হত্যা। দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের ফিলিস্তিন শাখার কর্মকর্তা জেসন লির মতে এখন গাজায় প্রতি ১০ মিনিটে মারা যাচ্ছে একটি শিশু।
আমরা জানি শিশু হত্যা মহাপাপ। এছাড়া আইনের চোখে অপরাধ হলেও যেন আমরা ভুলে গেছি কিংবা মানছি না এই আইন। জাতিসংঘের ভূমিকা কতটুকু শক্ত হলে বন্ধ হবে এই অপরাধ? নাকি ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা চাওয়ার মূল্য দিতে হবে এই নিরপরাধ শিশুগুলোর জীবন দিয়ে। হয়তো অপেক্ষা করতে হবে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে এর বিচারের জন্য? এই প্রশ্নগুলো এখন বিশ্বের বিবেকবান মানুষকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। মানুষ চায় না ফিলিস্তিনে এরকম হিংস্রতা চলুক। জেসন লির জেরুজালেম থেকে বিবিসির সঙ্গে কথা বলা থেকে জানা যায়, এ পর্যন্ত যে ২০ হাজারের মতো মানুষ আহত হয়েছে, তাদের প্রতি তিনজনের একজন শিশু। এছাড়া জনাকীর্ণ পরিবেশ এবং যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি না থাকার কারণে সংক্রামক রোগ বাড়ছে। ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়িয়ে পড়ারও আশঙ্কা করছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, গাজায় ট্রাকের মাধ্যমে যে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে তা সাগরে এক ফোঁটা পানির মতো। ‘সার্জনরা অ্যানেসথেটিক ছাড়াই অস্ত্রোপচার করছেন, হাসপাতালগুলোতে আলোর উৎস হিসেবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে মানুষ।’ তিনি বলেন, তাদের চিকিৎসা সরবরাহ যেমন ব্যান্ডেজ শেষ হয়ে গেছে। আর ১৩০টি শিশু রয়েছে ইনকিউবেটরে যেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
ইউনিসেফের মুখপাত্র জেমস এল্ডার সাংবাদিকদের বলেন, গাজা উপত্যকা হাজার হাজার শিশুর জন্য একটি কবরস্থানে পরিণত হয়েছে। এটি অন্য সবার জন্য একটি জীবন্ত জাহান্নাম। খাবার পানির সংকট এখন গাজার শিশুদের বোমা কিংবা মর্টারের চেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। তিনি বলেন, গাজায় সুপেয় পানি উৎপাদন ক্ষমতা স্বাভাবিক স্তরের তুলনায় শতকরা ৫ ভাগে নেমে গেছে, যা ১০ লাখের বেশি শিশুকে পানি শূন্যতাজনিত মৃত্যুর ঝুঁকিতে ফেলেছে। তীব্র পিপাসার কারণে নোনা পানি পান করে অনেক শিশু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধের আগেও গাজার তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি শিশুকে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার প্রয়োজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, কারণ তারা ট্রমার মুখোমুখি হয়েছিল। তিনি বলেন, যখন চলতি লড়াই বন্ধ হয়ে যাবে, তখন এসব শিশুর আতঙ্ক কাটিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কয়েক প্রজন্ম সময় লেগে যাবে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং সরকারের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে। বিশ্বের অনেক দেশে ফিলিস্তিনি মানুষের স্বাধীনতার জন্য বিক্ষোভ চলছে। ফিলিস্তিনিরা জানে না আর কত মূল্য দিতে হবে তাদের স্বাধীনতার জন্য। ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ পৃথিবী বিশ্বের সাধারণ মানুষ দেখতে চায় না। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যার স্থায়ী সমাধান স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতি দেয়া। জাতিসংঘকেই এই উদ্যোগ নিতে হবে। ইসরায়েলের এই অনৈতিক কাজকে ঘৃণা করা শুরু করতে হবে যার যার অবস্থান থেকে। শিশু হত্যা দিন দিন যেভাবে বাড়ছে সেটি আর বাড়তে দেয়া উচিত নয়। তাই এখন বিশ্বের সব মানুষকে এক ছাতার নিচে এসে সমবেত হয়ে জানাতে হবে প্রতিবাদ, বের করতে হবে প্রতিরোধের পথ। তা না হলে মানবতার ইতিহাস লজ্জা পাবে।

ড. আজিজুল আম্বিয়া : কলাম লেখক ও গবেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়