ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৮ জনের, নতুন রোগী ১৭০৮

আগের সংবাদ

নির্বাচনের প্রস্তুতি চূড়ান্ত : ক্ষণগণনা শুরু > রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ইসির সাক্ষাৎ ৫ নভেম্বর > তফসিল ১৪ নভেম্বর, ভোট ৭ জানুয়ারি

পরের সংবাদ

সংঘাতের পথেই বিএনপি

প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কিছুটা ভয়-গুঞ্জন থাকলেও শঙ্কা ছিল না। গর্জন থাকলেও সেই দৃষ্টে বর্ষণের লক্ষণও ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নজরদারি থাকার কারণে অনেকের আশাবাদ ছিল ২৮ অক্টোবর শনিবার ব্যতিক্রমী কিছু হবে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির বিষয়ে ‘তলেতলে’ দুদলের সমঝোতা হয়েছে, এমন আলোচনাও ছিল। মোটকথা হরতাল বা সহিংস কোনো কর্মসূচি আসতে পারে সেই ধারণাও ছিল না ২৮ অক্টোবর শনিবার দিনের মধ্যভাগ পর্যন্ত। কিন্তু দুপুরের পর চিত্র পাল্টে যায়। বদলে যায় প্রেক্ষাপটও।
দুপুর ২টায় বিএনপির সমাবেশ শুরুর কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকে। কে বা কারা কাকরাইলে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা ঘটাল, পল্টন-বিজয়নগর এলাকায় পুলিশকে পেটাল, পুলিশও উপর্যুপরি টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ায় নেমে পড়ল- কিছুই পরিষ্কার নয়। বিএনপির অভিযোগ- আওয়ামী লীগ তাদের আগে ধাওয়া দিয়েছিল। আর আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপি নেতাকর্মীরাই কাকরাইলে প্রথম ঝামেলা বাঁধিয়েছে। ঘটনা ও অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মাঝেই বিএনপির সমাবেশ পণ্ড। প্রতিবাদে রবিবার সারাদেশে হরতাল ঘোষণা বিএনপির। পরে জামায়াতে ইসলামীরও একই ডাক। গণতন্ত্র মঞ্চেরও তাই। এর মধ্য দিয়ে বহুদিন পর আবার হরতাল যুগে ফিরল বাংলাদেশ।
বিএনপির সমাবেশে সংঘর্ষের ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিভাগ টুইট বার্তায় সব পক্ষকে শান্ত থাকা ও সংযমের আহ্বান। এতে জানানো হয়, ভিসা নিষেধাজ্ঞার জন্য সব ঘটনা পর্যালোচনা করা হবে। এদিকে ভয়েস অব আমেরিকাকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়া বার্তায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু বলেছেন, পুলিশ সদস্য ও রাজনৈতিক কর্মী নিহত হওয়া, সাংবাদিক আর হাসপাতালে হামলার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, সম্ভাব্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সব সহিংসতার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করবে। এর বাইরে তাৎক্ষণিক আরো কিছু খবর ঘুরছে নিউজ ফিডে। মহাসমাবেশকে ঘিরে সংঘর্ষের পর সন্ধ্যায় একজন মার্কিন প্রতিনিধি হঠাৎ নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয় পরিদর্শন করেছেন বলে খবর চাউর হয়। বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, এ খবরের সত্যতা জানেন না তিনি। এ ছাড়া দিনের মধ্যভাগে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, শ্যামা ওবায়েদসহ বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতা আমেরিকান ক্লাবে যাওয়ার খবরও আলোচিত। সেখানে তারা কিছুক্ষণ ছিলেন। তবে কার কাছে গেছেন বা কী কথা হয়েছে তা এখনো জানার বাইরে।
২৮ অক্টোবরের দিনকয়েক আগে প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান সৈয়দ আলতাফ হোসেনের গুলশানের বাসভবনে নৈশভোজ করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসসহ বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েক নেতা। আরো কয়েকটি দেশের কূটনীতিকসহ বিএনপি নেতা গয়েশ্বর রায়, বরকত উল্লাহ বুলু, আব্দুল আওয়াল মিন্টু, তাবিথ আউয়াল, ব্যারিস্টার মীর হেলাল উদ্দিন, ফজলুল হক মিলনের সঙ্গে ভোজে উপস্থিত ছিলেন একজন মন্ত্রীও। এ নিয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগের ঘরানায় বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। সময় ও ঘটনার পরম্পরায় এসব বিষয় আলোচিত। নইলে এ ধরনের লাঞ্চ-ডিনার আলোচনায় নাও আসতে পারত। রাষ্ট্রদূত পিটার হাসসহ দূতাবাসের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের ঘনিষ্ঠতা, মার্কিন চিকিৎসক এনে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা, আবার হরতালে ফিরে যাওয়াসহ সাম্প্রতিক নানা ঘটনায় সামগ্রিক পরিস্থিতিতে নতুন তাল-লয় লক্ষণীয়। অহিংস আন্দোলনের অঙ্গীকারের মাঝে তাদের আবার হরতালে ফেরা রাজনীতির মোটাদাগের ঘটনা। শনিবার টান টান উত্তেজনা থাকলেও সহিংসতার তেমন আলামত ছিল না। উত্তেজনার মধ্যেই প্রথমে একটি পাবলিক বাসে আক্রমণ। এরপর প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স-অডিট ভবনে আক্রমণ। পুলিশের অ্যাকশন, বিজিবি মোতায়েন। পুরো ঘটনাক্রমই নাটকীয়তায় ভরা।
বিএনপি কি আবার সহিংসতায় পা বাড়াচ্ছে? সবখানে ঘুরছে এ প্রশ্ন। বিএনপির একটি গ্রুপের বিশ্বাস পদযাত্রা-শোভাযাত্রা, রোডমার্চ, সমাবেশের মতো কুসুম কুসুম আন্দোলনে এ সরকারকে হটানো সম্ভব নয়। সরকারকে কোনো চাপেও ফেলা যাবে না। উপরন্তু এ ধরনের কর্মসূচি সরকারকে একতরফা নির্বাচনে উৎসাহিত করবে। তাই হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও ধরনের কর্মসূচির দিকে তাদের গরজ বেশি। কিন্তু দলের বেশির ভাগের সমীকরণ ভিন্ন। পশ্চিমা দেশগুলো সহিংসতা চায় না বলে মেসেজ আছে তাদের কাছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন বিএনপির কোন ধারাটি সামনে এগোবে তা বুঝতে অপেক্ষা করতে হবে। গতকাল থেকে তিনদিনের অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। সারাদেশ থেকে সহিংসতার খবরও আসছে।
২০১৩-১৪ সালে এ কর্মের ধারাবাহিকতা তারা ধরে রাখতে পারেনি। তাদের দমন-নিয়ন্ত্রণের পথঘাট সরকারের জানা। এরই মধ্যে নির্বাচনের কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন করতে চায় কমিশন। এর আগেই বিএনপি হরতাল-অবরোধের মতো বড় ধরনের কোনো আন্দোলনের কর্মসূচি দিলে সামনে নিশ্চয়ই ভালো কোনো পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে না। মানুষ হরতাল-সহিংসতা চায় না। এটি সরকারের জন্য সুযোগ। আবার হরতাল ছাড়া মাঠ গরম করার কড়া দাওয়াইও নেই। মানুষের মানসিকতা উপলব্ধি করে বিএনপি বহু দিন ধরে হরতালের তালে পড়ছে না। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে হরতাল শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকে। তুচ্ছ বা সামান্যতে হরতাল ডেকে এর আবেদন শেষ করে ফেলা হয়েছে অনেক আগেই। দেশব্যাপী হরতালের পাশাপাশি হয়েছে আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে হরতাল। আশির দশক থেকে বাংলাদেশে হরতালের তীব্রতা বেড়েছে।
হরতাল শব্দটি বাংলাভাষায় এসেছে গুজরাটি ভাষা থেকে। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধানে বলা হয়েছে ‘হরতাল [গুজরাটি শব্দ : হর (প্রত্যেক) + তাল (তোলা) অর্থাৎ প্রতি দরজায় তালা। শব্দের অর্থ- বিক্ষোভ প্রকাশের জন্য যানবাহন, হাটবাজার, দোকানপাট, অফিস আদালত প্রভৃতি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ করা।’ হরতাল বলতে কী বোঝায় তা শব্দের অর্থ থেকে খুবই স্পষ্ট। ইংরেজি ‘জেনারেল স্ট্রাইক’ বা ‘সাধারণ ধর্মঘট’ এবং হিস্ট্রি ‘বন্ধ’ শব্দকে হরতালের সমার্থক বলে ধরে নেয়া যায়। আদিতে হরতাল ছিল ব্যবসায়ীদের কারবার সংক্রান্ত দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে চাপ সৃষ্টি ও প্রতিবাদ প্রকাশের কৌশল হিসেবে দোকানপাট, গুদাম ঘর প্রভৃতি বন্ধ রাখা। ১৯২০-৩০-এর দশকে ভারতের রাজনীতিতে হরতাল নতুন মাত্রা যোগ করে। এ সময় মহাত্মা গান্ধী তার নিজ এলাকা গুজরাটে পরপর অনেক ব্রিটিশবিরোধী বনধ বা ধর্মঘটের ডাক দিয়ে হরতালকে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠারে রূপ দেন। বাংলাদেশে হরতাল জনগণের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের একটি সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত রাজনৈতিক পন্থা। কিন্তু অতি ব্যবহারে স্বীকৃতি তথা আবেদন হারানো হরতাল নামের অস্ত্রটির নতুন ব্যবহারে বিএনপি কোন পরিণতিতে পড়তে পারে, সেই অলোচনার বাজারও গরম।
যে কোনো ন্যায়ভিত্তিক সমাজেই সংঘবদ্ধভাবে ক্ষোভ প্রকাশের কতিপয় পথ ও পদ্ধতি থাকে, যদিও সেগুলো একেক সমাজে একেক রকম হতে পারে। নির্দিষ্ট দেশে সরকার পরিচালনার ধরনের ওপরও প্রতিবাদের ভাষা ও কৌশলসহ এসব পদ্ধতির হেরফের ঘটে। নবাবী সরকার পদ্ধতিতে দাবি-দাওয়া জানানোর জন্য আরজির ওপর অন্য কোনো পদ্ধতিতে দাবি-দাওয়া সরকার সহ্য করত না। আরজির মধ্য দিয়ে পরিচালিত আন্দোলনকে ক্ষুদ্র জমিদাররা নাম দিয়েছিল হুকুমত-ই-বায়াৎ, যার অর্থ খোদ সরকার ও তাদের মাঝামাঝি অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে গণমানুষকে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে হরতাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে অনেক হরতাল পালিত হয়েছে সরকারকে কোনো গৃহীত সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার বা সংশোধনের জন্য অথবা সরকারকে কোনো নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণে কিংবা দাবি মানতে বাধ্য করার জন্য। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইস্যুতেই জাতীয় পর্যায়ে হরতাল পালিত হয়েছে। অর্থনৈতিক ইস্যুতে হরতালের অনেকগুলোই জাতীয় বাজেটের প্রতিবাদে ডাকা হয়েছে। দমন পীড়নের প্রতিবাদেও অনেক হরতাল হয়েছে। আশির দশকে হরতাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে একটি বহুল ব্যবহৃত কৌশল হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিরোধী দলগুলো এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে (১৯৮২-৯১) ঘন ঘন হরতাল ডেকে প্রশাসনকে অকেজো করে দেয়। এর ধারাবাহিকতায় সরকারের পতনও ঘটে।
পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো খালেদা জিয়ার সরকারকে (১৯৯১-৯৬) উপর্যুপরি হরতালের মাধ্যমে তীব্র চাপে রাখে। শেখ হাসিনার প্রশাসনও (১৯৯৬-২০০১) হরতালের চাপ থেকে মুক্ত ছিল না। এর ধারাবাহিকতায় চারদলীয় জোট সরকারও (২০০১-২০০৬) হরতালের অস্ত্র থেকে রক্ষা পায়নি। নব্বইয়ের দশক থেকে ক্ষমতাসীন সরকারগুলো এবং জনগণের ব্যাপক অংশ হরতালকে খুব ভালো চোখে দেখে না। বাস্তবতার নিরিখে সময় ও স্থানভেদে এর ধরন ও পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটেছে। অহিংস-অনাগ্রাসী আন্দোলনেও যে মাঠ কাঁপানো যায় গত বছরখানেকে বিএনপি এর প্রমাণ রেখেছে। কিছু দৃষ্টান্তও তৈরি করেছে। এখন নতুন করে তারা কোন দৃষ্টান্তে পা দিচ্ছে, ভাবনার বিষয়।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়