ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৮ জনের, নতুন রোগী ১৭০৮

আগের সংবাদ

নির্বাচনের প্রস্তুতি চূড়ান্ত : ক্ষণগণনা শুরু > রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ইসির সাক্ষাৎ ৫ নভেম্বর > তফসিল ১৪ নভেম্বর, ভোট ৭ জানুয়ারি

পরের সংবাদ

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে প্রধান অন্তরায় ভূরাজনীতি

প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রোহিঙ্গা ইস্যুটি আঞ্চলিক সংকটের রূপ পরিগ্রহ করেছে। এতে এই অঞ্চলের অর্থনীতি, রাজনীতি ও নিরাপত্তায় এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। প্রতিবেশী বড় দুই দেশ ভারত ও চীন মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পর্ক না থাকায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। প্রাকৃতিক ও খনিজসম্পদ সমৃদ্ধ দেশটির ক্ষমতার প্রধান অংশীদার সেনাবাহিনী। আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর রয়েছে বহুমুখী প্রতিযোগিতা ও স্বার্থ। এছাড়াও ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও আদর্শগত দ্ব›দ্ব রয়েছে। কর্তৃত্ববাদী শাসন, ধর্মীয় নিধন ও প্রাকৃতিক সম্পদ এ সংকটের বিভিন্ন প্রবণতা তৈরি করেছে। এই বছরের আগস্ট মাসে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার ৬ বছর পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। তাদের প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা সর্বস্তরে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি করেছে। মানবপাচার ও মাদক চোরাচালানসহ আন্তঃসীমান্ত অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি এ পরিস্থিতি উগ্রবাদকেও ইন্ধন দিচ্ছে। এ সংকট দীর্ঘায়িত হতে থাকলে তা এই উপমহাদেশসহ বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
রাখাইনে রোহিঙ্গা সংকটে বিভিন্ন বিশ্লেষক জাতিগত সংঘাত কিংবা ধর্মীয় বিদ্বেষকে দায়ী করলেও সংকটের নেপথ্যে বহুমাত্রিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন রুশ বিশ্লেষকরা। এই সংকটের পশ্চাতে অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয় দুধরনের কারণই রয়েছে বলে তারা মনে করেন। বড় বড় ভূ-রাজনৈতিক ক্রীড়নকরা এর সঙ্গে জড়িত বলে তারা ধারণা করেন। ওই বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমারের মাটির নিচে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদ সংকটের ভিত্তিমূল। রুশ সংবাদমাধ্যম স্পুটনিকের রোহিঙ্গা সংকট সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ অব দ্য রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেসের সেন্টার ফর সাউথ ইস্ট এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং ওশেনিয়াবিষয়ক পরিচালক দিমিত্রি মোসিকায়ভ রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আরটিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, আন্তর্জাতিক ক্রীড়নকরা রোহিঙ্গা পরিস্থিতি আরো উসকে দিচ্ছে। মোসিয়াকভের মতে, রোহিঙ্গা সংকট অন্ততপক্ষে একটি ত্রিমাত্রিক ঘটনা। প্রথমত, এটি চীনবিরোধী একটি খেলা। কারণ আরাকানে (রাখাইন রাজ্য) চীনের বিশাল বিনিয়োগ আছে। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুসলিম উগ্রপন্থা ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে এমনটা করা হচ্ছে। তৃতীয়ত, আসিয়ানের মধ্যে অনৈক্য (মিয়ানমার ও মুসলিমপ্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মধ্যে অনৈক্য) তৈরি করার প্রচেষ্টা এটি।
মূলত চীন, ভারত ও রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক স্বার্থে মিয়ানমারে ব্যাপক পরিসরে বিনিয়োগ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে প্রধান অন্তরায়। এই সংকটকে দীর্ঘায়িত করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের প্রতি কোনো দেশের সমর্থন না থাকলেও এশিয়ার অন্যতম দুটি শক্তিধর রাষ্ট্র এবং মিয়ানমারের দুই বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত ও চীনের সমর্থন রয়েছে। ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চীনের কাছে মিয়ানমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। ২০১৩ সালে চীনের বিশ্বব্যাপী নতুন ভূকৌশলগত পরিকল্পনা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরের তীর অঞ্চল রাখাইন (পূর্বের আরাকান) অঞ্চল বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে। দেশটির প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায়, এর পরিমাণ আনুমানিক ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা সব পশ্চিমা দেশের মোট বিনিয়োগের দ্বিগুণেরও বেশি। যদিও মিয়ানমারে চীনের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ কৌশলগত কারণে খুব গোপন। শুধু গোলযোগপূর্ণ রাখাইনের সিতওয়ে শহরের ‘শয়ে’ গ্যাস ক্ষেত্রের গ্যাস সঞ্চালন (শয়ে থেকে কুনমিং হয়ে চীনের গোঞ্জেহ প্রদেশ) পাইপ লাইন নির্মাণ ও তার নিরাপত্তার জন্য সেনানিবাস তৈরি ও আধা সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প তৈরিতে বিনিয়োগ করেছে ২৫০ কোটি মার্কিন ডলার; যার সার্বিক দায়িত্বে রয়েছেন স্বয়ং মিয়ানমারের সেনাপ্রধান। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, চীন শুধু রাখাইনেই সব মিলিয়ে ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রকল্প চলমান রয়েছে।
ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারণে বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতও মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে। ভারতের স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলন দমন, করিডোর সুবিধা, ট্রান্সশিপমেন্ট প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করা হলেও মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন ১ হাজার ৬৪৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনরত তিনটি রাজ্য মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামের বিদ্রোহ দমন করতে মিয়ানমারের সহযোগিতা বিশেষভাবে প্রয়োজন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে সমর্থন না করে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ালে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন উত্তর রাখাইন যেহেতু ভারতের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাই ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে যে কোনো বিশৃঙ্খলা ভারতের জন্য সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং সম্ভাব্য বিশৃঙ্খলা মোকাবিলায় কৌশলগত কারণেই ভারত মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়া শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে ভøাদিমির পুতিন রাশিয়ার শাসনভার গ্রহণের পর দেশকে সোভিয়েত যুগে ফিরিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই রাশিয়া মিয়ানমারমুখী হয়েছে। মিয়ানমারের উচ্চশিক্ষার বাজার ধরতে এবং কৌশলে প্রভাব বিস্তার করার নীতি হিসেবে মিয়ানমারের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে রাশিয়া বিশেষভাবে অবদান রাখছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৩-২০১৩ সাল পর্যন্ত ৪ হাজার ৭০৫ জন শিক্ষার্থী রাশিয়ায় উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করেছেন; যাদের ৭০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেছেন কেবল পারমাণবিক বিদ্যায়। তাছাড়া রাশিয়ার সরকার মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে দীর্ঘদিন ধরেই উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। ২০১৫ সালে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক অবরোধ উঠে গেলে রাশিয়া দেশটিতে বিনিয়োগ ও অস্ত্র বিক্রির উদ্যোগ গ্রহণ করে। ওই বছরই ৩০ বছর ধরে মিয়ানমারের অস্ত্র বাজারে চীনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রাশিয়া ভাগ বসায়। সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণ, নবপ্রযুক্তি ও প্রজন্মের অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধকরণ এবং বিমানবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও স্বাধীনতাকামী আন্দোলন দমাতে বিমানবাহিনীর সহযোগিতা নেয়া ইত্যাদি বহুবিধ কারণেই মিয়ানমার রাশিয়ার অস্ত্রের প্রতি মনোযোগ দেয়।
‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর গবেষণা প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ১৯৮৮-২০০৬ সাল পর্যন্ত কেবল রাশিয়ার কাছ থেকে মিয়ানমার কমপক্ষে ৩৯ কোটি ৬০ লাখ ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে। অর্থের হিসেবে রাশিয়া মিয়ানমারের দ্বিতীয় অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। এ অবস্থানটি একচেটিয়া করতেই রাশিয়া মরিয়া হয়ে উঠেছে। রাশিয়া শুধু মিয়ানমারের অস্ত্রের বাজারের দিকেই নজর দিয়েছে এমন নয়, বরং বিনিয়োগে অর্থ সহায়তা এবং প্রযুক্তি রপ্তানির দিকেও বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। এ লক্ষ্যে রাশিয়া মিয়ানমারের দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির চুক্তি করে ২০১৩ সালে, যার কাজ এরই মধ্যে চলছে। এছাড়া দেশটির বিপুল খনিজ সম্পদ বিশেষ করে তেল ও গ্যাস আহরণে রাশিয়া এরই মধ্যে মিয়ানমারে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। মিয়ানমারের তেল-গ্যাসের ভাণ্ডারের মুনাফায় নিজের আধিপত্য রাখতে রাশিয়ার সরকারি কোম্পানি ‘গাজপ্রম’ রাজধানী ইয়াঙ্গুনে একটি অফিসও খুলেছে। তাই রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করার প্রতিযোগিতায় রাশিয়া কিছুতেই পিছিয়ে পড়তে চাইবে না।
রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যে নির্যাতন চালিয়েছে, তা মানবতাবিরোধী অপরাধ। বিশ্বনেতাদের বুঝতে হবে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নয়, মিয়ানমারের নাগরিক। আর তাদের নিরাপদে ফেরাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের নিরাপদ, টেকসই ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরিতে দ্বিপক্ষীয়, ত্রিপক্ষীয় এবং জাতিসংঘসহ অন্য অংশীজনদের নিয়ে আলোচনা সত্ত্বেও তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানো যায়নি। মিয়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে আরো দুরূহ করে তুলেছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকার পাশাপাশি বিশ্বনেতাদের এগিয়ে আসতে হবে।

ড. মো. মোরশেদুল আলম : শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়