র‌্যাব হেফাজতে নারীর মৃত্যু : কমিটির প্রতিবেদনে সন্তুষ্ট নন হাইকোর্ট

আগের সংবাদ

রাজপথে ফের শক্তির মহড়া : নাশকতা মোকাবিলায় সতর্ক পাহারায় আ.লীগ, মহাসমাবেশের ঘোষণা দেবে বিএনপি

পরের সংবাদ

খেলাপি কমবে কোন পথে! পুনঃতফসিলকৃত ঋণ ফের খেলাপি হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর ভূমিকা চান অর্থনীতিবিদরা

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : খেলাপি ঋণের লাগাম কোনোভাবেই টেনে ধরা যাচ্ছে না, উল্টো বাড়ছে। বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের ওপরে ছাড়িয়ে গেছে। খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। কী কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে, তা জানতে চেয়েছে সংস্থাটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পুনঃতফসিলকৃত ঋণগুলো আবার খেলাপি হচ্ছে। তাই খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে। সুশাসনের ঘাটতির ফলেই এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যে কারণে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর ভূমিকার প্রয়োজনীয়তার প্রতি তাগিদ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। নাহলে পরিস্থিতি আরো ভঙ্গুরতার দিকে এগোবে বলে মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী এ নিয়ে ভোরের কাগজকে বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খেলাপি ঋণও বিশাল আকার ধারণে করেছে। বর্তমানে যা অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এজন্য প্রথমেই একটি দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ দৃঢ় সিদ্ধান্ত না থাকলে কোনো কাজ বাস্তবায়ন সহজে হয় না। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, অতীতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকার সবাই সচেষ্ট ছিল। সময়ে সময়ে বিভিন্ন ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো কখনোই সফলতার মুখ দেখেনি। বরং একটু একটু করে বিশাল আকার ধারণ করেছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে- খেলাপি এখনো বেড়েই চলেছে, বন্ধ করা যাচ্ছে না। ড. মুজেরী বলেন, ঋণখেলাপিরা প্রভাবশালী হওয়ার কারণে আমরা বিভিন্ন সময়ে খেলাপি কম দেখাতে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিরবর্তন করেছি। ঋণখেলাপিদের বিভিন্নভাবে সুবিধা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়গুলো এখন এড়িয়ে যেতে হবে। যদিও বর্তমান সময়ে এটা কতখানি সম্ভব হবে সেটা দেখার বিষয়।
তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে হলে কঠোর হস্তে দুটি ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথমত, নতুন করে খেলাপি ঋণ না বাড়ে অর্থাৎ নতুন ঋণগুলো যেন আর খেলাপি না হয়, সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, পুরনো খেলাপি ঋণগুলো উদ্ধারের ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক-উভয়কেই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোতে যারা পরিচালক আছেন, তাদের বেশির ভাগ সরকারি কর্মকর্তা। তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি পেশাদার ব্যাংকারদের দিয়ে এসব ব্যাংক চালাতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেয়া বন্ধ করে দিতে হবে। তাহলেই এসব ব্যাংক শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত এপ্রিল-জুন সময়েই দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ফলে জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায়। এ খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট

ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা।
জানা যায়, দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। চলতি বছরের জুন শেষে এ ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ২৫ শতাংশই খেলাপির খাতায় উঠেছে। গত ডিসেম্বর শেষেও এ ব্যাংকগুলোর খেলাপির হার ২০ শতাশের নিচে ছিল। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর মূলধন কাঠামো আরো ভঙ্গুর হয়েছে। বেড়েছে ব্যাংকগুলোর সঞ্চিতি (প্রভিশন) ঘাটতির পরিমাণও। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সম্পদের বিপরীতে আয় (আরওএ) এবং ইকুইটির বিপরীতে আয়ও (আরওই) নেতিবাচক (ঋণাত্মক) ধারায় চলে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে সরকার মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর দীনতার এ চিত্র উঠে এসেছে। তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে সরকারি ছয়টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৪ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এছাড়া দেশের ব্যাংক খাতের জন্য অনুসরণীয় ব্যাসেল-৩-এর মানদণ্ড অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের ন্যূনতম হারও (সিআরএআর) এ ব্যাংকগুলো রাখতে পারছে না। খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতিও রাখতে পারেনি ব্যাংকগুলো। এ ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ১১ শতাংশের কোনো সুরক্ষাকবচ নেই।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের ব্যাংক খাতে সুশাসনের সংকট রয়েছে। আইন থাকলেও এখানে তার কোনো প্রয়োগ নেই। ফলে আর্থিক সংকট আরো গভীর হয়েছে। একের পর এক নীতি সহায়তা দিয়ে এতদিন ভালো গ্রাহকদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ। সুবিধা দিয়েও যেহেতু কাজ হচ্ছে না এখন সব ধরনের সুবিধা বন্ধ করে দিয়ে কঠোর আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
খেলাপিদের বিশেষ ছাড় বন্ধ না হলে খেলাপি ঋণ কমবে না বলে জানিয়েছেন অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, খাতা কলমে দেখানো হচ্ছে এক লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে এ অঙ্ক অনেক বেশি। কারণ এখানে পুনঃতফসিল ও পুনঃগঠন করা ঋণের হিসাব নেই, এগুলো যোগ করলে আড়াই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তিনি জানান, খেলাপি ঋণ ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকা মানে ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে। এতে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমবে, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে। সর্বোপরি দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেয়ার সময় বলেছিলেন, দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আর বাড়বে না। তার এ কথার পর বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে খেলাপি ঋণ দীর্ঘদিন একটি সীমার মধ্যে বেঁধে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু দেশের আর্থিক পরিস্থিতির অবনতির প্রেক্ষাপটে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার ধারাকে থামিয়ে রাখা যায়নি। এতে ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আর এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল নীতিকেই দায়ী করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে তথ্য দিয়েছে, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। তারা বলছে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো বেশি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আইএমএফের প্রতিনিধি দলের বৈঠকে এসব বিষয় উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, আইএমএফ তাদের প্রকাশিত খেলাপি ঋণের তথ্য নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছে। এক্ষেত্রে প্রকাশিত তথ্যকে কাগুজে তথ্য হিসেবে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
কেন্দ্রীয় কেন্দ্রের দুর্বলতা কোথায় : স¤প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক গেøাবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিনের র‌্যাংকিংয়ে ‘ডি’ গ্রেড পেয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হারের সুরক্ষা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুসংহত করার মতো বিষয়গুলোতে অবনতি হওয়ায় তাকে নি¤œ গ্রেড দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারের ৬০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণের কারণে নাজুক অবস্থানে পড়ে যায় বাংলাদেশ। অর্থাৎ গভর্নরের সাফল্য-ব্যর্থতার অনেক কিছুই নির্ভর করছে সরকারের দেয়া নীতি ও সিদ্ধান্তের ওপর। এছাড়া কিছু অসাধু কর্মকর্তার অনৈতিক সুবিধাগ্রহণ কিংবা বোর্ড সদস্যদের সাহসী ভূমিকা পালনে ব্যর্থতাও অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়