বাংলাদেশের সঙ্গে ফ্লাইট চালু করতে আগ্রহী মিয়ানমার

আগের সংবাদ

খেলাপি কমবে কোন পথে! পুনঃতফসিলকৃত ঋণ ফের খেলাপি হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর ভূমিকা চান অর্থনীতিবিদরা

পরের সংবাদ

পানি জীবন পানিই খাদ্য

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আজ বিশ্ব খাদ্য দিবস। এবারের দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে
পানি জীবন, পানিই খাদ্য কেউ থাকবে না পিছিয়ে। পানি শুধু আমাদের তৃষ্ণাই মেটায় না, প্রতিদিন আমাদের যে পরিমাণ ক্যালরি খরচ হয় এর ৮০ শতাংশই পূরণ করে পানি। সারাদিন আমরা যত ধরনের খাবার খাই, তার মধ্যে একমাত্র পানিই ক্যালরি, ফ্যাট, শর্করা ও চিনিমুক্ত থাকে। আমাদের জীবদেহ গঠনের একক ‘কোষ’-এর প্রোটোপ্লাজমের ৯০ শতাংশ পানি দিয়ে তৈরি। যদি কোনো কারণে দেহে পানির অভাব হয়, তাহলে এই প্রোটোপ্লাজমগুলো কুঁচকে যায় এবং নষ্ট হয়ে যায়। বিপাকীয় কাজগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে, জীব মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। দীর্ঘমেয়াদে পানির অপর্যাপ্ততা নানা জটিলতার সৃষ্টি করে। পর্যাপ্ত পানি পান না করলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই কারণে পানিকে ঋষঁরফং ড়ভ ষরাবং বা পানির অপর নাম জীবন বলা হয়ে থাকে। তাপ সঞ্চালন, পৃষ্ঠের টান, উচ্চ ফুটন্ত, গলনাঙ্ক এবং আলোকে প্রবেশ করতে দেয়ার ক্ষমতা পানির অন্যান্য বৈশিষ্ট্য। শক্তি উৎপাদনে পানির প্রয়োজন, আবার পানি সরবরাহের জন্য প্রয়োজন শক্তি। বর্তমানে পৃথিবীর ১৬ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় পানি প্রকল্প থেকে। এছাড়া ৮০ শতাংশ শক্তি উৎপন্ন হয় তাপবিদ্যুৎ থেকে, যা পানি ছাড়া সম্ভব নয়।
ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদা মিটাতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ছে। বাংলাদেশে কৃষি কাজে ব্যবহৃত মোট ৭৮ শতাংশ পানি হচ্ছে ভূগর্ভস্থ। বিএডিসির গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার পানির স্তর সমুদ্রপৃষ্ঠের ১৬০ ফুট নিচে নেমে গেছে। বাংলাদেশের ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৭০ ভাগ অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ মিটার উচ্চতার মধ্যে অবস্থিত। এতে বন্যার আশঙ্কা প্রবল, যার প্রভাবে প্রায় ৩ হাজার মিলিয়ন হেক্টর জমি স্থায়ীভাবে হারিয়ে যেতে পারে এবং সার্বিক উৎপাদন প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে। উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে লবণাক্ততা আর উত্তরের জেলাগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদের পানি সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিস্তা ও ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ক্রমবর্ধমান মরুকরণের দিকে ধাবিত হওয়ার মূল কারণ। পানির অভাবে সেসব অঞ্চলে চাষাবাদের ধরনও পরিবর্তন হয়েছে।
পানির সংকট একটি বৈশ্বিক সংকট। পরিবেশ বিপর্যয়, বিশ্বায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত শিল্পায়ন, নগরায়ণ, পানিদূষণ ও অপচয় হলো পানি সংকটের অন্যতম কারণ। এছাড়া যথাযথ অবকাঠামোর অভাব এবং জোরপূর্বক অভিবাসন বা শরণার্থী সংকটও পানি সংকটের জন্য দায়ী। মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে এ সংকট। ওয়াটার এইডের গবেষণা মতে, সুপেয় পানি পাচ্ছে না দেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। নিরাপদ পানির অধিকারবঞ্চিত বিপুল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই চরম দরিদ্র। সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে নারী ও শিশুরা। ২০৩৫ সালে বিশ্বে পানির চাহিদা ৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৫০ সালে চরম পানি সংকটে পড়বে বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষ। এত বিপুল চাহিদার জোগান নিয়ে আতঙ্কে আছে উন্নত বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়া তাদের জ¦ালানি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পানির সংকটে পড়তে পারে।
ক্রমবর্ধমান পানির সংকট বিশ্বব্যাপী চরম অস্থিরতার সৃষ্টি করতে পারে। বিজ্ঞানীরা পানির সংকটের পেছনের প্রধান কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে আখ্যায়িত করেছেন। মেরু অঞ্চলে জমে থাকা বরফের স্তূপ গলে সমদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে লোনাপানির প্রবেশ বাড়ছে। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক, পারদ, লোহা, ক্রোমিয়াম, নাইট্রেট, ফ্লোরাইড ও অন্যান্য ধাতব পদার্থ ও দূষক ইত্যাদিও বিশুদ্ধ পানি সংকটের অন্যতম কারণ। বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে সংকট সমাধানে পুরো বিশ্বে পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে চিন্তার সময় এখনই। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নিতে হবে, নয়তো অচিরেই বিশ্ব এমন এক ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হবে যেখানে বন্দুক, মিসাইল কিংবা পারমাণবিক বোমা নয়, পানিই হবে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
জলবায়ুবিষয়ক জাতিসংঘের প্যানেলের গবেষণা বলছে, প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য ২০ শতাংশ বিশুদ্ধ পানি কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি সংস্থাটি সারাবিশ্বের জন্য অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে সুপেয় ও বিশুদ্ধ পানির স্বল্পতাকে। লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় পানির প্রবল ঘাটতি আঞ্চলিক সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে। আমেরিকার ওয়াটার ওয়ার্কাস অ্যাসোসিয়েশন তাদের সর্বশেষ গবেষণায় জানিয়েছে, মধ্যপ্রাাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার সাম্প্রতিক অস্থিরতার পেছনে রয়েছে পানিসম্পদের বিপর্যয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে দেশে পানির স্বল্পতা ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিবাদ বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে এবং এ কারণে নিরাপদ সুপেয় পানি প্রাপ্তি হবে আগামী বিশ্বের বড় চ্যালেঞ্জ। সুপেয় পানির পরিমাণই যেখানে দিনকে দিন কমছে, সেখানে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো এই নির্দিষ্ট পরিমাণ পানিসম্পদের জন্য লড়বেন শিগগিরই, সেটা নিশ্চিত।
পানি ব্যবহারের গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ব্যবস্থা হচ্ছে পানির পুনঃব্যবহার এবং সমুদ্রের পানি নির্লবণীকরণ। এই পদ্ধতি বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের কাতার, ইসরায়েলসহ আরো অনেক দেশ সমুদ্র থেকে লবণ পানি তুলে পরিশোধন করে নিয়ন্ত্রিত চাষাবাদ করছে। জাপানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য দুই ধরনের পানি ব্যবহার করে। সেখানে সরকারি বিধান অনুযায়ী সব আবাসিক-অনাবাসিক, সরকারি-বেসরকারি ভবনে পানীয় পানির জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হয় এবং অন্যান্য ব্যবহারের জন্য অপর লাইনে ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করা হয়। অনেক ভবনে ব্যবহৃত ভূপৃষ্ঠের পানি ফিল্টার করে পুনঃব্যবহার করার ব্যবস্থা থাকে। এছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে, ফিল্টার করে পানীয় পানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৬ নম্বরটি সুপেয় পানি নিয়ে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করার জন্য বলা হয়েছে। বৈশ্বিক পানি সংকট মোকাবিলা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য পানি, খাদ্য ও পরিবেশগত নিরাপত্তা অর্জন ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ নিরাপদ পানি প্রাাপ্তিকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করার পরও বিশ্বের ৭৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষ এ সুবিধা থেকে এখনো বঞ্চিত আর বাংলাদেশে এ সংখ্যা ২ কোটি ৬০ লাখ। অনিরাপদ পানীয়জলের কারণে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক শিশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, নিরাপদ পানির সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দুই-তৃতীয়াংশের বসবাস ১০টি দেশে, যার মধ্যে চীন, ভারত, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তানজানিয়া, পাকিস্তান, কেনিয়া ও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য।
পানি ছাড়া মানব অস্তিত্ব অসম্ভব। আন্তর্জাতিক আদালত ও বিভিন্ন দেশের স্থানীয় আদালত পানিকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জলবায়ু সংকট আরো প্রবল হলে বৈশ্বিক সুপেয় পানির সংকট আরো বহু গুণে বেড়ে যাবে। দেশের কাক্সিক্ষত টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিশুদ্ধ পানির অধিকার প্রতিষ্ঠায় এখন থেকে পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানি শুধু পানীয় পানি হিসেবেই ব্যবহার করা উচিত। বৃষ্টিপ্রধান এ দেশে বর্ষা মৌসুমে পানিকে অবশ্যই ধরে রাখার পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। জনসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনকে এসব উদ্যোগের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। বিশুদ্ধ পানির উৎসগুলো রক্ষা এবং জনগণকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের অঙ্গীকার সামনে রেখে সরকারকে আগামী দিনের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে প্রয়োজন পানির টেকসই ব্যবহার।

ড. মো. আল-মামুন : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়