সৌদি ভিসা প্রসেসিং কেন্দ্র : ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে না পারায় বিক্ষোভ

আগের সংবাদ

অস্থিরতার মূলে ডলার সংকট : ডলার মিলছে না ব্যাংক কিংবা খোলাবাজারে, দামে লাগাম টানতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক

পরের সংবাদ

উদ্বাস্তু হয়েছিলেন প্রথমবার প্রাণ দিলেন দ্বিতীয়বারে

প্রকাশিত: অক্টোবর ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহার পূর্ববঙ্গে আসার কথা ছিল না। জন্ম তার পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়াতে, শৈশব ও কৈশোর কেটেছে সেখানেই; ১৯৫০ সালে ঢাকায় চলে আসেন উদ্বাস্তু হয়ে। পড়ার কথা ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে; সেখানে না গিয়ে ঢাকায় এসে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটা ঘটেছিল ১৯৪৭-এর স্বাধীনতার নামে দেশভাগের কারণে। বাংলার ও বাঙালির জীবনে মস্ত বড় একটা ট্র্যাজেডি ঘটেছিল ১৭৫৭-তে, পরবর্তী ট্র্যাজেডি ১৯৪৭-এর দেশভাগ। শামসুজ্জোহারা সাতচল্লিশেও উদ্বাস্তু হননি, রয়ে গিয়েছিলেন জন্মভূমিতেই, কিন্তু ১৯৫০-এ আর পারেননি। ওই বছর ভয়ংকর এক দাঙ্গা হয়, ওপারে এবং এপারেও। তখন অনেক পরিবারই স্থায়ী আবাস ত্যাগ করে এপার থেকে ওপারে চলে যায়, ওপার থেকে এপারে আসে বাধ্য হয়ে। সাতচল্লিশের স্বাধীনতা যে মুক্তি আনেনি, পূর্ববঙ্গবাসীর পক্ষে সেটা বুঝতে কিন্তু খুব বেশি সময় লাগেনি। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের আবশ্যকতা এই সত্যকে উন্মোচিত করে দিয়েছিল, নতুন রাষ্ট্রে শাসনের ধরনটা হবে উপনিবেশিক, অবাঙালি একটি বিশেষ গোষ্ঠী পূর্ববঙ্গকে উপনিবেশে পরিণত করতে তৎপর হবে। শামসুজ্জোহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েছেন ১৯৫০-এ, ১৯৫২-তে তিনি যোগ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। সে জন্য অন্য কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে তারও কারাবাস ঘটেছিল, সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হলেও।
বায়ান্নর পরে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হয়েছে চুয়ান্নতে, কিন্তু তারপরই চলে এসেছে প্রত্যক্ষ সামরিক শাসন। সেই শাসনে উন্নতি যা ঘটবার তার প্রায় সবটাই ঘটেছে পশ্চিম পাকিস্তানে। শাসনের নামে পূর্ব পাকিস্তান শোষিত হয়েছে এবং পূর্ব থেকে সম্পদের পাচার ঘটেছে পশ্চিমে। আইয়ুব খান শাসন করেছেন ১০ বছর ধরে, আরো কিছুকাল করবেন বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল তার দুঃশাসনে। তিনি উন্নয়ন ঘটাচ্ছিলেন ঠিকই, কিন্তু সে উন্নয়নের চরিত্রটা ছিল পুরোপুরি পুঁজিবাদী; তাতে উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল বৈষম্য। পূর্বে এবং পশ্চিমে- উভয় অংশেই মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। পরিণতিতে অনিবার্যভাবেই ঘটেছে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। অভ্যুত্থান পূর্ব পাকিস্তানে হয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তানেও হয়েছে। কিন্তু দুই অঞ্চলের অভ্যুত্থানের ভেতর একটা মৌলিক পার্থক্য ছিল। পশ্চিমের মানুষ লড়ছিল স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে, পূর্বের লড়াইটা ছিল শুধু স্বৈরশাসন নয়, আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধেও। ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ববঙ্গের দাবিটা ছিল পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান সেই দাবিকে স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত করে।
পূর্ববঙ্গের সংগ্রামটা তাই ছিল আরো গভীর ও ব্যাপ্ত। আন্দোলন তুমুল হয়ে ওঠে। আইয়ুব খান নত হতে বাধ্য হন, ছাড় দিতে সম্মত হন; কিন্তু তাতে আন্দোলন থামেনি। জানুয়ারিতে শুরু হয়ে আন্দোলন ফেব্রুয়ারিতেই চরম আকার ধারণ করে। ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে সেনাসদস্যদের গুলিতে শহীদ হন আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক, ১৬ তারিখে পল্টল ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানী ঘোষণা দেন যে জনগণ প্রয়োজনে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে শেখ মুজিবকে মুক্ত করবে এবং ক্যান্টনমেন্টের দশা হবে ফরাসি বিপ্লবের সময়ে বাস্তিল দুর্গের মতো। সরকার প্রায় সব শহরেই ১৪৪ ধারা এবং কোথাও কোথাও কার্ফু জারি করে। ১৭ তারিখের রাতের বেলা ঢাকায় মানুষ সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণকে উপেক্ষা করে এবং কার্ফু ভঙ্গ করে বেরিয়ে আসে। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে ছাত্ররা তাদের বিক্ষোভকে তীব্রতর করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সদর রাস্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল। সদর রাস্তায় বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেনাবাহিনীর লোকরা।
ড. জোহা তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং প্রক্টর। তিনি তো ছাত্রদের সঙ্গেই থাকতেন, থাকাটা পছন্দ করতেন; প্রক্টর হিসেবে তিনি ছাত্রদের নিরাপত্তার কথা ভাবতেন; তদুপরি ছাত্রদের ওই সংগ্রামের প্রতি তার ছিল পূর্ণ সমর্থন; বায়ান্নতে তো তিনি নিজেই ছিলেন ভাষাসংগ্রামী। ১৮ ফেব্রুয়ারির ওই দুপুরে পরিস্থিতির ভয়াবহ সংকটজনক অবস্থা দেখে তিনি বুঝেছেন সেনা সদস্যদের উদ্যত সঙ্গিনের হাত থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করাটা তার কর্তব্য এবং সেই কর্তব্যপালনে তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। অকুতোভয়ে নিরস্ত্র বিক্ষুব্ধ ছাত্র এবং গুলিবর্ষণে প্রস্তুত বন্দুকধারীদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। বন্দুকধারীদের তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে জানিয়েছেন, ছাত্রদের তিনি ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন; ছাত্রদেরও বলেছেন আপাতত ফিরে যেতে। শিক্ষার্থীরা তার কথা শুনবে মনে হচ্ছিল, কিন্তু বন্দুকধারীরা শোনেনি। তারা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করেছে এবং গুলি করেই শান্ত হয়নি, মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়েছে। শুধু শিক্ষার্থীদের রক্তপাতই সেই সময়ে ঘটেনি, তাদের সবার এবং পূর্ববঙ্গবাসী মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে প্রাণ দিয়েছিলেন ড. শামসুজ্জোহাও। পাকিস্তান রাষ্ট্রের নৃশংস চরিত্রের আরো একটি উন্মোচন সেই মুহূর্তে ঘটেছিল।
ড. জোহার প্রাণদানের ঘটনা বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পড়ে এবং উত্তপ্ত বাংলাদেশ আরো তপ্ত হয়ে ওঠে; অনিবার্য হয়ে যায় আইয়ুব খানের পতন। মনে পড়ে, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও দেশের সব মানুষের মতোই ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের দিক থেকে একটি অতিরিক্ত ক্ষোভ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন-হরণ। ব্রিটিশ আমলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেটুকু স্বায়ত্তশাসনের অধিকারী ছিল, আইয়ুব খান সেটুকুও কেড়ে নিয়েছিলেন। পাকিস্তানজুড়েই তাই শিক্ষকদের বিক্ষোভ প্রদর্শন চলছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল কিছুটা এগিয়ে। সে সময়ে আমরা সভা করেছি, এমনকি রাস্তায় মিছিল পর্যন্ত করেছি। ড. জোহার প্রাণদানের পর স্বতঃস্ফূর্তভাবেই দাবি উঠেছিল, ১৭ ফেব্রুয়ারিকে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনের। ১৯৬২ সালের শিক্ষার্থীদের সংগ্রাম থেকে যেভাবে বের হয়ে এসেছিল ১৭ সেপ্টেম্বরকে ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত, আমাদেরও তেমনি সিদ্ধান্ত ছিল ১৮ ফেব্রুয়ারিকে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করার। আমার মনে আছে, ১৯ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ভবনে ড. জোহাকে স্মরণ করে আমরা সভা করেছিলাম। সে সময়ে প্রফেসর আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ ছিলেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং ঘটনাক্রমে আমি ছিলাম ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। একাত্তরের ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনী যে আক্রমণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তুর একটি হিসেবে স্থির করেছিল, তার কারণ শুধু যে শিক্ষার্থীরা ছিল তা নয়, কারণ ছিলাম আমরা শিক্ষকরাও।

দুই.
ড. জোহা এসেছিলেন উদ্বাস্তু হয়ে। ১৯৫০-এর দাঙ্গার কারণে ও কালে বহু পরিবারকে উৎপাটিত হয়ে শরণার্থী হিসেবে সীমান্ত পারাপার করতে হয়েছে। আমার মনে আছে, আমরা তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছি। পরীক্ষার হলে গিয়ে শুনলাম, বেশ কয়েকজন সহপাঠী পরীক্ষা দিচ্ছে না। দিতে পারবে না। প্রাণভয়ে তারা ওপারে চলে গেছে। প্রশান্তর কথা মনে পড়ে। প্রশান্ত পরীক্ষা দিতে এসেছিল; কিন্তু জানা গেল, তারাও চলে গিয়েছিল। নবাবপুর রোডে ওদের ওষুধের দোকান ছিল, হয়তো সেটাও বিক্রির বা বিনিময়ের পারিবারিক সিদ্ধান্ত ছিল তাদের। বন্ধু প্রশান্তের মুখের উদ্বেগ ও বিষণ্নতা ভুলতে পারি না। পরীক্ষা দিতে গিয়ে আমরা সবাই তো ছিলাম উদ্বিগ্ন, কিন্তু বংশানুক্রমে ঢাকা শহরে বসবাসকারী প্রশান্তের মুখে অতিরিক্ত যা ছিল, তা হলো মলিন এক বিষণ্নতা। আমাদের পরিবারটিও ঢাকায় এসেছিল কলকাতা থেকে, কিন্তু আমরা উদ্বাস্তু ছিলাম না; কারণ নদীর ওপারে গ্রামে ছিল আমাদের পারিবারিক বংশানুক্রমিক নিবাস এবং ঢাকা শহরেও আত্মীয়স্বজন ছিল। কিন্তু ঢাকাবাসী প্রশান্তরা তো চলে যাচ্ছিল নির্বাসনে।
নির্বাসনের ব্যাপারটা অত্যন্ত অধিক পরিমাণে সত্য ড. জোহাদের ক্ষেত্রে। তারা ছিলেন নিম্নমধ্যবিত্ত; এমন কোনো বিষয়সম্পত্তি ছিল না, যা বিক্রি বা বিনিময় করবেন। ঢাকায় তারা এসেছেন একেবারেই অসহায় অবস্থায়। পরিবারের আয় সীমিত, পিতা সরকারি চাকরি করতেন, অবসরে গেছেন; ঢাকায় থাকার কোনো জায়গা নেই। শামসুজ্জোহার পক্ষে তাই বিষণ্ন, বিব্রত ও নত হয়ে থাকাটা হতো স্বাভাবিক। কিন্তু তা তিনি মোটেই ছিলেন না। আমার দুই বছরের আগের ছাত্র ছিলেন তিনি, দুজনের কেউই আবাসিক ছাত্র ছিলাম না; দেখা-সাক্ষাৎ তাই বড় একটা ঘটেনি। কিন্তু অল্প যে কয়বার হয়েছে, তখন তাকে কখনোই বিষণ্ন দেখিনি। আমার বিশেষভাবে মনে পড়ে, ১৯৫০-৫১ সালের ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হল বার্ষিকী’তে একটি গ্রুপ ছবিতে তার বসবার ভঙ্গি ও মুখচ্ছবিটি। বার্ষিকীটির ওই সংখ্যাতে আমার একটি লেখা ছাপা হয়েছিল; প্রথম জীবনের লেখা, তাই বার্ষিকীর একটি কপি সযতেœ রক্ষা করেছিলাম, এখনো আছে আমার সংগ্রহে এবং ড. জোহা সম্পর্কে এই লেখাটি তৈরি করতে গিয়ে ওই ছবিটিতে একবার চোখ বুলিয়েও নিলাম, দেখতে পেলাম আবার সেই মানুষটিকে; সংযত কিন্তু প্রাণবন্ত। গ্রুপ ছবিটি হলের ফুটবল টিমের, সেই টিমের নামকরা জাঁদরেল খেলোয়াড় ছিলেন শামসুজ্জোহা। ভালো ছাত্র এবং ভালো খেলোয়াড়, এমন সংযুক্তি সচরাচর ঘটে না; শামসুজ্জোহার ক্ষেত্রে সেটি ঘটেছিল। ভালো ছাত্র যে ছিলেন, সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি পিএইচডি করেছেন বিলেতের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে। তার লেখা গবেষণাপত্র গুরুত্বপূর্ণ জার্নালে ছাপা হয়েছে। প্রত্যক্ষভাবে ছাত্র-রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না; কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ছিলেন এবং একবার আটকও হয়েছিলেন, যে কথা উল্লেখ করেছি। আর তার ওঠাবসা যে ছিল বামপন্থিদের সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে, সেটাও ছিল স্বাভাবিক। এবং তাৎপর্যপূর্ণও বৈকি।
খেললে খেলোয়াড় হওয়া যায়, কিন্তু খেলোয়াড় মাত্রই যে খেলোয়াড়ি মনোভাবসম্পন্ন হবেন, এমন কোনো বিধান তো নেই। খেলোয়াড়ি মনোভাবসম্পন্ন যারা তাদের গুণ সংযত, প্রাণবন্ততা, দায়িত্বজ্ঞান, কর্তব্যপরায়ণতা ও মিলেমিশে কাজ করার সামাজিকতা। এই গুণগুলোর প্রতিটি ড. জোহার মধ্যে ছিল। তিনি প্রাণবন্ত ছিলেন, ছিলেন দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন, কর্তব্যপরায়ণ এবং সামাজিক। ওই যে তিনি নির্ভয়ে একা গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন গুলি করতে উন্মুখ পাকিস্তানি সেনাদের সামনে, তাতে ওই গুণগুলোর সব কটিরই প্রকাশ দেখি। তিনি মাঠে ছিলেন, নিজের দায়িত্ব জানতেন, কর্তব্যপালন থেকে এক পাও পিছিয়ে যাননি। শিক্ষার্থীদের তিনি একান্ত আপনজন বলে জানতেন, যে জন্য বিপদ থেকে তাদের উদ্ধার করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। ভয় পাননি। নির্ভয়ে প্রাণ দিয়েছেন।

তিন.
ঊনসত্তরের পথ ধরেই তো একাত্তর এলো। সাতচল্লিশের স্বাধীনতা শামসুজ্জোহাদের বাস্তুচ্যুত করেছিল। ওই স্বাধীনতা ছিল অসম্পূর্ণ; রাষ্ট্র ছিল বিকৃত ও অমানবিক। এককথায় সাতচল্লিশের স্বাধীনতা মানুষকে মুক্তি দেয়নি। বরং নতুনভাবে বন্দি করেছে। মুক্তির আন্দোলন তাই এগিয়েছে। এসেছে ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানে ছাত্ররা ছিল সামনে, কিন্তু যোগ দিয়েছিল সর্বস্তরের মানুষ। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আসাদ, ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা। ঊনসত্তরের পরে আরো বড় ঘটনা, অনেক বড় ঘটনা, একাত্তরের গণহত্যা ও যুদ্ধ। হানাদারদের দিক থেকে গণহত্যা; আমাদের দিক থেকে প্রতিরোধের যুদ্ধ।
কিন্তু মুক্তি এসেছে কি? না, আসেনি। কেউই বলবে না, মুক্তি এসেছে। মুক্তির জন্য সমাজতান্ত্রিক না হোক, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা তো আবশ্যক ছিল। সে গণতন্ত্র কেবল সংসদীয় গণতন্ত্র নয়, তারও অধিক। কাক্সিক্ষত সেই গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন ছিল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ; সমাজ ও রাষ্ট্রের স্তরগুলোতে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব এবং সর্বোপরি নাগরিকদের ভেতর অধিকার ও সুযোগের সাম্য। এগুলোর কোনোটিই পাওয়া যায়নি। ব্রিটিশ শাসনামলে আমাদের দেশে ছিল ঔপনিবেশিক শাসন; পাকিস্তানি শাসকরা স্বাধীনতা ঔপনিবেশিকতার অবসান ঘটায়নি, উল্টো নতুন এক ধরনের উপনিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টায় ছিল; ব্যর্থ হয়ে গণহত্যা ঘটিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশেও তো দেখা যাচ্ছে ঔপনিবেশিকতা বিদায় হয়নি; বললে অতিশয়োক্তি হবে না যে বাংলাদেশেও আমরা ঔপনিবেশিক বন্দোবস্তের ভেতরেই রয়েছি। এখানে ধনীদের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব ধনীর স্বপ্নের লালন-পালন বিদেশে; এবং এরা যে কাজটা করতে সবচেয়ে দক্ষ ও উৎসাহী, তা হলো দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করা; অবিকল সেই বিদেশি শাসকদের মতোই।
কিন্তু মুক্তির স্বপ্ন এবং মুক্তির জন্য সংগ্রামটা তো মিথ্যা নয়। বিক্ষিপ্ত, নানা ধারায় প্রবাহিত হলেও মুক্তির সংগ্রামটা কিন্তু চলছে। মুক্তির জন্য আবশ্যক হচ্ছে একটি সামাজিক বিপ্লব, যেটি ঘটেনি। ব্রিটিশ আমলের সেই শাসক ও শাসিতের, জমিদার ও প্রজার সম্পর্কটা এখনো রয়ে গেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়েই ঘটা সম্ভব; তার জন্য অন্য কোনো পথ নেই। ড. শামসুজ্জোহাদের প্রাণদান কিন্তু ওই কথাটাই বলে গেছে। তারা প্রাণ দিয়েছেন ব্যক্তির স্বার্থে নয়, সমষ্টির স্বার্থে। সমষ্টির মুক্তির সংগ্রামে তারা আছেন এবং থাকবেন। ভরসা সেটাই।
সেদিন নিশ্চয়ই আসবে, যখন শামসুজ্জোহারা আর বাস্তুচ্যুত হবেন না, দণ্ডাদেশও পাবেন না মৃত্যুর। আসবে সংগ্রামের ভেতর দিয়ে; যে সংগ্রাম একই সঙ্গে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক। নইলে তো কেবল আমাদের এই প্রিয় দেশ নয়, পুরো পৃথিবী মনুষ্য বসবাসের জন্য উপযোগীই থাকবে না।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়