পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সাড়ে ১৭ হাজার টাকা করার প্রস্তাব : সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ

আগের সংবাদ

পদ্মার বুকে স্বপ্নের পারাপার : প্রমত্তা পদ্মা পাড়ি দিল ট্রেন > উদ্বোধন করে মাওয়া থেকে ভাঙ্গা গেলেন প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

এতদিনকার বাকযুদ্ধ ভোটযুদ্ধে বাঁক নেবে কি?

প্রকাশিত: অক্টোবর ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনকারী কয়েকটি দল ও জোট শুরুতে মিছিল-সমাবেশ, পরে বিভিন্ন দাবিনামায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রায় বছর ধরে রাজনীতির মাঠে রয়েছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনকারীদের দখলে রাজনীতির মাঠ এককভাবে থাকতে দিচ্ছে না। উভয় রাজনৈতিক শক্তি আগামী জাতীয় নির্বাচনে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। যুগপৎ আন্দোলকারী দল ও জোটগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং পরে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। অন্যদিকে সরকারি দল এবং জোট সংবিধান অনুযায়ী দেশে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে বলে প্রতিশ্রæতি দিচ্ছে। কিন্তু গত ১ বছর ধরে রাজনীতির মাঠে উভয় শক্তি প্রতিনিয়ত বাকযুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। কেউ কারো চাইতে এক ইঞ্চি পিছিয়ে থাকার নয়। দলীয় সভাগুলোতে বিরোধীরা সরকারের বিরুদ্ধে যা বলে, আওয়ামী লীগের সভা থেকে সেগুলোর জবাবও আওয়ামী লীগের ভাষায় দেয়া হয়। বলা চলে, গত ১ বছর ধরে মানুষ দুপক্ষের এত নেতার বাকযুদ্ধ শুনতে শুনতে তাদের বক্তৃতা শোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। বিরোধীরা সরকার উৎখাতের নানা ডেডলাইন দিয়েছিল। সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে পথ খুঁজে পাবে না বলেও বলা হয়েছে। অন্য নেতাদের সম্পর্কেও একই কথা। আওয়ামী লীগের নেতারাও প্রত্যুত্তরে অনেক কথাই বলেছিলেন, যা নিয়ে উভয় পক্ষই রাজনীতির মাঠে ঢোল এবং তবলা বাজিয়েছে। কেউ বলছে, খেলা হবে, প্রত্যুত্তরে দেখা হবে ইত্যাদি উত্তর শুনে শুনে নেতাকর্মীরাও কথাগুলোর মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছে। রাজনীতির ভাষাই অনেক সময় হারিয়ে যেতে দেখা গেছে। আক্রমণাত্মক অঙ্গভঙ্গি, বাচনভঙ্গি দেখে ও শুনে কিছু মানুষ বিনোদন পেয়েছে। কিন্তু স্থায়ী কোনো আনন্দ তাতে পাওয়ার কথা নয়। রাজনীতির উভয় জোটেই অসংখ্য নেতা যারা চিৎকার, চেঁচামেচি করেই বক্তৃতা করে, কাছে পেলে হয়তো মল্লযুদ্ধ করতেন। কিন্তু নিজ নিজ জনসভা থেকে একে অপরকে দেখে নেয়ার মধ্যে যে যুদ্ধাংদেহী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে, তাকে এককথায় সবাই বাকযুদ্ধই বলছে। ভাগ্য ভালো যুদ্ধটা মুখে মুখে ছিল, শারীরিকভাবে ঘটেনি। সেদিক থেকে বাকযুদ্ধ নিয়ে অস্বস্তি নেই, তবে খুব বেশি রাজনৈতিক স্বস্তিও এতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের রাজনীতিতে চিন্তাশক্তির দুর্বলতা এর মাধ্যমে প্রকট হয়ে ওঠে। অথচ ৫০, ৬০ এর দশক এবং স্বাধীনতার পরও আমাদের অনেক রাজনীতিবিদ এমনকি ছাত্রনেতার বক্তৃতা বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে দাঁড়িয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের শুনতে দেখা যেত। মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবের বক্তৃতা ৫০-এর দশকে শুনতে অনেকেই ছুটে যেতেন। ৬০-এর দশকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য রেল, লঞ্চ, স্টিমার, বাস, ট্রাক ভরে মানুষ এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ছুটে গেছে, অসংখ্য মানুষ হেঁটে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে এসেছে। বিশাল বিশাল সেই জনসভায় বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দিতেন, নিস্তব্ধতায় জনসভা ভরে যেত। পিনপতন নীরবতার মধ্যেই মানুষ শুনতেন তার দরাজ কণ্ঠের যুক্তি ও তথ্যে ভরপুর অথচ সাধারণ মানুষের উপজীব্য ভাষণ। কোথাও কোনো কটূক্তি, শ্লেষ, আত্ম-অহমিকা, অন্যকে আক্রমণ করার কোনো চেষ্টাই দেখা যেত না। আজো ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এ প্রজন্মের তরুণ, কিশোররাও মুগ্ধতার চিত্তে শুনে ও ধারণ করে। রাজনীতির এসব বক্তৃতা মেঠো ছিল না, এসবই হয়ে উঠেছে আন্দোলন-সংগ্রাম, রাজনীতি সচেতনতা এবং ইতিহাস নির্মাণের একেকটি দলিলে। অন্য নেতাদেরও বক্তৃতা ছিল শেখার, শোনার এবং উপলব্ধি করার। কিন্তু হায়! আমাদের রাজনীতির সেই মহানায়কদের আমরা হারিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিবিদদের বক্তৃতাও আমাদের রাজনীতির মাঠ থেকে হারিয়ে গেছে। এখন যারা রাজনীতি করেন, তাদের বেশির ভাগই দাবি করেন তারা রাজনীতিবিদ। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক আদর্শ, দেশপ্রেম, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা, দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে তাদের বক্তৃতায় কোনো আলোচনা নেই। শুধু অন্যকে ছোট করা এবং নিজেকে বড় থেকে আরো বড় করে দেখা ও জানান দেয়ার যেন আর্তনাদ শোনা যায়। সেখান থেকেই বাকযুদ্ধটি রাজনীতির মাঠে এখন একটা সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এর কিছুই সাধারণ মানুষের উপভোগ্য হওয়ার ধারেকাছেও নেই, নানা বিতর্ক, হতাশা আর বীতশ্রদ্ধ তৈরি করে। জনসভায় উপস্থিত অধিকাংশ নেতাকর্মী এসব মেঠো বক্তৃতার বাইরে চিন্তাই করতে পারে না। এখন গ্রামগঞ্জে কিংবা উপজেলা-জেলা পর্যায়ের নেতাদের বক্তৃতা শুনলে বোদ্ধাদের যেন পালানোর তেমন কোনো পথ খোলা থাকে না। সারাদেশেই রাজনীতির মাঠে বাকযুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না।
রাজনীতির মাঠের এই বাকযুদ্ধ অক্টোবরে এসে গড়াল। বিরোধীরা দাবি করেছিল, ৩ তারিখ একটা কিছু হবে। তেমন কিছু হয়নি। এখন বলা হচ্ছে ১২ তারিখ হবে, ১২ তারিখ না হলে ১৪ তারিখ, ১৬ তারিখ এবং ১৮ তারিখও কিছু একটা হতে পারে। এরপর দুর্গাপূজার বিরতি। বাংলাদেশে দুর্গাপূজা নিয়ে একসময় যে সম্প্রীতি ছিল, সেটি অনেক আগেই নানা আঘাত-প্রতিঘাতে যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে তাতে পুলিশি পাহারা না বসানো হলে উৎসবের নিশ্চয়তা কে দেবে? বাংলাদেশে রাজনীতি এই নিশ্চয়তা হরণ করেছে। কাদের রাজনীতি হরণ করেছে, সেটি নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এবার কী হয় তা পরে দেখা যাবে। তবে পূজার পরে আবার আন্দোলনের কর্মসূচি আসছে। তখন কর্মসূচির ধরন কী হবে, তা আমরা এখনো নিশ্চিত নই। মাঠের বাকযুদ্ধ শুনে মনে হয় বিরোধী দল এসপার-ওসপার না করে ছাড়বে না। তাহলে বাকযুদ্ধ কি রাস্তায় মারামারির যুদ্ধে রূপ নেবে? অগ্নিসন্ত্রাস হবে? এসব প্রশ্ন হতেই পারে। নানা অনুমান আর ধারণা নিয়েই রাজনীতির সামনের দিনগুলোকে অনেকে বোঝার চেষ্টা করছে। গণমাধ্যমে সে একই ভাষায় প্রতিদ্ব›দ্বীদের বাকযুদ্ধ শুনতে হয়। কিন্তু ভোট নিয়ে যে যুদ্ধটি করতে হয়, তার কোনো আলামত নেই। ভোট দেবে জনগণ। জনগণের মন জয়ের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। শহরে আর গণমাধ্যমে দেখে নেয়া আর ফেলে দেয়ার হুংকার শোনা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আরেক যুদ্ধের প্ল্যাটফর্ম, সত্য-মিথ্যা সেখানে নির্ণয় করা বেশির ভাগ মানুষের পক্ষেই কঠিন হয়ে গেছে। গুজব, অপপ্রচার, মিথ্যাচার, ইতিহাস বিকৃতি, কাল্পনিক নানা ঘটনা, রটনা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার এক সহজ যান্ত্রিক উপায়। এসবই আমাদের দেশের রাজনীতির মাঠে এখন সক্রিয়।
যুগপৎ আন্দোলনকারীরা এ মাসেই দেশে ক্ষমতার অদল-বদল ঘটাবেন এমনটি বাকযুদ্ধে, গণমাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক নানা মহল অনেক কিছু বলছে কোনটা সঠিক, কোনটা বেঠিক তা নিকট ভবিষ্যতেই কেবল বোঝা যাবে, তবে যুগপৎ আন্দোলকারীদের আন্দোলনের দিন আর খুব বেশি প্রলম্বিত হবে না। এক বছর টেনে আনা গেছে অন্তত ঘর থেকে রাজনীতির মাঠে আনা গেছে, এটি কম নয়। তবে কী আছে নেতাদের আসল পরিকল্পনায়, সেটি বোঝা কঠিন। হতে পারে আগামী নির্বাচনটিকেও বিতর্কিত করার জন্য বয়কট করা হতে পারে। তবে বয়কটটি যদি হয় কেবলই আহ্বানের, সেই অধিকার তাদের রয়েছেই। আবার বয়কটের সঙ্গে যখন যুক্ত হয় প্রতিহত করার বিষয়, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কর্মীদের যুদ্ধে নামতেই হবে। সেটার রূপ কী হবে তা, ২০১৩-১৪ এর অভিজ্ঞতা থেকে অনেকে অনুমান করে নিতে পারে। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহল তাদের পক্ষে কতটা অবস্থান নেবে, সেটি তখন দেখার বিষয় হবে। কিন্তু এটি তো সহজ কথা যে যে কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্ব›দ্বী দুই শক্তির অংশগ্রহণ সমান সমানভাবে ঘটলে নির্বাচনটি সুষ্ঠু হতে বাধ্য। এক পক্ষ যদি অংশ না নিয়ে বাধা দেয়, তাহলে ২০১৪ এর উদাহরণ টানা যায়। আবার এক পক্ষ যদি মনোয়ন নিয়ে নানা নাটকীয়তায় ব্যস্ত থাকে, অন্য পক্ষের প্রার্থীরা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বেসামাল আচরণ করে। ২০১৮ এর নির্বাচনে তাই ঘটেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিতে চায়নি। কিন্তু নির্বাচন কমিশন এবং সে সময়ের সরকারের চাপকে উপেক্ষা করার শক্তি তাদের ছিল না। সেই নির্বাচনে যদি তারা অংশ না নিত, তাহলে সেই নির্বাচনটি নিয়েও তখন প্রশ্ন তোলা যেত। বলা হতো এক পক্ষীয় নির্বাচন। ’২৪ এর নির্বাচনটি যুগপৎ আন্দোলনকারীরা বয়কট করে একপক্ষীয় করার কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায় কিনা, সেটিই দেখার বিষয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যুগপৎ আন্দোলনকারীরা অক্টোবর বিপ্লব সফল করতে না পারলে তারা কী পরবর্তী নির্বাচনটিকে বিতর্কিত করার পথে হাঁটবে, নাকি তাদের আন্দোলন, বাকযুদ্ধ ইত্যাদির অবসান ঘটিয়ে একটা ভোটযুদ্ধের বাঁক পরিবর্তন ঘটাবে। বাকযুদ্ধে কতটা লাভ হয়েছে কী হয়নি তা আন্দোলনকারীরাই ভালো বলতে পারবেন। তাদের নেতাকর্মীরা তো উজ্জীবিত হয়েছে। উজ্জীবিত নেতাকর্মীদের নিয়ে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হলে নির্বাচন সুষ্ঠু না হয়ে অন্যকিছু হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ অতীতেও সমানে সমানে যখন প্রতিপক্ষরা থেকেছিল, তখন নির্বাচনে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্তভাবে দু-একটি ঘটনা, দুর্ঘটনা ঘটা ছাড়া বড় ধরনের কোনো সংকট ঘটেনি। কারণ উভয় পক্ষই নিজেদের জয় তুলে নেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। নির্বাচনের সাধারণ পরিবেশ তো সেটিই। যুগপৎ আন্দোলনকারীদের মধ্যে কেউ কেউ এই বাস্তবতা বোঝেন না, তা বলা যাবে ন। তবে বক্তৃতা, টকশো আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুদ্ধসমূহ দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। সিদ্ধান্তটা নিতে হবে রাজনীতির প্রজ্ঞা থেকে। সেটি অতীতে নিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে। ভণ্ডুলও হয়েছে (২০০৭)। এই সূ² বিষয়গুলো ভেবেই যদি রাজনীতির এপাশ ওপাশের দুই প্রতিদ্ব›দ্বী শক্তি নির্বাচনকে আলিঙ্গন করে, তাহলে ২০০৮-এর মতো একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আমরা দেখতে পাব। বাকযুদ্ধ থেকে ভোটযুদ্ধে মোড় নেয়ার সিদ্ধান্তটাই নভেম্বরে দেখব কি?

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়