প্রতিবন্ধী তরুণদেরও রাজনীতিতে অংশ নেয়া প্রয়োজন : প্যানেল আলোচনায় ছাত্রনেতারা

আগের সংবাদ

অবস্থান স্পষ্ট করল আওয়ামী লীগ : বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করার কোনো সুযোগ নেই

পরের সংবাদ

ঋণখেলাপি কারা?

প্রকাশিত: অক্টোবর ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অনেক ধরনের গল্প সমাজে প্রচলিত আছে- কী করে, কীভাবে লোকজন শিল্পপতি হয়। বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অঢেল ধনসম্পদের মালিক হয়। অভিজাত হয়ে আকাশছোঁয়া জীবনযাপন করে। শোনা গল্প বা কারণের একটা অন্যতম গল্প বা কারণ হলো, এরা মোটা অঙ্কের ব্যাংক ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ করে না। প্রয়োজন বোধ করে না। ঋণ পরিশোধে তেমন চাপ প্রয়োগও নেই। আছে বলে কখনো মনে হয়নি। উপরন্তু ঋণখেলাপি হয়ে সিনা চওড়া করে এরা সমাজে অবস্থান করে। প্রতীয়মান হয়েছে, ব্যাংকসখ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে এদের এক ধরনের সমঝোতা বা বোঝাপড়া থাকে। সঙ্গে থাকে সরকারের নমনীয় মনোভাব। যার কারণে ঋণখেলাপি হয়ে উঠতে এদের কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় না। ফলে প্রতি বছর ঋণখেলাপির সংখ্যা বাড়ে। পরিধি বাড়ে। নতুন নতুন কোটিপতির জন্ম হয়। যারা ঋণখেলাপি হয়, তাদের অর্থ পাচারের গল্প নেই, তা কিন্তু নয়।
মজার বিষয় হলো, এই ঋণখেলাপিরা ঋণের দায়মোচনে প্রতি বছর সরকারের কাছ থেকে সহায়তা পেয়ে থাকে। সরকারের নীতিনির্ধারণীতে বিধিগুলো এমনভাবে করা হয়, যাতে এই শ্রেণির মানুষ সহজে ছাড় পেয়ে যায়। বড় সহায়তা যেটা করা হয়, সেটা হলো বকেয়া ঋণ পরিশোধের জন্য এই ঋণখেলাপিদের সুদের হার কমিয়ে দেয়া হয়। অজুহাতটা হলো, যেন তারা বকেয়া ঋণ সহজে পরিশোধ করে, করতে পারে। যদিও তারা সেই অর্থে ঋণখেলাপির পরিচয় থেকে বেরিয়ে কখনোই আসে না। তাগাদাও থাকে না বের হওয়ার। অনেকের ধারণা, এই ঋণখেলাপি শিল্পপতিদের প্রতিষ্ঠান থেকে বড় অঙ্কের টাকা যায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। সরকারের দুর্যোগ তহবিলে। একটা কথা বাজারে প্রচলিত, রাজনৈতিক সংগঠনগুলো চলে ব্যবসায়ীদের চাঁদায়। এমন ধারণা সত্য হলে বলা যায়, ঋণখেলাপির সংখ্যা কখনোই কমবে না। বরং বাড়বে। সম্ভবত এই কারণে ঋণখেলাপিরা কোনোভাবে কোনো শর্তে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে চায় না, করে না। অথচ যারা ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করে ঋণ নিয়মিত পরিশোধ করে থাকে ও করছে, যতদূর জানা, তাদের জন্য সরকারের কোনো সহায়তা বা স্বীকৃতিস্বরূপ কোনো বাহবা নেই, ছিল না। এই শ্রেণির গ্রাহকের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ যদিও ঋণখেলাপিদের মতো হয় না।
এই দেশে অতিরিক্ত কর প্রদানকারীদের জন্য পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি বছর বেশ আয়োজন করে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে বেশি কর প্রদানের জন্য পুরস্কৃত হতে দেখি। যদিও জানা সম্ভব হয় না, এই অতিরিক্ত কর প্রদানকারীদের ভেতর কতজন ঋণখেলাপি বা কালো টাকার মালিক রয়েছে। নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারীদের জন্য কী আছে, তার জন্য কোনো আয়োজন বা তাদের সম্পর্কে তেমন প্রচারণা নেই। একজন রসিকতা করে বলছিল, অপরাধীদেরই তো শাস্তি মৃদু করার অর্থাৎ কমানোর সুযোগ থাকে। নিরপরাধীর জন্য শাস্তি কমানোর বিধান আইনে বা নীতিতে কই? ঠিক তাই। যারা অন্যায়, অবৈধ ও অনৈতিক কাজ করে, ঘুরেফিরে তারাই পুরস্কৃত হয়, এমন প্রতিক্রিয়া সাধারণ মানুষের। এই ধারণা অযৌক্তিক বা অমূলক নয়।
যা হোক, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। বলাবাহুল্য, রিজার্ভের অবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক মহল সমালোচনায় মুখর। এটা এখন একটা রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। ইতিপূর্বে অর্থনৈতিক মন্দা কাটতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে দেয়া ঋণের শর্ত হিসেবে খেলাপি ঋণ কমাতে বলেছিল। তা হয়নি। বরং বেড়ে দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। রীতিমতো আশঙ্কাজনক এই বেড়ে যাওয়া! কী জবাব আছে এর? জানা গেছে, চরম অসন্তোষ ও বিরক্ত আইএমএফ। আইএমএফকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলে। যার মধ্যে রয়েছে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকা তৈরি করা, সব খেলাপির জন্য নতুন ঋণ অনুমোদন বন্ধ ও ঋণখেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রতিশ্রæতি। পাশাপাশি খেলাপিদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয়ে (আরজেএসসি) নতুন করে তালিকাভুক্তির সুযোগ বন্ধ রাখার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বলা মুশকিল, আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি দিতে কতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার অনুমোদন দিয়েছিল দাতা সংস্থা আইএমএফ ব্যাংক, রাজস্ব ও পুঁজিবাজারসহ বিভিন্ন খাতে মোট ৪৭টি সংস্কার প্রস্তাব দিয়ে।
খেলাপি ঋণ বাড়ার ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্টদের কাছে রয়েছে। যদি প্রকৃতভাবে সততা, স্বচ্ছতার সঙ্গে এটা পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা না হয়, তাহলে দাতা সংস্থার ঋণ প্রদানই কেবল বন্ধ হবে না, উপরন্তু দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে এবং সেটা হবে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে। ঋণ পরিশোধ না করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার জন্য এই ধরনের অপরাধ যথেষ্ট। এই খেলাপি সংস্কৃতিতে যারা ঋণ প্রদান করছে এবং যারা ঋণ গ্রহণ করছে, উভয়েরই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। করা জরুরি। তাদের জনসম্মুখে উপস্থাপন করতে হবে। মূল্যস্ফীতি বাড়লে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। যার প্রভাব গিয়ে পড়ে সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের ওপর। আজ এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, বাজারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির নির্মম শিকার শ্রমজীবী মানুষ। বেঁচে থাকার বিষয়টি তাদের কাছে ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছে।
কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, দাতা সংস্থার অর্থের কী প্রয়োজন। পদ্মা সেতু তো নিজেদের অর্থায়নেই হয়েছে। নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু হয়েছে ঠিকই, এ জন্য জাতিগতভাবে আন্তর্জাতিক পরিসরে আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে, দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। চাইলে আমরা সব পারি, সব কিন্তু এও সত্য যে, রাষ্ট্রে ঋণখেলাপি ও ঋণখেলাপিদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি পাওয়াটা এক ধরনের অশনিসংকেত। যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতাসীন থাকুক না কেন, এটা হতে পারে অস্তিত্ব সংকটের আগাম বারতা। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের অনিয়ম, দুর্নীতির কারণে দেশ ঝুঁকির দিকে যাচ্ছে কিনা, তা দেখা দরকার জরুরি ভিত্তিতে। রাষ্ট্র যদি সবার জন্য তথা সর্বসাধারণের জন্য না হয়, তাহলে রাষ্ট্রের ঝুঁকি বাড়ে বৈকি। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা প্রাপ্তিতে যাদের যুগ যুগ ধরে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে, তারা নিতান্তই সুবিধাভোগী ও সুবিধাবাদী শ্রেণি। এরা দেশ নয়, নিজেদের ব্যক্তি-গোষ্ঠী স্বার্থই দেখে। পারলে এরা দেশ বেচে। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিধাপ্রাপ্তরা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কিন্তু নয়। বছরের পর বছর সুবিধাভোগীরা একই শ্রেণির মানুষই হয়ে থাকে এবং সেটা সব সরকার আমলেই। বর্তমানে ঋণখেলাপির সংখ্যা কিংবা পরিমাণ দেখে বিএনপির উচ্ছ¡সিত হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। কারণ হলো, এমন ঋণখেলাপিরা তাদের আমলেও ছিল। ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুর্নীতি। ইতিহাস বিকৃত করার ধৃষ্টতা বিএনপির আমলের।
পরিশেষে বলব, সর্বসাধারণকে নিয়েই রাষ্ট্রকে চলতে হবে। সুতরাং সব জনগণ যেন তার ন্যায্য অধিকার ও সুবিধা সমভাবে ভোগ করতে পারে, রাষ্ট্রই সেটা নিশ্চিত করবে। অনিয়ম ও দুর্নীতির নতুন গল্প রচনা, চর্চার পথ ও প্রক্রিয়াকে কঠোরভাবে রুখতে হবে। যিনি রাজনৈতিক দল করেন, তিনিই কিন্তু শুধু তার ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচিত করেন না, করতে পারেন না। দলের বাইরে একটা বিরাটসংখ্যক মানুষ থাকে, যাদের ভোট দিতে হয় এবং তারা ভোট দেন। এই ‘তারা’ কিন্তু সাধারণ জনগণ।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়