দক্ষিণখানে ছুরিকাঘাতে শিশুকে হত্যা

আগের সংবাদ

কেউ ভোলে না, কেউ ভোলে > বাস্তবায়নে এগিয়ে আ.লীগ > কথা রাখেনি বিএনপি > ছায়া সরকার হতে পারেনি জাপা

পরের সংবাদ

অর্থ পাচারে প্রকাশ্য ও গোপন ফাঁদ

প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শিরোনাম দেখে মনে হতে পারে, বিষয়টি সম্পর্কে সাধারণ মানুষও তা বোঝে। কিন্তু আসল সত্য হচ্ছে তারা কিছুই জানে না ও বোঝে না। আবার যারা জানে ও বোঝে, সেসব ব্যাংকিং সেক্টরের মানুষ দূষিত চিন্তা আর দূষিত রাজনীতির সংমিশ্রণে তৈরি যে, বাণিজ্যিক লিগেসি বা বাণিজ্যের যে ওপেন ঐতিহ্য চলছে তাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। যারা পণ্য রপ্তানি করছেন তারা সেই মূল্য দেশে ফেরত আনছেন না বা তারা তার একটা অংশ বিদেশেই রেখে দিচ্ছেন।
এটা কেন করছেন তার দুটি প্রকাশ্য কারণ থাকতে পারে।

এক.
ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা এ দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে উদ্বেগাক্রান্ত। সেই উদ্বেগ একদিকে যেমন ক্লাইমেট নিয়ে, অন্যদিকে তেমনি রাজনৈতিক ক্লাইমেটের পরিবর্তন বিষয়ে অনিশ্চয়তার দুশ্চিন্তা থেকে। তাদের পারিবারিক সম্পদের নিরাপত্তাসহ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় জড়িত। এরাই মূলত বিদেশে টাকার একটি অংশ পাচার করে রেখে দিচ্ছেন বা সেখানে দ্বিতীয় হোম গড়ে তুলেছেন। আমরা সংবাদপত্রে প্রায়ই দেখছি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে দ্বিতীয় হোম করেছেন অনেকেই। তাদের সংখ্যা সাড়ে তিনশরও বেশি। আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকরাই এ কাজের কাজী। কানাডার টরন্টোতে বেগম পাড়ায়ও আমলা আর ব্যবসায়ীদের আবাসন গড়ে উঠেছে। লন্ডন বা প্যারিসে, ব্রাসেলসে বা ভেনিসে যে বাঙালিদের পাচার করা অর্থে নিরাপদ হোম গড়ে ওঠেনি তা হলফ করে আমরা কেমন করে বলব?

দুই.
এই সপ্তাহে আইএমএফ তাদের ঋণের প্রথম কিস্তির বিনিয়োগ নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় হয়েছে কি না এবং তারা যেসব শর্ত দিয়ে ঋণ অনুমোদন করেছিল, তা বাংলাদেশ ব্যাংক পরিপালন করছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে এসেছে। সেই নিরিখেই আমরা জানতে পারলাম বাংলাদেশ ব্যাংক অন্তত দুটি বিষয়ে ব্যর্থ হয়েছে। গত জুনের মধ্যে রিজার্ভ ২৪ বিলিয়নের ওপরে রাখার শর্ত ছিল। কিন্তু তারা তা পারেনি। এখন রিজার্ভ কমে ১৮ বিলিয়নে নেমেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে এটা উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। কেন এমনটা হলো? এর জবাব কে দেবে? বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় তার কোনো জবাব দেয়নি বা তারা জবাব দিতে অভ্যস্ত নয়। বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এররস অ্যান্ড ওমিশনস সবসময় ঋণাত্মক থাকার অর্থ হলো তা দৈবাৎ বা এলোমেলো কিছু নয়। এটি ঋণাত্মক হওয়ার মানে হলো অর্থের বহিঃপ্রবাহ ও আন্তঃপ্রবাহের যে ব্যবধান, রিজার্ভ থেকে ব্যয় হয়েছে তার চেয়েও বেশি। আর এ ব্যয়ের অঙ্কটা যেহেতু হিসাবে পাওয়া পরিমাণের চেয়ে বেশি, তার মানে তা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ থেকে অর্থ পাচারের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায়ও এররস অ্যান্ড ওমিশনস মাইনাসে থাকাকে অবৈধ পুঁজি পাচারের একটি সূচক হিসেবে দেখানো হয়েছে। কারণ এটি দীর্ঘমেয়াদে একমুখী বা ঋণাত্মক হওয়ার অর্থ হলো এখানে এমন কিছু একটা ঘটছে যা জানা যাচ্ছে না। অর্থাৎ এ ভুল শুধুই ভুল না।
তার মানে হচ্ছে ভুল বা এররস অ্যান্ড ওমিশনস বলে যাকে বলা হচ্ছে তা ঋণাত্মক বা বিয়োগাক্রান্ত থাকলে, তার প্রধান কারণই হচ্ছে অর্থ পাচার। প্রশ্ন হচ্ছে এই পাচারে কারা জড়িত ও কাদের আইনের হাতে আনতে হবে, তা চিহ্নিত করা। আমাদের ধারণা ২০১০-২০২৩ পর্যন্ত এররস অ্যান্ড ওমিশনসের ফাটলটি পর্যায়ক্রমে বেড়েছে। আর যতদিন যাচ্ছে ততই এররস অ্যান্ড ওমিশনসের ঋণাত্মক অবস্থার ফাঁক বাড়ছে। এটা সুস্পষ্ট যে পাচার হচ্ছে টাকা বা ডলার। কত টাকা হতে পারে তার পরিমাণ?
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে বিওপি ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬৬৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এর মধ্যে ঋণাত্মক ৩৬৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা প্রায় ৫৫ শতাংশ ছিল এররস অ্যান্ড ওমিশনস। এরপর গত অর্থবছরে ৮২২ কোটি ২০ লাখ ডলার বিওপি ঘাটতির মধ্যে ভুল বা বাদ পড়া লেনদেনের অংশ দাঁড়ায় প্রায় ৩৯ দশমিক ২ শতাংশে, যার পরিমাণ ঋণাত্মক ৩২২ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বিওপির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৬৯ কোটি ৫০ লাখ ডলারে। এর মধ্যে এররস অ্যান্ড ওমিশনস আছে ঋণাত্মক ৭৯ কোটি ৬০ লাখ ডলারের বা ৪৭ শতাংশ।
এই যে ত্রæটি এবং বাদ দেয়ার অর্থনীতির পরিভাষা, তা তো সাধারণের জ্ঞানের অধীন নয়। এটা বুঝেন অর্থনীতিবিদ আর ব্যাংকাররা, বোঝেন শিল্প সেক্টরের ঝানু ব্যবসায়ীরা। বোঝেন পণ্য রপ্তানিকারকরা।
তার মানে দাঁড়াচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আন্তঃপ্রবাহ ও বহির্প্রবাহের মাঝখানে যে ফোকড়টি তৈরি করেছেন তারা সেটই ফোকড় গলিয়ে চলে যাচ্ছে ডলার বা টাকা বিদেশে। আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভারইনভয়েসিং নামের দুটি চোরাই পদ্ধতির মাধ্যমেও এটা করা হয়। যখন পণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে তখন দেখানো হলো যে এর নীট মূল্য ১ হাজার ডলার। কিন্তু সে পণ্য পাঠিয়েছে ১২শ ডলারের। ওই বাড়তি টাকাটা সে রেখে আসছে বিদেশে। আবার পণ্য ১ হাজার ডলারের পাঠানোর কাগজ থাকলেও সে দেশে আনছে ৮০০ ডলার। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে ঘাটতি থাকছেই। এছাড়াও আরো জটিল ও পাচার করার বহু ছিদ্র আছে, যা সৃজন করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়টির নাম হুন্ডি। বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাসীরা যেন হুন্ডি না করে ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে টাকা পাঠান, সেই অনুরোধ তো খোদ প্রধানমন্ত্রী বিদেশে গেলেই বলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এটাই যে, তার অনুরোধ রাখছে না শ্রমজীবী মানুষ। তারা হুন্ডি করছে যেহেতু সেখানে সে বেশি টাকা পাচ্ছে। আবার যারা ব্যাংক চ্যানেলে টাকা পাঠাচ্ছে তারা উপযুক্ত রেমিট্যান্স প্রণোদনা পাচ্ছে না। এটা একটি জটিল পদ্ধতির সরল গল্প। ফলে এখান থেকে টাকা পাচার করা সহজ। আর যারা সেটা করছেন, প্রায় প্রকাশ্যেই করছেন। তাদের কোনো ভয় নেই ভীতি নেই। এই যে এস আলম গ্রুপ ১০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে বিনিয়োগের নামে পাচার করেছে, যা এখন তদন্তাধীন এবং সেই নিউজ আর পত্রিকা বা ইলেকট্রনিকস মিডিয়াতে আসছে না, তা রোধ করা তো যায়ইনি আবার তাকে আইনের আশ্রয়েও আনেনি সরকার। কারণ তিনি সরকারের লোক। এসব সরকারের লোকই তো সব অপকর্মের হোতা। ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের ফেডারেশন এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচনের সময় দেখলাম তারা বলছেন হাসিনা সরকারের পক্ষে তাদের নির্বাচনী সায় হান্ড্রেড পার্সেন্ট। তারা হাসিনা সরকারের দেয়া যেসব ঋণ সুযোগ পাচ্ছেন, অন্য কোনো সরকার তা দেবে না। লাখ লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ের কোনো উদ্যোগ নেই ব্যাংক খাতে, বরং উল্টো আরো ঋণ দেয়ার পথ সহজ করেছে সরকার। যেমন কোনো শিল্পপতি যদি তার একটি প্রতিষ্ঠান যদি খেলাপি হয়, তাহলেও তার গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠান ঋণ নিতে পারবে। তার খোলাপিত্ব বাধা হবে না। ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ঋণ নেয়াওয়ালা তো ওভাবেই লুটে নিয়ে চলেছে জনগণের টাকা সরকারের উদার রাজনৈতিক সহযোগীদের কল্যাণের লক্ষ্যে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় একটি সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপকে বিশেষ বিবেচনায় ২২ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘আমাদের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টটা ঋণাত্মকে নেমেছে। আমরা মনে করি ব্যালান্স অব পেমেন্টের যে সর্বশেষ পরিস্থিতি, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টই এর মূল কারণ।’
গেøাবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে (২০১৪ সালের হিসাব বাদ দিয়ে) বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে ৮২৭ কোটি ডলার। তবে বর্তমানে এ অঙ্ক এরই মধ্যে বার্ষিক হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে বলে সন্দেহ অনেক বিশেষজ্ঞের।
বিওপিতে ভুল বা বাদ পড়ার তথ্যটিকে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের তথ্যে পরিসংখ্যানগত বিভ্রান্তির বড় নমুনা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) বাংলাদেশ থেকে বিশ্ববাজারে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি ডলারের। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ ড্যাশবোর্ডের হিসাবে দেখা যায়, রপ্তানিকারকরা গত অর্থবছরে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে রপ্তানির ঘোষণা (ইএক্সপি) দিয়েছেন ৪ হাজার ৬৩১ কোটি ডলারের। এ অনুযায়ী দুই সংস্থার গত অর্থবছরের রপ্তানি তথ্যে গরমিল রয়েছে ৯২৪ কোটি (৯ দশমিক ২৪ বিলিয়ন) ডলারের। ইপিবি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রপ্তানি তথ্যে বরাবরই গরমিল থাকলেও গত অর্থবছরেই তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়।
এটা কেন হচ্ছে? কারণ ব্যবসায়ীরা কিছু আঁচ করতে পারছেন। তারা শঙ্কিত, তাদের অর্জিত অর্থ রক্ষা করতে পারবেন? আর আগামী দিনগুলোতে এই পাচারের সুযোগটি থাকবে কিনা। ব্যবসায়ীরা দেশ ও জনগণের প্রতি যে প্রেম দেখান, তা যে বিত্ত আর বৈভব গড়ে নিজেদের গণমানুষের থেকে অনেক দূরে মহানগরে বসবাসের লক্ষ্যে, এমনকি সিঙ্গাপুরে, লসএঞ্জেলেস, নিউইয়র্ক, লন্ডনে বসবাসের জন্য তা বলাইবাহুল্য। পাচারের ঋণাত্মক ফাটল তাই বাড়ছেই।

ড. মাহবুব হাসান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়